নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ২০০৬ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর আর পড়াশোনা করতে পারেননি। কিন্তু দীর্ঘ সময় নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। মাত্র ৩০০ মুরগি দিয়ে খামার শুরু করলেও এখন তাঁর খামারে আছে ১২ হাজার মুরগি। নতুনভাবে তৈরি করেছেন ডেইরি খামার। বাড়ির কাছের বাজারে দাঁড় করেছেন মাঝারি দোকান। এই সবকিছুই হয়েছে সোনালী মুরগির লাভের টাকায়!

বলছিলাম নওগাঁ জেলার সতীহাটের বটতলা এলাকার তরুণ উদ্যোক্তা খামারি মুরাদ হাসানের (৩৪) কথা। খামার শুরু করেছিলেন ২০১০ সালে। দীর্ঘ ১ যুগের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলেন তিনি।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর মান্দা উপজেলার গাড়ীক্ষেত্র গ্রামে তাঁর সোনালী মুরগির খামারে গিয়ে দেখা যায়-বস্তা থেকে খাবার বের করে মুরগির পাত্রে ঢালছেন। আর মুরগিগুলো পাল্লা করে সেই খাবারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। প্রায় বিঘা দেড়েক জমির একপাশে খামার করেছেন। এই খামারে মুরগি আছে তাঁর ৬ হাজার। অন্য দু-খামারে আছে ৬ হাজার।

পিতা মোকছেদ আলী প্রামানিক (৫৮)। তাঁর তিন ছেলেকে নিয়ে কৃষি কাজ করতেন। কিন্তু মুরাদ হাসান চকউলি ডিগ্রি কলেজ থেকে এসএসসি পাশ করার পর তাঁর ভাইকে সাথে নিয়ে ২০১০ সালে শুরু করেন সোনালী মুরগি পালন। তারপর থেকে দুই ভাইকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। এখন ব্যবসা হয়েছে আলাদা। বড় ভাইয়েরও রয়েছে হাজার দশেক মুরগি। তিনিও এখন সফল খামারি।

সোনালী মুরগি অনেকেই পালন করছেন কিন্তু আপনি কিভাবে সফল হলেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাচ্চার দাম দেখে কিনতে হবে। ১ হাজার বাচ্চা কিনতে ১০ টাকা করে বেশি হলে কিনতেই ১০ হাজার টাকা লোকসান হবে। আবার বাঁকিতে খাবার কেনা বন্ধ করতে হবে। যদি ১০০ বস্তা খাবার বাঁকিতে কেনেন কোন খামারি তাহলে তাঁর লোকসান হবে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। কারণ ডিলার বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা বেশি লিখে রাখবে খাতায়। তাহলে এক হাজার মুরগিতে আগেই ৩০ হাজার টাকা লোকসান দিলে লাভ কোথায় থেকে হবে!

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

ডেইরি ফার্ম শুরু করবেন যেভাবে

৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন পোল্ট্রি ও ডেইরি খামারিরা

ঘাস চাষ করেই কোটিপতি গফুর!

মাছ চাষে কোটিপতি ফরহাদ, চলতি বছরে ৭০ লাখ!

ব্যবসা সফলের টেকনিক জানতে চাইলে মুরাদ হাসান এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, খামার শুরু করলেই হবে না। মুরগির তিনটি রোগ সম্পর্কে আগে জানতে হবে। গামবুরো, রাণীক্ষেত আর বার্ড-ফ্লু। একজনের খামারে লাভ হচ্ছে দেখে নিজেও খামার শুরু করবেন বিষয়টা এমন নয়। খামারের পরিবেশ, তাপমাত্রা, নিজে পরিশ্রম করার প্রবণতা থাকতে হবে। আমার খামার দেখছেন- কাঠামো বেশ শক্ত করে তৈরি। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এই পেশায় এসেছি।

তিনি বলেন, আমার মুরগি সেভাবে মরেনি। না মরলেই আপনি লাভ করতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, খামারে রোগের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। আমারও প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যা হলেও পরে আর হয়নি। আমার এই খামারটা মূলত আনোয়ার সিমেন্ট শীট দিয়ে তৈরি ২০১৪ সালে। আমি দুইটা কারণে এই টিন ব্যবহার করেছি। গরমকালে তাপমাত্রা কম হবে। তবে, যখন গরম হয় তখন লোকাল শীট হোক আর সীমেন্ট শীট হোক সবই গরম হয়। খামরি ভাইদের আমি বলব। শীতকালে যে কুয়াশা পড়ে আর টিনের নিচে ঘেমে চুইয়ে পানি পড়ে সেটা আনোয়ার শীটে হবে না। মুরগির পায়ের নিচের লিটার ভিজবে না তাহলে মুরগির রোগ বালাই কম হবে।

