গাভীকে কোন সিমেন ব্যবহার

মো. শাহ এমরান, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বাড়িতে দু-একটা গাভী থাকলে সবসময় কৃষক চিন্তা করেন শতভাগ ফ্রিজিয়ান বা অন্য জাতের কোন বীজ ব্যবহার লাভজনক হবে? আসলে গাভী থেকে কত শতাংশ ঐ জাতের বাচ্চা পাওয়া যাবে তা জানা প্রয়োজন। প্রচলিত পদ্ধতিতে গাভীকে সিমেন ব্যবহার কতটুকু ঠিক করেন তা নিয়েই আজকের আলোচনা।

আমাদের দেশে খামারগুলোতে ফ্রিজিয়ান ক্রস ব্রিড, শাহীওয়াল-সিন্ধি ক্রস ব্রিড ও কিছু দেশী গাভী পরিলক্ষিত হয়। তবে বাণিজ্যিক খামারগুলো সাধারনত ফ্রিজিয়ান ক্রসব্রিড গাভীগুলোই লালিত পালিত হয়।

আমরা খামারে কোন সিমেন ব্যবহার করবো এই বিষয়ে কোন গাইড লাইন নেই। খামারির যার যা পছন্দ সেই মোতাবেক সিমেন ব্যবহার করা হয়, আবার কেউ কেউ এ আই কর্মী যা পরামর্শ দেয় সেই মোতাবেক সিমেন বা বীজ ব্যবহার করে।

পড়তে পারেন: গরুর নতুন খামারের জন্য বকনা ও গাভীর প্রাপ্তিস্থান-মূল্য

এটা যে কত বড় একটি ভুল যা চিন্তার বাইরে। অথচ আমাদের এই বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল, সর্বাধিক বিনিয়োগ করা উচিত ছিল এবং সর্বাধিক সতর্ক থাকার কথা ছিল যা আমরা করিনা এবং আমি বলবো এই কারনেই আমরা অনেকে খামার করে জাত উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেদের উন্নয়ন ঘটাতে পারিনা৷

আমরা খুঁজি কোথায় ভাল দুধের গাভী আছে, অথচ আমরা একবারের জন্য ভাবিনা আমাদের নিজেদের খামারে ভাল গাভী তৈরী করতে কি করা প্রয়োজন।

আমরা লাখ লাখ টাকা খরচ করি একটি ভাল দুধের গাভী কেনার জন্য অথচ একটি ভাল সিমেনের জন্য অর্থ ব্যায় করতে কার্পন্য করি। একটি ভাল সিমেন একটি ভাল বাচ্চা তৈরী করে দেবে আপনাকে আর এই বাচ্চাটি হবে আপনার খামারের ভবিষ্যত।

বাছুর সাদা রংয়ের হয়েছে এতেই অনেকে খুশী আবার অনেকে ভাবে সাদা রং মানেই হলো অষ্ট্রেলিয়ান এগুলো হলো জাস্ট একেবারে মূর্খতা ও বোকামী। এরপর দেখা যায় ৩ বছর লালন পালনের পরে সেই বাচ্চা যখন বড় হয় দুধ দেয়া শুরু করে তখন খামারিরা মাথায় বাজ পড়ে।

পড়তে পারেন: গাভীর দুধ উৎপাদন বাড়ানোর বিশেষ কৌশল

কারন খামারি হয়তো সাদা বাচ্চা রংয়ের বাচ্চা দেখে ভেবেছিল এর দুধ প্রদানের সক্ষমতা হবে ২০ (+) লিটার, কিন্তু দেখা গেলো দুধ পাওয়া গেল ৭ লিটার! এইতো গত মাসে বগুড়ার এক খামারির দুঃখ ও আক্ষেপের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

একটি নতুন নামকরা প্রাইভেট কোম্পানীর সিমেন ব্যবহার করেছিল, কিন্তু ভরাডুবি হয়েছে তার খামারে। ১০ টি বাচ্চার মধ্যে মেয়ে বাচ্চা এসেছিল ৭টি যেগুলো বড় হয়ে দুধ প্রদান করছে ৮/৯ লিটার, অথচ সেই বাচ্চাগুলো মা’র দুধ প্রদানের সক্ষমতা ছিল ১৮-২০ লিটার। তবে প্রশ্ন হলো কেন হলো এমন ঘটনা! এমন অনেক অনেক প্রশ্নের উত্তর আমরা জানার চেস্টা করবো আজকের এই লেখার মধ্যে থেকে।

