জেলা প্রতিনিধি, রাজশাহী এগ্রিকেয়ার২৪.কম: রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বিদিরপুর গ্রামের ড্রাগন চাষি হেদায়েতুল ইসলাম। গাছের সাথে করছেন অভিনব কৌশল। তার কৌশলের মারপ্যাঁচে ড্রাগন গাছকে বোঝানো হচ্ছে ১৮ ঘণ্টায় দিন!

গাছের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চালু রাখার জন্য নিয়েছেন বৈদ্যুতিক বাতির সাহায্য। আগাম ফুল পেতে ড্রাগন গাছের সঙ্গে এমন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। বিকেল ৫টার দিকে বাল্ব জ্বালিয়ে দিলে রাত ১০টা পর্যন্ত একটানা আলো পড়ে গাছের উপর। মাঝে দিনশেষে রাত নেমে এলেও গাছ টের পাচ্ছে না। আবার ভোরের আলো ফোটার আগে ৫টার দিকেই বাল্বগুলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। তখন গাছ ভাবে, সূর্য উঠে গেছে। ভোর ৬টার দিকে যখন প্রকৃতই সূর্যের আলো ফোটে তখন বাল্বগুলো বন্ধ করা হয়। এভাবে গাছকে ছয়ঘণ্টা দিন বড় দেখানো হচ্ছে।

যে অংশে আলো জ্বালানো হচ্ছে, সেখানে ইতোমধ্যে দু’একটি করে ফুল আসতে শুরু করেছে। জমির অন্য অংশে যেখানে বাল্বের ব্যবস্থা করা হয়নি সেখানে এখনও ফুলের দেখা মেলেনি।

ড্রাগন চাষি হেলাল বলছেন, সন্ধ্যা নামার পর গাছ তার সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দিন বড় থাকলে গাছ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া চালু রাখে। গাছ যত বেশি খাদ্য গ্রহণ করে ততবেশি বেড়ে ওঠে। ফুলও ফোটে তাড়াতাড়ি। তাই এই কৌশল।

ঢাকা, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন নগরী সবুজায়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ করেন গোদাগাড়ীর উদপুর এলাকার হেলাল। গড়ে তুলেছেন ‘গ্রীণ ওয়ার্ল্ড বসন্তপুর’ নামে প্রকল্প। পেশায় সবুজায়নকর্মী হলেও বিদেশী ফলের পরীক্ষামূলক চাষাবাদ শুরু করছেন। গড়ে তুলেছেন ১২ বিঘা জমিতে ড্রাগন বাগান।

দুবছর আগে হেলাল সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে করেন ড্রাগনের বাগান। সেই জমি থেকে গেল বছর সাড়ে ১৩ মেট্রিক টন ড্রাগন বিক্রি করেছেন।তার বাগানে ড্রাগন ছাড়াও রয়েছে ভিয়েতনামের আতা, ক্যাপসিকাম, অ্যাবোকাডো, গুজরাটি খেজুর, মাল্টা ইত্যাদি ফল।

গত বছর চারটি বাল্ব দিয়ে আলোর জ্বালিয়ে আগাম ফলন পাওয়ার পরীক্ষাটা চালিয়েছিলেন তিনি। দেখা গেছে, এসব গাছে ফুল ফুটেছে একমাস আগে। তাই এবার আরও বড় পরিসরে এই আলোর ব্যবস্থা করেছেন হেলাল। তবে এটিকে পরীক্ষামূলকই বলছেন হেলাল।

গত বছর ৫ ফুট পরপর চারটি বাল্ব ব্যবহার করেন হেলাল। ফুলও এসেছিল আগে। কিন্তু দিনে আবার রোদ বেশি থাকায় নিষিক্ত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে ফুলগুলো। এবার দিনে সূর্যের তাপ কম। তাই পরীক্ষামূলক এই পদ্ধতিতে আগাম ফল পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হেলাল। তিনি এখন

