কৃষিবিদ মোহাইমিনুর রশিদ, অতিরিক্ত কৃষি অফিসার, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ফসল উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো মাটি। খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ, বায়ু ও পানি সমন্বয়ে গঠিত হয় মাটি। মাটির উপরিভাগের প্রায় ১ মিটার পর্যন্ত ফসল উৎপাদনের জন্য উপযোগী। মাটির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও তার সুষ্ঠু ব্যবহারও অনেকাংশে মানুষের ওপরই নির্ভরশীল।

মাটির ফসল উৎপাদন ক্ষমতাকে উর্বরতা বলা হয়। ফসলের ভালো ফলন মাটির উর্বরতার ওপর নির্ভরশীল। এ মাটিকে উৎপাদনশীল রাখতে হলে এর উর্বরতা বজায় রাখা ও উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের বেশ যত্নবান হতে হবে।

মাটির অম্লমান বা পিএইচ দ্বারা মাটির অম্লত্বের তীব্রতা নির্ধারণ করা হয়। মাটির অম্লমান সর্বাধিক ১৪ পর্যন্ত হতে পারে। মাটির অম্লমান ৭ এর নিচে হলে তা অম্লীয় মাটি এবং ৭ এর ওপরে হলে তা ক্ষারীয় মাটি। অম্লমান ৭ থেকে যত কমতে থাকবে মাটি তত বেশি অম্লীয় হবে। মাটির অম্লমান ৫.৫ বা এর কম হলে তা তীব্র অম্লীয় মাটি।

কৃষকরা একই জমিতে বছরে দুটি, তিনটি এমনকি চারটি ফসলও চাষ করছে। পক্ষান্তরে কৃষকরা সুষম মাত্রায় সার ও জৈবসার সঠিকভাবে ব্যবহার করছেন না। ফলে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

প্রতিনিয়ত অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক সার ব্যবহারের মাধ্যমে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মাটির অম্লত্ব বা এসিডিটি। এসিডিটিক মাটি বা অম্লযুক্ত মাটিতে ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, মলিবডেনামের সহজলভ্যতা হ্রাস পায় তাছাড়া মাটিতে অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও আয়রনের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পায়। ফলে ফসলের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, ফলন হ্রাস পায় ও গুণগতমান নষ্ট হয়।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর ফসলি মাটি তীব্র এসিড বা অম্ল মাটি যার পিএইচ মান ৫.৫ এর নিচে। এসব মাটিকে এসিডযুক্ত অসুস্থ মাটি বলে। বৃহত্তর রংপুর, বৃহত্তর দিনাজপুর, বৃহত্তর সিলেট, বৃহত্তর চট্টগ্রাম, রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল, টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় তীব্র এসিডযুক্ত মাটি রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় গম গবেষণা কেন্দ্র, বারি, নশিপুর, দিনাজপুরের দীর্ঘ ১০ বছর গবেষণার পর তীব্র অম্লযুক্ত মাটিকে সংশোধন করার জন্য ডলোচুন ব্যবহারের মাত্রা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়।

গবেষণা ফলাফল অনুযায়ী আমাদের দেশের তীব্র অম্লীয় মাটিতে সুপারিশকৃত মাত্রায় ডলোচুন ব্যবহার করা হলে বছরে অতিরিক্ত ৫০ থেকে ৬৫ লাখ টন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।

ডলোচুন: ডলোচুন হলো এক ধরনের সাদা পাউডার জাতীয় দ্রব্য। আমরা ভিন্ন ভিন্ন নামে যেমন ডলোচুন, ডলোঅক্সিচুন বা ডলোমাইট পাউডার হিসেবে পেয়ে থাকি। সুপারিশকৃত মাত্রায় ডলোচুন ব্যবহার করলে তীব্র অম্লীয় মাটিকে সংশোধন করা যায়। ডলোচুনে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম থাকে, যা তীব্র অম্লীয় মাটির অম্লত্ব হ্রাস করতে সাহায্য করে।

ডলোচুনের সুপারিশকৃত মাত্রা: অধিক ফসলের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশকৃত মাত্রা খুবই জরুরি। অধিক অম্লীয় মাটিতে সুপারিশকৃত মাত্রা হলো শতকে ০৪ কেজি বা একরে ৪০০ কেজি বা হেক্টরে ১০০০ কেজি। কোনোভাবেই এর মাত্রা কম বেশি করা যাবে না। কোনো জমিতে একবার ডলোচুন প্রয়োগ করলে পরে তিন বছর আর ডলোচুন প্রয়োগ করতে হয় না।

ডলোচুন ব্যবহারের নিয়ম: কোনো জমিতে ডলোচুন প্রয়োগের আগে সুপারিশকৃত মাত্রানুযায়ী মোট ডলোচুনকে সমান দুইভাগে ভাগ করে নিতে হবে। জমির মাটিতে জো থাকা অবস্থায় উত্তর-দক্ষিণ বরাবরে অর্ধেক পরিমাণ ডলোচুন ছিটিয়ে দিতে হবে।

বাকি অর্ধেক পরিমাণ ডলোচুন পূর্ব-পশ্চিম বরাবর বা আড়াআড়িভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। ডলোচুন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। অতঃপর কমপক্ষে ৭ দিন পর