বাংলাদেশে হাতগোনা ৩/৪ টা বা খুব অল্প কয়েকটা খামার আছে যেখানে শুরু থেকে সঠিকভাবে রেকর্ড কিপিং এর মাধ্যমে জাত উন্নয়নের কাজ করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে নেই বললেই চলে।

পড়তে পারেন: গাভীর ম্যাস্টাইটিস থেকে বাঁচার কয়েকটি উপায়

তবে এখন অনেকে রেকর্ড কিপিং করছে কিন্তু তারা কি জানে যে গাভীগুলো কিনে তারা খামার শুরু করেছে সেগুলোর রেকর্ড কি? রেকর্ড মানে সেগুলোর জাত কি, কোন বুলের বাচ্চা, গাভী মা-বোন-খালা কত লিটার দুধ দিতো, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি তথ্য। কিছুই কি জানে? না, খামারি কিছুই জানেনা।

খামারিরা রেকর্ড রাখা শুরু করেছে তার এই গাভীকে কি সিমেন দিচ্ছে, কবে টিকা দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি৷ হ্যাঁ নিসন্দেহে ভাল উদ্যোগ তবে কাজটা পারফেক্ট হলোনা। এই খামারি তার কোন গাভীকে কোন সিমেন দিবে, কত পারসেন্টের ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনের সিমেন দেবে এটা সে কি করে হিসাব করবে এর সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারবেনা কারন আমাদের পূর্বের কোন রেকর্ড নেই, সব হযবরল অবস্থা।

আমরা অনেকে মনে করি গাভীর সাদা রংয়ের গায়ের রং হলে হাই পারসেন্টেজ, আবার অনেকে মনে করি ২০/২৫ লিটার দুধ দিচ্ছে তাই হাই পারসেন্টেজের ফ্রিজিয়ান। এসব একেবারেই ভুল ধারনা।

পড়তে পারেন: এক গাভীর ৩ বাচ্চা প্রসব, অবাক প্রাণিসম্পদ দপ্তর

আমেরিকাতে ১০০% ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনের সর্বনিন্ম দুধ প্রদানের সক্ষমতা এভারেজ ৩৯ লিটার। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপ দেশগুলোতেও অনেকেটা একই রকম। আবার আমাদের দেশে ১০০% ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনের বুলের মেরিট ১৪ লিটার!! হাহাহা, কি বুঝলেন এই হলো বাংলাদেশের ১০০% ফিজিয়ান ব্লাড লাইন।

যাইহোক, ১০০% হলেই যে দুধ বেশী দেবে এমন একটা ধারনা আমাদের কাজ করে। ব্যাপারটা আসলে এমন নাও হতে পারে।

৫০% বা ৭৫% ব্লাড লাইনের একটি গাভী ৪০ লিটার দুধ প্রদানের সক্ষমতা নিয়ে আসতে পারে। যেমনঃ আপনার একটি দেশী গাভী ৫ লিটার দুধ দেয়। এই গাভীকে যদি আপনি ৬০ লিটার কৌলিক গুন সম্পন্ন ১০০% ব্লাড লাইনের বুলের সিমেন দেন তাহলে যে বাচ্চা আসবে সেটা (২.৫+৩০)=৩২.৫০ লিটার দুধ দেয়া সম্পন্ন হতে পারে যার ফ্রিজিয়ান পারসেন্ট হলো মাত্র ৫০%।

এবার এই ৫০% ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনের গাভীকে যদি আবার ১০০% ফ্রিজিয়াম ব্লাডের ৬০ লিটার কৌলিক গুন সম্পন্ন সিমেন দেন তাহলে আপনি (১৬.২৫+৩০) = ৪৬.২৫ লিটার কৌলিক গুন সম্পন্ন বাচ্চা পেতে পারেন যার ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইন হলো ৭৫%।

