ডেইরি ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: পাবনা ঈশ্বরদীর লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের বরমপুর গ্রামের মৃত নবীর উদ্দিন প্রমাণিকের মেজ ছেলে সফল কৃষক আমিরুল। সবজি বিক্রি করা ১৪ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে একটি শংকর জাতের গাভি কিনেছিলেন। এখন বর্তমানে ১৩৫টি গরুর মালিক তিনি। বছরে গরুর খামার থেকে আয় করছেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা। খবর বাংলা নিউজ।

আমিরুল আস্তে আস্তে লাভজনক খামারের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। আর ওই খামার থেকে প্রতিদিন ৭০টি গাভীর থেকে ৫০০ লিটার দুধ বিক্রি করেন। বছরে ৫০টি বাছুর বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন দুধ বিক্রি হয় ২৫ হাজার টাকায়।

শুধুই আমিরুল প্রমাণিক না। তাকে দেখে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে ইতোমধ্যে স্বাবলম্বী হয়েছেন অনেক বেকার যুবক। দুধ বিক্রির টাকায় চলে কয়েক শতাধিক মানুষের পরিবার।

বর্তমানে দুগ্ধপল্লিতে পরিণত হয়েছে বর্তমানে ঈশ্বরদীর লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়ন। শুধুই তাই না, অনেক বেকার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে।

আমিরুলের খামারের নাম ‘তন্ময় ডেইরি ফার্ম’। চলতি বছরের ১ জুন ওয়ার্ল্ড মিল্ক ডে উপলক্ষে দেশের সেরা ডেইরি আইকন হিসেবে পেয়েছেন সম্মাননা এবং আদর্শ খামারী হিসেবে পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু কৃষি পুরস্কার। প্রাণীসম্পদ খাতে অসামান্য অবদান রাখায় স্বর্ণপদক পেয়েছেন অনেকবার।

শুধু তাই না, নিজ খামারে গরুর গোবর থেকে তৈরি করা হচ্ছে বায়েগ্যাস, কেঁচো কম্পোস্ট জৈব সার। সেখান থেকে বাড়তি আয়ের একটা সুযোগ আছে।

জানা যায়, ১৯৮৪ সালে আমিরুল ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশি চন্দ্র প্রভা বিদ্যাপিঠ থেকে এসএসসি ও ১৯৮৬ সালে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে ডিগ্রি পরীক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তার বাবা মারা যায়। বিএসসি পরিক্ষা দেওয়ার আর সুযোগ মেলেনি সংসারে অভাব থাকায়। বাবার মৃত্যুর পর সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে কাঁধে।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

সোনালীর লাভের টাকায় ১৬ লাখের ডেইরি খামার মুরাদের!

রাজশাহী ডেইরি খামারিদের লোকসান ১০০ কোটি টাকা

ডেইরি ফার্ম শুরু করবেন যেভাবে

ডাকাতি করা গরু দিয়ে বিশাল ডেইরি ফার্ম!

আমিরুলের মায়ের কথায়, ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী রূপপুর থেকে ১৪ হাজার ৬০০ টাকায় একটি শংকর জাতের গাভি কেনা হয়। গাভিটি বাড়িতে নিয়ে আসার কয়েক মাস পর একটি ষাঁড় বাচ্চা প্রসব করে। সে সময় গাভী থেকে প্রতিদিন ১৩-১৪ লিটার দুধ হতো। এর মধ্যে ষাঁড়টি ২৮ হাজার টাকায় বিক্রি করে সেই টাকা জমিয়ে রাখি। পরে গাভিটি দুই বছরে দুইটি বকনা বাচ্চা প্রসব করে। গচ্ছিত টাকার সঙ্গে মায়ের দেওয়া আরও কিছু টাকা যুক্ত করে বাড়িতে তৈরি করা হয় খামারের শেড।

