মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: দেশের সবচেয়ে বড় সামুদিক শৈবালের খামার গড়ে উঠেছে রাজশাহীতে। ইউটিউবের ভিডিওতে আগ্রহী হয়ে শখের বশে সামুদিক শৈবাল চাষ শুরু করে এখন কোটি টাকার সপ্ন দেখছেন কলেজ শিক্ষক রাকিবুল ইসলাম পাপন।

বর্তমানে ৪ লাখ টাকা বিনিয়োগ থেকে দিনেই আয় হচ্ছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা! বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক শৈবাল স্পিরুলিনার খামার করছেন বলে দাবি রাকিবুলের।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার আমশো গ্রামের বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম। তিন মেয়েসহ পাঁচ জনের সংসার। পেশায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক হলেও অবসর সময়ে চলে কৃষি নিয়ে কারবার। বাড়তি আয় ও অবসর সময় কাটাতে নিজ উদ্যোগে বাড়ির আশেপাশে ফাঁকা জায়গায় গড়ে তুলেছেন পোল্ট্রি খামার, বায়োফ্লক প্রজেক্ট। এছাড়াও পুকুরে মাছের সাথে শুরু করেছেন মুক্তা চাষ। তাঁর ঝিনুক থেকে মুক্তা চাষের সাথে নতুন যোগ হয়েছে সামুদ্রিক শৈবাল “স্পিরুলিনা” চাষ। এখন পর্যন্ত যতগুলো প্রজেক্ট করেছেন সবচেয়ে বেশি লাভের মুখ দেখেছেন এই শৈবালেই।

সরেজমিনে দেখা যায়, স্বচ্ছ টিন ও কাঠের তৈরি বর্গাকার ঘর। মাত্র ২২ দিন আগে তৈরি ঘরে রয়েছে ৪০ ফিট দৈর্ঘ্য ও ২০ ফিট প্রস্থ বিশিষ্ট সিমেন্টের তৈরি দুটি পানির ট্যাংক। একপাশে পানির ফোয়ারা তৈরির জন্য চলছে বৈদ্যুতিক মর্টার। গাঢ় সবুজ রঙের পানিতে তৈরি হচ্ছে সমুদ্রের ন্যায় ফেনা। একদিকে কাপড়ে ছেঁকে ছেঁকে তোলা হচ্ছে কাঁচা সবুজ শৈবাল। সেখান থেকে তপ্ত রোদে শুকানো হচ্ছে এই স্পিরুলিনা।

শৈবাল চাষ বিষয়ে জানতে চাইলে রাকিবুল ইসলাম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ইউটিউবে চ্যানেল আই-এর এক অনুষ্ঠান সামনে আসে। তারপর আগ্রহ বাড়ায় ভারতে শৈবাল চাষ করে সফলতা পেয়েছে এমন কিছুু ভিডিও দেখি। বাংলাদেশে স্পিরুলিনা জাতের সামুদ্রিক শৈবাল চাষ হয় কি না খোঁজ করতে থাকি। জানতে পারি, কোটচাঁদপুরের ঝিনাইদহে দেলোয়ার এগ্রো ফার্মে চাষ হয় এই শৈবাল। সেখানে গিয়ে ৮ হাজার টাকায় প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসি। সাহস না পাওয়ায় প্রথমে প্লাস্টিকের বালতিতে ১০০ লিটার পানিতে পরীক্ষমূলক চাষ শুরু করি। সেখানে সফলতা পাওয়ায় বাণিজ্যিক চাষে নামি।