হেলাল এবার প্রায় ৫ কাঠা জমিতে মোট ২৬০টি বিশেষ এই বাল্ব বসিয়েছেন। ১৫ ওয়াটের এই বাল্বগুলো আনা হয়েছে চীন থেকে। এগুলো কৃষিকাজের জন্যই বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। প্রতিটি বাল্বের দাম পড়েছে ৪৭০ টাকা। ৩ হাজার ৬০০ রঙের আলো দিতে সক্ষম এই বাল্বগুলো। গত দুই মাস ধরে বাল্বগুলো জ¦ালিয়ে দেয়া হচ্ছে। চলবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্যের আলোর সাথে বিকিরিত হয় দেড় লাখেরও বেশি রঙ। যা গাছেদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। আর এই বাল্বগুলো রঙ ছড়ায় ৩ হাজার ৬০০ ধরনের। আলোর রঙ সূর্যের রঙের মতোই। তাই সূর্যের আলোর বিকল্প হিসেবে এই বাল্বগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে। এই আলো গাছকে সজাগ ও বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে পুরোপুরি না হলেও বেশ সহায়ক হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গাছের জীবন আছে তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। ফলে সূর্যের আলো চলে যাওয়ার পরে গাছ সালোকসংশ্লেষণসহ অন্যান্য কার্যক্রম থামিয়ে দিতে পারে। এতে ঝিমিয়ে পড়বে গাছের বৃদ্ধি। বিলম্বিত হবে ফুল ফোটা। তাই আলো সরবরাহ করা হচ্ছে। যেন গাছ ১৮ ঘন্টা তার কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। এতে গাছের বৃদ্ধি ত্বরাণি¦ত হবে। কাঙ্খিত সময়ে মিলবে ফুল। তবে শতভাগ সফল হবেন এমনটা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না উদ্যোক্তা হেলাল।

তিনি বলেন, আমরা গতবছর চারটা বাল্ব দিয়ে পরীক্ষাটা চালিয়েছিলাম। পার্থক্য লক্ষ্য করেছি। এবার পরিধি বাড়িয়েছি। সফলতা কতটুকু আসবে তা এখনই বলতে পারছি না। এটাকেও আমরা পরীক্ষামূলকই বলছি। হেলাল বলেন, আলো জ¦ালিয়ে দিনের সমাপ্তিটা আড়াল করা হচ্ছে গাছের কাছে। যাতে করে গাছ তার কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে না নেয়, ঠিকভাবে চালিয়ে যায় সালোকসংশ্লেষণসহ অন্যান্য কার্যক্রম। তাহলে তাড়াতাড়ি ফুল আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। আর এক মাস আগেই যদি ফুল ফোটে, ফলও বিক্রি হবে একমাস আগে। তখন দাম বেশি পাওয়া যাবে ফলের। বেশি মুনাফা করার আশায় এই প্রযুক্তির প্রয়োগ।

তিনি জানিয়েছেন, সাধারণত ড্রাগন গাছে ফুল আসে এপ্রিল মাসে। জুন থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে ফল পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সময়টা কমিয়ে মার্চেই আগাম ফুল আনার চেষ্টা চলছে আলোর মাধ্যমে। কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এই প্রক্রিয়াটা একেবারেই ভুল নয়। আলোর মাধ্যমে গাছকে দিন বড় দেখানোর প্রক্রিয়া অকার্যকরও নয়। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখা রয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামছুল হক বলেন, বাল্বগুলো বিশেষভাবে তৈরি। সেগুলো সূর্যের আলোর মতো আলো দেয়। তাই গাছ মনে করে, এখনও রাত হয়নি। তিনি বলেন, এখন দিন ছোট। কিন্তু ড্রাগনের ফুল আসতে লম্বা দিনের প্রয়োজন। এই বাল্বের মাধ্যমে দিনটাকে গাছের কাছে লম্বা করা হয়। বাইরের দেশে এটা প্রচলিত প্রযুক্তি। আমাদের এখানে নতুন। আমি নিজে হেলালের ড্রাগনের বাগান ঘুরে এসেছি। আমরা আশা করছি, তিনি সফল হবেন।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