তাহলে আমরা তো অনেকে ২০-২৫ লিটার দুধ দেয়া গাভীকে ১০০% বলে থাকি! কি থাকি কিনা? এসব একেবারেই ভুল তথ্য যা অনুমান নির্ভর৷ বিজ্ঞান কখন অনুমান নির্ভর কাজ করেনা এটা আপনাকে সব সময় খেয়াল রাখতে হবে।

পড়তে পারেন: মায়ের দেওয়া গাভী থেকে কোটিপতি আরাফাত

তাই চট করে খেয়াল খুশীমত আমরা যারা গাভীর দিকে তাকিয়ে পারসেন্ট বলে দিচ্ছি এই কাজটা না করাই ভালো। অতীতের কিছু আর্টিকেল পড়ে জেনেছিলাম যে পিওর টু পিওর ব্লাড লাইনের ক্রস ব্রিড থেকে সর্বচ্চ ভাল রেজাল্ট পাওয়া যায়।

অর্থাৎ পিওর দেশীর ব্লাড লাইনের সাথে পিওর ১০০% ফ্রিজিয়ান ক্রস করলে বা পিওর শাহীওয়াল/গীরের সাথে পিওর ১০০% ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনের ক্রস করালে সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট পাওয়া যায়।

আছে কি আপনার আমার খামারে এই পিওর কোন ব্রিড? নেই, তাহলে যে সিমেন দিচ্ছেন একেতো আপনি জানেন না সিমেনের কৌলিক গুনাগুন কি, অন্যদিকে আপনার খামারের গাভীর কি রেকর্ড সেটাও জানেন না। কিভাবে আপনার খামারের জাত উন্নয়ন হবে? এটা অসম্ভব, কোনদিন হবেনা।

এখন তাহলে কি করবো আমরা? সব গরু ডেস্ট্রয় করে দিবো, এটা কি সম্ভব! না এটা সম্ভব নয়, তাই আমাদের যা আছে সেটারই একটা স্টান্ডার্ড ধরে আগাতে হবে আন্দাজের উপর৷

পড়তে পারেন: গাভীর ওলান ফোলা রোগের লক্ষণ, প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

১২-১৯ লিটার দুধ দেয়া গাভীকে ৫০% ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইন, ২০ থেকে ২৮ লিটারকে ৭৫% ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইন এবং ২৯-৩৪ লিটারের গাভীকে ৮৭.৫% ব্লাড লাইনের ফ্রিজিয়ান ও তার উপরের হলে ১০০% ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনের ধরে আগানো যেতে পারে।

প্রশ্ন হলো এই স্টান্ডার্ডের জন্য কোন সিমেন এবং কত পারসেন্ট ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনের সিমেন ব্যবহার করবেন আপনি।

একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলি তা হলো, যে বুলের বা পারসেন্টেরই সিমেন ব্যবহার করেন না কেন আপনাকে অবশ্যই অবশ্যই জানতে হবে সেই বুলের জেনেটিক্স মেরিট কি আছে। অর্থাৎ সেই বুলের জেনেটিক্সে দুধ প্রদানের সক্ষমতা কেমন। এই বিষয়ে সর্বাধিক খেয়াল দিতে হবে আমাদের।

সে ক্ষেত্রে আমরা যদি এমন কোন ক্রসব্রিড সিমেন পাই যেখানে দেখি ফ্রিজিয়ানের ব্লাড লাইন কম এবং দুধের আধিক্য বেশী আমরা চোখ বন্ধ করে সেই সিমেনকে বেছে নেবো। এই টাইপের ক্রসব্রিড ভাল সিমেন ওয়ার্ল্ড মার্কেটে পাওয়া কঠিন।

তবে আপনি আমদানীকৃত ১০০% ফ্রিজিয়ান হাই মেরিটের ব্লাড লাইনের সিমেন পাবেন। এই সিমেন আপনি আপনার ৫০% ক্রসব্রিড ও ৭৫% ক্রসব্রিডকে দিতে পারেন অনায়াসে ভাল গাভী তৈরীর জন্য। তবে ৮৭.৫% কে না দেয়াই ভালো কারন হাই ফ্রিজিয়ান পারসেন্টের ব্লাড লাইন এদেশে সাস্টেইন করা কঠিন হবে।