তিনি বলেন, গত ৪ জানুয়ারি বীজ হিসেবে শৈবালসহ ১৫ লিটার পানি জলাধারে দিই। এরপর কৃত্রিম উপায়ে ১৭ হাজার লিটার পানিতে এ শৈবাল বেড়ে উঠছে এখন। পানিতে সামুদ্রিক আবহ তৈরি করার জন্য ৯টি রাসায়নিক উপাদান মেশাতে হয়। জটিল এ প্রক্রিয়ায় সামান্য ভুল হলে শৈবাল উৎপাদন হবে না। পরিমাণমতো পটাশিয়াম ক্লোরাইড, পটাশিয়াম নাইট্রেট, সোডিয়াম নাইট্রেট, সোডিয়াম বাই কার্বনেট, খাবার লবন ( সোডিয়াম ক্লোরাইড)সহ মোট ৯টি উপাদান লাগে। এসব উপাদান একবার পানিতে মেশালে ৬ মাস আর মেশাতে হয় না। পানির গুণাগুণ প্রায় ঠিক থাকে।

সাড়ে ৪ লাখ টাকা খরচ করলেও প্রতিদিন ১৫ কেজি কাঁচা শৈবাল সংগ্রহ করা হচ্ছে। ১০ কেজি কাঁচা শৈবাল রোদে শুকালে ১ কেজি হয়। শুকনো শৈবাল প্রতিকেজি ৩ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আশা করছি ৩ মাসে সকল খরচ উঠে আসবে। একমাসে কতটাকা আসবে তা বলা যাচ্ছে না- মাসের তো আর শেষ হয়নি! যোগ করেন এই উদ্যোক্তা।

জানা যায়, স্পিরুলিনা একটি নীলাভ-সবুজ শৈবাল। এটি সাধারণত পানিতে জন্মে। তবে সামুদ্রিক শৈবাল হিসেবেই এটি বেশি পরিচিত। স্পিরুলিনা সাধারণত সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। এতে সব ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকায় একে ‘সুপার ফুড’ বলা হয়। এ শৈবালে মাছ ও গরুর মাংসের তুলনায় ৩ গুণ এবং ডিমের তুলনায় ৬ গুণ বেশি প্রোটিন রয়েছে। সয়াবিনের তুলনায় ২ গুণ বেশি মিনারেল রয়েছে। আটার চেয়ে ৪ গুণ বেশি ফাইবার বা খাদ্য আঁশ রয়েছে। এতে গাজরের তুলনায় ৫ গুণ ও পালং শাকের তুলনায় ৪০ গুণ বেশি ক্যারোটিন রয়েছে। দুধের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম রয়েছে। এতে পালং শাকের তুলনায় ৬৫ গুণ বেশি এবং গরুর মাংসের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি আয়রন থাকে। এটি পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি সবজি।

রাকিবুলের উৎপাদনকৃত স্পিরুলিনা কিনতে বেশ কয়েকটি ঔষুধ কোম্পানি আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বর্তমানে রাজশাহীতে উৎপাদিক স্পিরুলিনা যাচ্ছে ঝিনাইদহে। পাইকারি ৩ হাজার টাকা কেজিদরে কিনছেন “দেলোয়ার এগ্রো ফার্ম”। কথা হয় ফার্মের মালিক দেলোয়ার হোসেনের সাথে।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে আরো ২০ বছর আগে থেকে চাষ করা হয়। কিন্তু মিডিয়ায় সেভাবে আসেনি। ঢাকার বিএডিসি গবেষণাগারে এটি উৎপাদন হয়। রাজশাহীর তানোরে শিক্ষকের প্রজেক্ট আমিই নির্দেশনা দিয়ে করিয়েছি। ৫ কেজি হলে একবারে আমার কাছে বিক্রি করবেন বলে জানিয়েছেন। বিভিন্ন ফার্মাসিউটিক্যালসে এটি সাপ্লাই করা হয়।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি অফিসার মো: শামিমুল ইসলাম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, সামুদ্রিক শৈবাল চাষ করেছেন এটি শুনেছি। সাধারণত কৃষি বিভাগের কাজ এটি নয়। তারপরও কৃষক যেহেতু করেছে সেহেতু আমাদের দেখভাল থাকবে। কৃষক ইউটিউব দেখে এবং ঝিনাইদহ থেকে একটা ট্রেনিং নিয়ে চাষ করেছেন সামুদ্রিক শৈবাল। এতটুকু জানি।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