প্রথমে একটি গরুর থেকে ৩টা বাচ্চা হয়। একটি ষাঁড় বাচ্চা বিক্রি করে গরুর ঘর তৈরি করা হয়। আর দুইটি বকনা বাচ্ছা থেকেই আমার সফলতা। আমিরুল, স্বপ্ন দেখতেন একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার। তার বাবার মৃত্যুর পরে ভেঙ্গে যায় সেই স্বপ্ন। একমাত্র ছেলে সন্তান বলেই সংসারের হাল ধরতে হয় আমিরুলকে। তারপর আমিরুলের বাণিজ্যিক খামারের যাত্রা। প্রতিবছর গাভীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বড় হতে থাকে খামারের পরিসর। মায়ের দোয়া নিয়ে আমিরুল বড় খামারি।

শুক্রবার (৪ নভেম্বর) সকালে ঈশ্বরদী লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নের সফল তন্ময় ডেইরি ফার্মের মালিক আমিরুল ইসলাম আবেগআপ্লুত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন।

সফল খামারি হিসাবে গর্ববোধ করে আমিরুল সরদার বলেন, ‘কৃষক পরিবারের ছেলে বললেও ভুল হবে আমি সত্যি বর্গা চাষির ছেলে। আমাদের পাশের গ্রামে জমিদারদের বাড়ি ছিল। তাদের সাথে আমাদের পরিবারে সম্পর্ক ভালো ছিল। একটা সময় আমাদের ঘরে বেশ অভাব! তখন ১৪/১৫ বিঘা জমি বর্গাদার হিসাবে আমরা চাষাবাদ করতাম। ছোট বেলা জমির অর্ধেকটা ফসল দিয়ে আসতে হয়েছে। আমি মনে করি, কারো লক্ষ্য যদি ঠিক থাকে আর পরিশ্রম যদি করা যায় তাহলে সফলতা আসবেই। মা-বাবার দোয়া আর নিজের পরিশ্রম ঠিকই তার সন্তানকে সার্থক করে।

সফলতার পেছনের কারণ সম্পর্কে আমিরুল সরদার বলেন, বাবার মৃত্যুর পর জমি চাষাবাদের সব সরঞ্জাম বিক্রি করে দেওয়া হয়। কারণ সেগুলো দেখার কেউ ছিল না। মা, প্রায় বলতো-ফাঁকা বাড়িটা আর ভালো লাগে না। তখন দুইবিঘা জমিতে বেগুন লাগানো হয়। মনে আছে, গ্রামের হাটে হাটে ঘুরে সারাদিনে ৫৬ মন বেগুন বিক্রি করে টাকা আয় করেছিলাম। সেই টাকা দিয়ে একটি গরু কেনা হয়।

আমিরুল বলেন, ‘এক সময় চর এলাকায় গরু চড়াতে গেলে, আমার গরু চড়াতে দেখে মানুষ হাঁসহাসি করতো। কিন্তু একাগ্রতা আর নিষ্ঠার সাথে খামার করছি আমি সফল হয়েছি, সফল হতে সহায়তা করেছি। গবাদি পশু পালন করে নিজেকে গর্বিত মনে করি। ’

আমিরুল আরও বলেন, এখন গরুর দুধের মূল্য কম। আর খাদ্যশস্যের বাজার বেশ চড়া, তাই গরু পালন করতে হলে ঘাষের চাহিদা বাড়াতেই হবে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দুধ নিতে পারছে না। এতে খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন এই অঞ্চলে।

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষ্মীকুন্ডার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের সফল গরু খামারি, আমিরুল স্বপ্ন দেখেন যে, গোটা ইউনিয়নকে তিনি দেশীয় দুগ্ধ পল্লী হিসাবে রোলমডেল করবেন। এই অঞ্চলের দুধ দিয়ে এই অঞ্চলে মিষ্টিজাতপণ্য তৈরি করা গেলে এই অঞ্চলের খামারিরা লাভবান হবে। তাই প্রয়োজন, সরকারি সহযোগিতা। সে লক্ষ্য নিয়ে তিনি কাজ করছেন।

ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান শরীফ জানান, লক্ষ্মীকুন্ডা ইউনিয়নে এখন যে পরিমাণ দুধ উৎপাদন হয়, সে পরিমাণ দুধ বিক্রির জায়গা নেই;। তাই যদি সরকারিভাবে এই অঞ্চলে একটি দুগ্ধ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। লক্ষ্মীকুন্ডা একটি মডেল ইউনিয়ন রূপান্তরিত হবে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