মামুনার রশীদ, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: সর্ব উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা দিনাজপুরের রয়েছে নিজস্ব গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্য যা একান্তই নিজের। আজকে দিনাজপুরের কাটারীভোগ ধান যেকারণে বিখ্যাত সে বিষয়ে জানাব:-

এখানকার অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি কৃষি হওয়ায় নানা রকমের ফসলের চাষ হয়ে থাকে এখানে। কাটারী ভোগ ও কালিজিরা ধান, সুগন্ধি ধানের ধবধবে সাদা চিড়ে, সুমিষ্ট আম, লিচু উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত  জেলা। উৎপন্ন কাটারী ভোগ ও কালিজিরা ধান দেশ ও বিদেশে ব্যাপক ভাবে সমাদৃত। এছাড়াও এখানে গম, ভুট্টা, আলু, বেগুন, টমেটো প্রভৃতি ফসলের চাষাবাদ হয়ে থাকে।

দিনাজপুরের নিজস্ব ঐতিহ্য কাটারিভোগ ধান । এ ধান থেকে উৎপন্ন চাল যেমন সুগন্ধি যুক্ত তেমনি খেতেও সুস্বাদু। কাটারী ভোগ ধানের চাষাবাদের আবাদের সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও বিভিন্ন তথ্যে দেখা যায়, কাটারিভোগ দিনাজপুরের আদি ও অকৃত্রিম ধান। ধারনা করা হয়, একশ বছর আগে থেকেই দিনাজপুর জেলায় সুগন্ধি কাটারিভোগের চাষাবাদ হয়ে আসছে।

কাটারী ভোগ ধান দেখতে অনেকটা ছুরির মত, ছুরি যেমন মাথার দিকে চোখা ও একটু খানি বাঁকা ঠিক তেমনি। কাটারিভোগের চাল অনেকটাই সুগন্ধীযুক্ত। কাটারি ভোগের চিড়া হালকা ধবধবে সাদা রং ও মিষ্টি গন্ধ হওয়ার সবার কাছে খুবই জনপ্রিয়। কাটারীভোগ চাল সুগন্ধিয়ুক্ত হওয়ায় পোলাও হিসেবে রান্না করা হয়। এছাড়াও এ চাল দিয়ে তৈরি হয় বিরিয়ানি, খিচুড়ি, খির-পায়েস, ফিরনি ও জর্দা। গ্রাম বাংলার প্রাচীন রীতি অনুযায়ী, নতুন অতিথিদের এই সুগন্ধি যুক্ত চালের তৈরী খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা।

পড়তে পারেন: আতব ধানের শীষ মরা রোগে দিশেহারা কৃষক

কাটারিভোগ চাল সম্পর্কিত এক মজার গল্প আছে, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর দরবারে দিনাজপুরের রাজা প্রাণনাথকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। এই রাজার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ ছিল। স্বাভাবিকভাবেই একজন সম্রাটের সঙ্গে দেখা করার সময় যে কেউই কিছু উপঢৌকন নিয়ে যায়। রাজাও সম্রাটকে খুশি করার জন্য হীরা, পান্না, স্বর্ণমুদ্রার সাথে কাটারিভোগ চাল নিয়ে যান। সম্রাট আওরঙ্গজেব উপঢৌকন হিসেবে পেয়ে যতটা না খুশি হয়েছিলেন, তার থেকে বেশি খুশি হয়েছিলেন কাটারিভোগ চাল পেয়ে। দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার করার বদলে সম্রাট প্রাণনাথকে ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

দিনাজপুরের মাটি বেলে-দোআঁশ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে জেলাটির অবস্থানের কারণে নানা ধরনের ফসলের চাষাবাদ হয় ।উঁচু বেলে-দোআঁশ মাটি কাটারিভোগ চাষের জন্য খুবই উপযোগী।অবাক করার বিষয় এই যে, কাটারিভোগ ধান পৃথিবীর অন্য কোন অঞ্চলে তো দূরের কথা, বাংলাদেশেরই অন্য কোন জেলায় রোপণ করলে এই কাটারীভোগের ঘ্রাণ ও স্বাদ বদলে যায়। এমনকি দিনাজপুরের সব এলাকাতেও কাটারিভোগ ধান চাষাবাদ হয় না।

পড়তে পারেন: ধানের ব্লাস্ট রোগ ও প্রতিকার

দিনাজপুর সদর উপজেলার ফাশিলাহাট, ছোট বাউল, বড় বাউল, করিমুল্যাপুর, খানপুর, চিরিরবন্দর উপজেলায় কাউগাঁ, বিষ্টপুর, তালপুকুর মুকুন্দপুর, দুর্গাডাঙ্গা, ভিয়াইল, পশ্চিম বাউল ও কাহারোল উপজেলার দু-একটি উঁচু জায়গায় এ বিশেষ জাতের ধান চাষ হয়। উঁচু বেলে-দোআঁশ মাটি কাটারিভোগ চাষের উপযোগী হওয়ায় একশ বছর ধরে এই জেলায় ঐতিহ্যবাহী পণ্য হিসেবে পরিচিত হয়ে আসছে ও চাষাবাদ করা হচ্ছে। সুগন্ধি যুক্ত ধান উৎপাদনের জন্য মোট আবাদকৃত জমির পরিমাণ প্রায় ৪০৭৬৫ হেক্টর এবং এখানে চাল উৎপাদন প্রায় ৮৫৪০৬ মেট্রিক টন।

আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন, ন্যায্য দাম না পাওয়া, সার ও কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধি, কঠোর পরিশ্রম দেওয়ার ফলেও এ ধানের ফলন অন্যান্য ধানের তুলনায় কম হওয়ায় ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কাটারিভোগ প্রায় বিলুপ্ত পথে। কৃষকদের কাটারিভোগ চাষে উৎসাহ না জোগালে অদূর ভবিষ্যতে দিনাজপুর জেলায় এর চাষাবাদ থাকবে না। ভেজালের এই যুগে দিনাজপুরের ঐতিহ্য সুগন্ধিযুক্ত কাটারীভোগ ধানের চাষাবাদ হারিয়ে যাবে চিরতরে।

জানা গেছে, বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে কাটারিভোগ ধানের চাষাবাদ ফিরিয়ে আনতে উচ্চ ফলনশীল সুগন্ধি ব্রি ধান-৭০ এর চাষ শুরু হয়েছে। কৃষকদের আশার আলো দেখিয়ে আশাতীত ফলন পাওয়া গেছে। ফলন দেখে কৃষকেরা এ ধান চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

দিনাজপুরের কাটারীভোগ ধান যে কারণে বিখ্যাত লেখাটি লিখেছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের  কৃষি অনুষদের  শিক্ষার্থী মামুনার রশীদ।
এগ্রিকেয়ার/এমএইচ