জমিতে প্রয়োজনীয় চাষ ও মই দিয়ে ফসল বুনতে বা গাছ রোপণ করতে হবে। ডলোচুন প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে বীজ বপন করলে বীজের অঙ্কুরোদগমের হার কমে যেতে পারে বা অঙ্কুরিত গাছের মূল ও কাণ্ডের বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। জমি যদি শুকনা হয় বা রস কম থাকে তাহলে ডলোচুন ব্যবহারের নিয়ম হলো ফাঁকা জমিতে প্রয়োজন মতো ডলোচুন আড়াআড়িভাবে প্রয়োগ করতে হবে।

এরপর চাষ দিতে হবে। মই দিয়ে সমান করতে হবে। সঙ্গে  হালকা সেচ দিতে হবে। অতঃপর কমপক্ষে ৭ দিন পর জমিতে প্রয়োজনীয় চাষ ও মই দিয়ে ফসল বুনতে বা গাছ রোপণ করতে হবে।

ডলোচুন প্রয়োগের মৌসুম ও কোন কোন ফসলি জমিতে ব্যবহার করা যায়: সাধারণত বছরের যে কোনো সময়ে ডলোচুন প্রয়োগ করা যেতে পারে। তবে আমন ধান কাটার পরে ফাঁকা জমিতে বা রবি মৌসুমে ডলোচুন প্রয়োগের উত্তম সময়। ডলোচুন যেহেতু মাটির এসিডিটি বা অম্লতা সংশোধন করে মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে, ফসল উৎপাদন উপযোগী করে তোলে তাই সব ধরনের ফসল গম, ভুট্টা, আলু, সরিষা, পাট, ডালজাতীয় ফসল, তেলজাতীয় ফসল, মসলাজাতীয় ফসল এবং শাকসবজি জাতীয় ফসলের ফলন বৃদ্ধি ও গুণগতমানের ফসল পাওয়ার জন্য অম্লীয় বা গ্যাস্ট্রিকযুক্ত মাটিতে ডলোচুন ব্যবহার করা যেতে পারে।

ডলোচুন প্রয়োগের সুবিধাগুলো: ডলোচুন প্রয়োগ করা সহজ, খরচ কম কৃষকের হাতের নাগালে। গম, ভুট্টা, আলু, সরিষা, ডাল, মসলা ও সবজি জাতীয় ফসলের ফলন শতকরা ১০-৫০% বৃদ্ধি পায়। ডলোচুন একবার প্রয়োগ করলে পরে তিন বছর প্রয়োগ করতে হয় না।

ডলোচুন একবার প্রয়োগ করলে ম্যাগনেসিয়াম সারের প্রয়োজন হয় না। ফসলের গুণগতমান বৃদ্ধি পায় যেমন আলুর স্কেব রোগ কম হয়, সবজি ফসলের রঙ উজ্জ্বল হয়, পাটের কালো পট্টি রোগ কম হয়। ফসলের বৃদ্ধি সমান হয়।

২০ টাকার মাধ্যমে মাটির অম্লত্ব পরীক্ষা: বাংলাদেশের সব এলাকার মাটিই অম্লীয় নয়। তাই তীব্র এসিডিটিক বা অম্লীয় আক্রান্ত জমি বাছাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য কৃষক নিজে ইচ্ছা করলে তার জমি তীব্র অম্লযুক্ত কিনা তা মাত্র ২০ টাকায় পরীক্ষা করে নিতে পারে।

সেজন্য কৃষকের মূল জমির এককোণায় ফিতা দ্বারা মেপে মাত্র এক শতক জমি চিহ্নিত করতে হবে। অতঃপর চিহ্নিত এক শতক জমিতে মাত্র ২০ টাকা দিয়ে কেনা চার কেজি ডলোচুন নিয়ম মোতাবেক ব্যবহার করতে হবে। তারপর ফসল চাষ করবে এবং অন্যান্য সব ব্যবস্থাপনা একই হবে।

পরবর্তীতে ফসলের বৃদ্ধি এবং ফলনে যদি তারতম্য হয় তাহলে বুঝতে হবে জমিতে গ্যাস্ট্রিক রোগ আছে অর্থাৎ জমির মাটি অম্লীয়। পরীক্ষণটি করতে মাত্র ২০ টাকা দরকার হয় বলে এর নাম দেয়া হয় ২০ টাকার পরীক্ষা।

ডলোচুন ব্যবহারে সাবধানতা: ডলোচুন ব্যবহারে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। সুপারিশকৃত মাত্রার অধিক পরিমাণ ডলোচুন প্রয়োগ করা যাবে না। ডলোচুন প্রয়োগের সঙ্গে  সঙ্গে  চাষ ও মই দিয়ে মাটির সঙ্গে  মিশিয়ে দিতে হবে। মাঠে ফসল আছে এমন অবস্থায় ডলোচুন প্রয়োগ করা যাবে না। বেশি বাতাসের সময় ডলোচুন মাটিতে ছিটানো যাবে না।

জমির দাঁড়ানো পানিতে বা কাদা অবস্থায় ডলোচুন প্রয়োগ করা যাবে না। ফসল উৎপাদনে হাজারো সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো মাটির তীব্র অম্লতা বা এসিডিটি বা গ্যাস্টিক সমস্যা। এ সমস্যা সংশোধনের জন্য সঠিকভাবে সুপারিশকৃত মাত্রা ও পদ্ধতিতে ডলোচুনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে, এখনই। তাই তো, সম্মিলিত কণ্ঠে মুখরিত হোক- 

‘পান খাইতে লাগে চুন, তরকারিতে লাগে নুন, অধিক ফলন পেতে হলে, প্রয়োগ কর ডলোচুন’।