দেশের নয়া ফসল কাসাভা

চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা ও করণীয় ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বাংলাদেশের নয়া ফসল হিসেবে খুবই লাভজনক হতে পারে কাসাভা। দেশের নয়া ফসল কাসাভা চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য নিচে তুলে ধরা হলো।

রোগবালাই প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় ফসলটি চাষাবাদে বেশ সুফল মিলছে। মূলত কাসাভা উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলের আলুজাতীয় ফসল। পৃথিবীর প্রায় ২০০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে কাসাভা বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। গ্রামের মানুষ কাসাভার কন্দকে ‘শিমুল আলু’ বলে। গাছটির পাতা অনেকটা শিমুল গাছের মতো দেখতে বলেই হয়তো এরকম নামকরণ। রোগজীবানু ও পোকামাকড়ের আক্রমন প্রতিরোধ  এ ফসল সহজেই অনুর্বর জমি ও খরা প্রবন এলাকায় চাষ করা যায়।

পুষ্টিগুন: কাসাভায় সাধারনভাবে ৩০-৪০ ভাগ শর্করা, ১ থেকে ২ ভাগ প্রোটিন, এবং ৫৫-৬০ ভাগ জলীয় অংশ বিদ্যমান। আলুর তুলনায় কাসাভাতে দ্বিগুনেরও বেশী শর্করা থাকায় ইহা আলুর চেয়ে আনেক বেশী পুষ্টিকর।

যেখানে আলুতে ১৮ ভাগ শর্করার মাত্র ১৬.৩ ভাগ স্টার্চ হিসাবে থাকে সেখানে কাসাভার ৪০ ভাগ শর্করার ৯০ ভাগই স্টার্চ হিসাবে থাকে। এছাড়াও কাসাভাতে ক্রুড ফাইবার, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন ও ভিটামিন সি উল্লেখযোগ্য পরিমানে পাওয়া যায় ।

জাত: কাসাভার অনেকগুলো প্রচলিত ও উন্নত জাত রয়েছে। কৃষকরা খাবার ও বানিজ্যিক উদ্দ্যেশ্যের ভিত্তিতে জাত নির্বাচন করে থাকে। খাবারের জন্য অনেক অঞ্চলে মিষ্টি জাতের কাসাভা চাষ করা হয়।

ভারতে কাসাভার জনপ্রিয় হাইব্রিড জাতগুলো হলো M-4, H-97, H-165, H-226, H-1687, H-2304 I S-856। ইন্দোনেশিয়ায় ADIRA-1,2,3,4 থাইল্যান্ডে RAYONG-1,2,3,60 ফিলিপাইনে PR-C 13,24,62 এবং চীনে SC-201,205,124 জাতগুলো জনপ্রিয়।

নাইজেরিয়ায় TMS-3001, 30572, 50395, 30555 এবং কলম্বিয়ায় M.Col.-2215, 1684, M.BRA-5, 12 জাতগুলো উল্লেখযোগ্য ।

চাষ কৌশল: মাটি: উষ্ণ ও নাতিষিতোষ্ণ অঞ্চল কাসাভা চাষের জন্য উপযোগী। অনুর্বর পাহাড়ী মাটি কিংবা বালি মাটি যেখানে অন্য কোন ফসল ফলানো যায় না সেখানেও কাসাভা চাষ করা যায়। তবে এ ফসল জলাবদ্ধতা ও উচ্চ লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না ।

জলবায়ু: এটি একটি খরা সহনশীল ফসল। যেখানে ৬ মাস পর্যন্ত খরা বা শুষ্ক অবস্থা বিরাজ করে সেখানেও কাসাভা সহজে চাষ করা যায়। তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রীর সেন্টিগ্রেডের নিচে কাসাভা ভালো হয় না। উপযুক্ত তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। সমুদ্রপৃষ্ট হতে ২৩০০ মিটার উপরেও কাসাভা চাষ করা যায়।

বংশবৃদ্ধি: গাছ লাগানোর জন্য বীজ কিংবা কাটিং উভয়ই ব্যবহার করা যায়। বানিজ্যিকভাবে চাষের জন্য পরিপক্ক কান্ডের কাটিং ব্যবহার করা হয়। কাসাভা সংগ্রহের সময় সুস্থ্য সবল ও রোগমুক্ত কান্ডগুলো কেটে পরবর্তী বছর লাগানোর জন্য ছায়াযুক্ত স্থানে সংরক্ষন করতে হয়।

লাগানোর সময় কান্ডকে ১৫-২০ সেমি করে কেটে সোজা করে লাগাতে হবে। প্রতিটি কাটিং এ কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ টা নোড থাকতে হবে।

জমি তৈরি: সাধারনত জমিতে চাষের প্রয়োজন হয় না। তবে বানিজ্যিকভাবে চাষের জন্য জমি চাষ করা যেতে পারে। অধিকাংশ জায়গায় পিট তৌরি করে কাসাভার কাটিং বা সেট লাগানো হয়।

পাহাড়ী এলাকায় কাসাভা চাষ সহজ ও সুবিধাজনক পদ্ধতি। তবে পিটগুলো মাটি থেকে একটু উপরের দিকে উঠানো হলে ফলন ভালো পাওয়া যায়।