পড়তে পারেন: দেশে নতুন প্রযুক্তিতে যেভাবে জমজ বাছুর জন্ম দেবে গাভী

আমাদের যাদের খামারে ৩৫ লিটারের দুধের গাভী আছে যেগুলোকে আমরা ৮৭.৫% ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনের ধরি প্রশ্ন হলো এদেরকে কোন সিমেন আমরা ব্যবহার করবো? হ্যা এদেরকে আবারো ১০০% ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইন দেয়া ঠিক হবেনা কারন আমাদের দেশের হট এন্ড হিউমিড ওয়েদারে ১০০% ফ্রিজিয়ান সাস্টেইন করানো ডিফিকাল্ট। আমি নানারকম আর্টিকেল ও জার্নালে পড়ে দেখেছি এই টাইপের গাভীকে সাধারনত ক্রস ব্যাক করলে সর্বাধিক ভাল ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

প্রশ্ন হলো কোন ব্রিডের সাথে আপনি ক্রস ব্যাক করবেন এই হাই পারসেন্টের ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনকে। দেখা গেছে এই ক্ষেত্রে পিওর হাই মেরিটের ১০০% জার্সি বা ফ্লেকভি দিয়ে যদি ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইন ক্রস ব্যাক করা যায় খুব ভাল রেজাল্ট পাওয়া যায়।

আমাদের অনেকের ধারণা বা পরামর্শ দেই দেশী গাভীকে ১০০% পিওর ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনের সিমেন দেয়া যাবেনা, এটা ঠিক নয়। দেশী গাভী যদি একটু বড় সাইজের পাওয়া যায় বা শাহীওয়াল/গীর পাওয়া যায় অনায়াসে ১০০% ফ্রিজিয়ান ব্লাড লাইনের সিমেন দিতে পারেন আপনি যা থেকে অত্যান্ত ভাল ফলাফল পেতে পারেন।

ছোট কথায় হাই পারসেন্ট নয়, আমরা হাই মেরিটের বুল চাই। এই হাই মেরিট আপনাকে যাচাই বাছাই করতে হবে।

বাংলাদেশের সরকার ও প্রাইভেট বুল স্টেশন যারা সিমেন বিক্রি করে তাদের সিমেনের মান অত্যান্ত নিম্নমানের। ৩০০০ থেকে সর্বচ্চ ৫০০০ লিটার মেরিটের দুধ সক্ষমতার সিমেন তারা বিক্রি করে যা দিয়ে কোনভাবেই এদেশের খামারিদের ভাগ্য উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রতিনিয়ত খামারিদের ঠকিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় যার কোন জবাবদিহিতা পর্যন্ত নেই।

তবে হ্যাঁ, সরকারের ২/৩ টি ভাল বুল ছিল অতীতে, এখন আর সেগুলো পাওয়া যায়না। যার কারনে অতীতে সরকারী সিমেনে কিছু ভাল গাভী আমরা পেয়েছিলাম। দুঃখের বিষয়, আমাদের সরকার এখনও ভাল সিমেন খুজে জাত উন্নয়নের জন্য, আর পৃথিবী চলছে এমব্রায়ো তৈরীর মাধ্যমে দ্রুত জাত উন্নয়নের কার্যক্রম নিয়ে।

আমাদের সরকার এখনও ভাবতে পারেনা এমব্রায়ো এনে কিছু পিওর ব্লাড লাইন তৈরী করতে। একটা সিমেন দিয়ে জাত উন্নয়ন করতে লাগে ১০ বছর আর এমব্রায়োর মাধ্যমে সেটা করা সম্ভব ১ বছরে৷ অথচ সরকার কোটি কোটি টাকা খরচ করে নানা রকম প্রজেক্টে যা খামারিরা জানতেও পারে না এবং কোন সুফলও পায় না।

দেশী গাভীকে কোন জাতের বীজ ব্যবহার লাভজনক! লেখাটি লিখেছেন মো. শাহ এমরান, স্বপ্ন ডেইরি’র স্বত্বাধিকার ও তরুণ শিক্ষিত উদ্যোক্তা।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