সতীহাটের বটতলায় নিজ বাড়ির পাশেই করেছেন ১০টি গরুর ডেইরি খামার। এই খামারে ৪টি গরু কিনেছেন ১০ লাখ টাকায়। এরমধ্যে ৩টি ফ্রিজিয়ান ও একটি দেশাল। ৪ গরু থেকে গড়ে দুধ আসে ৮০ লিটার। এই গরুর দুধের টাকায় চলে তাঁর গরুর খাবারের খরচ। এখন তাঁর ১০টি গরুর দাম কমপক্ষে ১৬ লাখ টাকা।

ডেইরি খামারি হিসেবে আত্মপ্রকাশের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার এই চালানে ১২ হাজার সোনালী মুরগি আছে। প্রতিকেজি মুরগি যদি ২২৫ থেকে ২৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি তাহলে তেমন একটা লাভ আসবে না। কিন্তু ২৬০ কিংবা ২৫০ টাকা কেজি বিক্রি করলে মোটা অংকের টাকা লাভ আসবে। এক হাজার সোনালী পালনে খরচ হয় ১১ লাখ টাকা। এই ১১ লাখ টাকা থেকে কম করে হলেও ২ লাখ টাকা লাভ আসবে। যখন ব্যবসাতে লাভ আসে তখন একটা গরু কিনে রাখি। সোনালীতে এক চালান লাভ কম হলেও সমস্যা নাই। ডেইরি খামার থেকে আমার আয় হতেই থাকবে। এই চিন্তায় এই ডেইরি খামার করা। আর বছর শেষে তো বাছুর পাবো-সেখান থেকে মোটা অংকের টাকা আসবে।

এগ্রিকেয়ার২৪.কমের আরোও নিউজ পড়তে পারেন:

ধ্বংসের পথে লেয়ার, ব্রয়লার, সোনালী মুরগির খামারিরা

ডাকাতি করা গরু দিয়ে বিশাল ডেইরি ফার্ম!

ডেইরি খামারে ম্যাস্টাইটিস থেকে বাঁচার ১০ উপায়

পোল্ট্রি ও ডেইরি শিল্প স্থাপন করতে চাইলে কর অব্যাহতি

খামারে তাপমাত্রা ও সুস্থতা বিষয়ে নওগাঁ জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ল্যবরেটরি অ্যাটেনডেন্ট আতাউর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, খামারে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে পশু-পাখি সুস্থ থাকবে। মুরগির খামারে গরমে রক্তআমাশয় আবার ডেইরি খামারে গরুর হার্ডবিট বেড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হয়। স্টোক করে পোল্ট্রি জাতীয় জীব জলদি মারা যায়। আমি বিভিন্ন খামারে সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি- স্টিলের শীটের চাইতে সিমেন্ট শীটের ঘরে তাপ কম হয়। আর আনোয়ার সিমেন্ট শীট এখন বেশিরভাগ খামারেই লাগাচ্ছেন খামারিরা। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে খুব ভালো কাজ করে বলে খামারিরা বলছেন। মুরগি বা গরু যদি মারা যায় তাহলে খামারে লাভের চিন্তাও করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে সিমেন্ট শীটের পরামর্শ দিই আমরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা: বেনজির আহম্মেদ এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে জানান, উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে হাঁস, মুরগি খামারি ও বাড়িতে পালনকারীদের নিয়মিত পরামর্শ সেবা দেওয়া হচ্ছে। যেকোন প্রয়োজনে তারা ফোন করলে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আবার সরাসরি খামারে গিয়েও নিয়মিত সহযোগিতা করা হচ্ছে। আনোয়ার সিমেন্ট শীটের বিভিন্ন এড ও প্রচারণা চালাচ্ছে হয়ত এ কারণে বেশিরভাগ খামারি ব্যবহার করে থাকতে পারে। ততে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে সিমেন্টের শীট ব্যবহার করতেই বলা হয় কারণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। রোগ বালাই কম হয়।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