লাগানোর নিয়ম: প্রতি হেক্টর জমিতে ১০,০০০ গাছ লাগানো যায়। একটি গাছ থেকে অন্য গাছের দূরুত্ব ৭৫ থেকে ৯০ সেমি রাখতে হবে। কাটিং মাটিতে লাগানোর সময় ২০ সেমি মাটির নিচে এবং ৫ সেমি মাটির উপরে থাকতে হবে।

সাধারনত ১৫-২০ দিনের মধ্যে কাটিং থেকে নতুন কুশি বের হয়। যেসব কাটিং থেকে কুশি বের হবে না সেগুলো তুলে ফেলে সেখানে ৪০ সেমি আকারের নতুন কাটিং লাগাতে হবে।

লাগানোর সময়: সারা বছরই গাছ লাগানো যায়। তবে সাধারনত বর্ষার শুরুতে কাসাভার কাটিং লাগানো ভালো। আমাদের দেশে এপ্রিল থেকে মে মাস কাসাভা লাগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।

সার ব্যবস্থাপনা: তেমন কোন সার প্রয়োগ করতে হয় না। তবে বানিজ্যিকভাবে চাষের জন্য হেক্টর প্রতি ১৮০-২০০ কেজি নাইট্রোজেন, ১৫-২২ কেজি ফসফরাস এবং ১৪০-১৬০ কেজি পটাসিয়াম প্রয়োগ করলে সর্বাধিক ফলন পাওয়া যায়।

সেচ: সাধারনত সেচের প্রয়োজন হয়না। তবে কাটিং লাগানোর পর গাছ গজানোর জন্য ৩-৫ দিন অন্তর অন্তর কমপক্ষে ২ বার সেচ দিতে হবে। দীর্ঘদিন খরা অবস্থা বিরাজ করলে হালকা সেচের ব্যবস্থা করা যেতে পারে এতে ফলন বৃদ্ধি পায়।

আন্তঃপরিচর্যা: গাছ লাগানোর পর এক মাস অন্তর অন্তর গোড়ার আগাছা পরিস্কার করে গোড়ায় মাটি তুলে দিলে ফলন ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। যদিও কাসাভায় রোগবালাই ও পোকামকড়ের আক্রমন খুবই কম তথাপিও এক ধরনের মাকড়ের আক্রমনে অনেক সময় ফসলের ক্ষতি হয়ে থাকে।

সবসময় রোগবালাই ও পোকামাকড় মুক্ত কাটিং লাগাতে হবে এবং মাকড়ের আক্রমন থেকে ফসলকে রক্ষা করতে হলে আক্রমন দেখা দেবার সাথে সাথে মাকড়নাশক স্প্রে করতে হবে।

অনেকসময় ইঁদুর মাটির নিচের কাসাভা খেয়ে বেশ ক্ষতি সাধন করে থাকে। এজন্য বিভিন্ন ধরনের ফাঁদ ও বিষটোপ ব্যবহার করে ইঁদুর দমন করতে হবে।

ফলন: সাধারনত হেক্টর প্রতি ২৫-৩০ টন ফলন পাওয়া যায়। তবে ভালো ব্যবস্থাপনায় উন্নত জাত চাষ করলে হেক্টর প্রতি ৫৫ থেকে ৬০ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

গুদামজাতকরণ বা সংরক্ষণ: গুদামজাতকরনের সীমাবদ্ধতা কাসাভা উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। শরীরবৃত্তিয় ও অনুজীবিয় পরিবর্তন এবং বিভিন্ন প্রকার ছত্রাকের আক্রমনের কারনে দ্রুত পচনশীল কাসাভা সাধারনত গুদামজাত করে সংরক্ষন করা যায় না।

তবে উত্তোলন না করে গাছসহ মাটির নিচে রেখে দিলে কাসাভা নষ্ট হয় না। এজন্য কৃষককে তার প্রয়োজনমতো জমি থেকে কাসাভা সংগ্রহ করতে হবে এবং সংগ্রহের কয়েক দিনের ভিতরই ব্যবহার কিংব প্রক্রিয়াজাত করতে হবে।

আফ্রিকাতে কৃষকরা তাদের প্রয়োজন মতো ধীরে ধীরে জমি থেকে কাসাভা সংগ্রহ করে। অথবা কাসাভা সংগ্রহের পর টুকরো টুকরো করে রোধে শুকিয়ে সংরক্ষন করে থাকে। স্টার্চ উৎপাদনের জন্য কাসাভা সংগ্রহের কয়েকদিনের ভিতরই কারখানায় প্রেরন করতে হয়।

তবে আদ্র বালি কিংবা আদ্র কাঠের গুড়ার উপর কাসাভা রেখে দিয়ে ১০-১৫ দিন পর্যন্ত সংরক্ষন করা যায়। সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা যায়, ০.৪% থায়োবেনডাজল দ্বারা কাসাভা আলু শোধন করে পলিথিন ব্যাগে সংরক্ষন করলে কাসাভা তিন সপ্তাহ পর্যন্ত ভালো থাকে।

দেশের নয়া ফসল কাসাভা চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা শিরোনামের সংবাদটি কৃষি বাতায়ন থেকে নেয়া হয়েছে। লিখেছেন আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ, সহযোগী অধ্যাপক, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, আগারগাঁও।

আরও পড়ুন: কুলের ফল ছিদ্রকারী উইভিল পোকার ক্ষতির ধরণ ও দমনের কৌশল