মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: ধানের নাড়া আদিম কাল থেকেই গ্রামাঞ্চলে জ¦ালানি হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। কোন কোন চাষি আলুর জামিতে আলুর অঙ্কুরোদগমের জন্য নাড়া দিয়ে জাগ দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তবে, আধুনিক যুগে এসে আবিস্কার হচ্ছে নানা অজানা বিষয়। এই জ¦ালানির নাড়া সারের কাজ দিবে তা ধারনাও করতে পারেননি হয়ত কেউ কেউ। অথচ ধান গবেষণা ও কৃষি বিভাগের বিজ্ঞানীগণ বলছেন, রাজশাহী কৃষি অঞ্চলের ১৬ জেলায় ধানের নাড়ায় সাশ্রয় ৩০৬ কোটি টাকার সার!

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) রাজশাহী রিজিওনের কাজ হলো এ অঞ্চলে ধানের উন্নত জাত, চাষ পদ্ধতি ও কৃষকের সমস্যা সমাধানে কাজ করা। ধানের নাড়া বিষয়ে কথা হয় ব্রি রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. ফজলুল ইসলামের সাথে। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ধানের নাড়া কৃষকরা পুড়িয়ে ফেলেন। অনেচ চাষি লাঙ্গলের চাষ দিয়ে উপড়ে ফেলে তা ঝেড়ে-বেছে জমি ঝকঝকে তকতকে করেন। কারণ- আলুর জমিতে জঞ্জাল রাখতে চান না। কিন্তু এভাবে ফসল ফলানোর ফলে রাসায়নিক সারের প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়ছে। লাগাতার একই ধরনের ফসল চাষের ফলে দিন দিন মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। আমরা গবেষণা করছি, কী করে মাটিতে জৈব পদার্থ ফিরিয়ে দেয়া যায়। এরই অংশ হিসেবে উচ্চফলনশীল আমন ধানের জাত ব্রি ধান-৮৭ উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ ধানের গাছ অনেক লম্বা।

তিনি আরোও বলেন, ধান কাটার সময় লম্বা নাড়া রেখে কাটতে হবে। নাড়ায় যথেষ্ট পরিমাণে পটাশিয়াম, ফসফেট, নাইট্রোজেন ও জিপসাম রয়েছে। ধান কেটে নেয়ার পর নাড়া রেখে সেগুলো মাটিতে মিশিয়ে দিলে জমিতে এসব জৈব পদার্থ ফিরে আসে। এতে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। কৃষকের সারের খরচও বাঁচে।

নাড়া জমিতে পুড়িয়ে দিলে সারের উপকার পাওয়া যাবে কিনা এমন প্রশ্নে এই বিজ্ঞানী বলেন, নাড়া জমিতে পুড়িয়ে দিলেও সারের উপকার পাওয়া যাবে। সেক্ষত্রে জমিতে অসংখ্য উপকারী জীব বা অতিক্ষুদ্র উপকারী ব্যকটেরিয়া থাকে সেগুলো মারা যাবে। এতে কিছুটা ক্ষতি হবে। বরং নাড়া জমিতে রেখে চাষ দেওয়া ভালো।

২০০৩ সাল থেকে ধানের নাড়ায় সার সাশ্রয় নিয়ে গবেষণা করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ। বিভাগটির প্রধান ও ব্রির মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আমিনুল ইসলামের বলেন, এক মণ ধান উৎপাদনে কমপক্ষে দেড় কেজি ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম টিএসপি বা ডিএপি, ২ কেজি এমওপি, ৬০০ গ্রাম জিপসাম ও ১৪ গ্রাম দস্তা ব্যবহার হয়। আমন ধান কাটার সময় প্রতি বিঘা জমিতে ২০ সেন্টিমিটার উচ্চতার নাড়া রেখে পরবর্তী আবাদের সময় মাটিতে মিশিয়ে দিলে ৩ কেজি ইউরিয়া, ১ কেজি ৩৪০ গ্রাম টিএসপি, ৬ থেকে ৮ কেজি এমওপি ও ১ কেজি ৬০০ গ্রাম জিপসামের উপকার পাওয়া যায়।

চাষী পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়া ও টিএসপি ২২ টাকা, ডিএপি ১৭ ও এমওপি ১৫ টাকা দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। সেই হিসাবে প্রতি বিঘায় ২১৫ টাকা সারের খরচ বাঁচবে চাষীর। আর হেক্টরে বাঁচবে ১ হাজার ৬১৩ টাকা। এ হিসাবে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার ১৯ লাখ ৭৫৪ হেক্টর আমন খেতের নাড়ার মাধ্যমে ৩০৬ কোটি ৫৯ লাখ ১৬ হাজার ২০২ টাকার সারের খরচ বাঁচানো সম্ভব।

উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলা চারটি কৃষি অঞ্চলের আওতায়। কৃষি দপ্তরগুলোর তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে উত্তরাঞ্চলে ১৯ লাখ ৭৫৪ হেক্টর জমিতে আমন আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে ৪ লাখ ৪ হাজার ৮৫ হেক্টর, বগুড়ায় ৩ লাখ ৮২ হাজার ৪৫০, রংপুরে ৬ লাখ ১৫ হাজার ৯৯৪ ও দিনাজপুরে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ২২৫ হেক্টর জমিতে আমন চাষ হয়েছে। এখন চলছে রবি মৌসুম। প্রায় পুরো আমনের খেত এসেছে রবিশস্য চাষের আওতায়।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আমন চাষের পরপরই রবি মৌসুমে সারের একটি বড় অংশ যায় আলু চাষে। উত্তরাঞ্চলে চলতি মৌসুমে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮২ হেক্টর আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে ৭ হাজার ৭১৫ হেক্টর, বগুড়ায় ৯৮ হাজার ৯৫, রংপুরে ৯২ হাজার ৬৭২ ও দিনাজপুরে ৭৯ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হতে পারে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী, তানোর, মোহনপুর; নওগাঁ জেলার মান্দা, রানীনগর, আত্রাই এলাকাঘুরে দেখা গেছে এসব এলাকার কৃষকরা জমি থেকে নাড়া সরিয়ে ফেলছেন। ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা খরচ করে জমি থেকে নাড়া পরিস্কার করে নিয়েছেন কৃষকরা।

তানোর যোগীশহর এলাকার আব্দুর রাকিব এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, আমি প্রতিবছর ৩০ থেকে ৫০ বিঘা জমিতে আলু চাষ করি। প্রজেক্ট হিসেবে আলু চাষ করে স্টোরেজে রাখি। আলুর জমিতে বেশ কয়েকটি চাষ দিতে হয় ফলে নাড়া রাখা সম্ভব হয় না। জমি পরিস্কার করতে হয়। জমিতে নাড়া বেছে নিয়ে আগুন ধরিয়ে দিই। আবার অনেক সময় পোড়ানোর জন্য জ¦ালানি হিসেবে অনেকে নিয়ে যায়।

আলু চাষের সুবিধায় উত্তরের ১৬ জেলার ২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৮২ হেক্টর জমির নাড়া সরিয়ে ফেলছেন কৃষক। নাড়ার সঙ্গে প্রতি হেক্টরে ৪৯২ টাকার প্রায় ২৩ কেজি ইউরিয়া, ২২০ টাকার ১০ কেজি টিএসপি, ৯০০ টাকার ৬০ কেজি এমওপি ও প্রায় দেড়শ টাকার ১২ কেজি জিপসামের সমপরিমাণ সার হারিয়ে যাচ্ছে। সে হিসাবে পুরো উত্তরাঞ্চলে ইউরিয়া, টিএসপি ও এমওপিতেই হারাচ্ছে ৪৪ কোটি ৭৫ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দিনাজপুর অঞ্চলপ্রধান শাহ আলম এ বিষয়ে বলেন, আমন মৌসুমের পর আলুর জন্য জমি তৈরির সময় জমি পরিস্কারের জন্য নাড়া সরিয়ে ফেলেন কৃষকরা। কোদাল দিয়ে আলুর সারি করার সময় সমস্যা তৈরি যাতে না হয় সেজন্য তারা এমনটি করে থাকেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী অঞ্চল প্রধান শামছুল ওয়াদুদ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ধানের নাড়া জমিতে মিশিয়ে দেয়া গেলে জৈব পদার্থ যুক্ত হয়। নাড়া পোড়ালেও মিউরেট অব পটাশ যুক্ত হবে। কিন্তু নাড়া পোড়ানোর সময় মাটিতে বসবাস করা নানা ক্ষুদ্র অনুজীব মারা পড়ে। এক্ষেত্রে ভালো পরামর্শ হলো—চাষ দিয়ে নাড়া মাটির সঙ্গে মিলিয়ে দেয়া। এটি সম্ভব হলে রাসায়নিক সারের ব্যবহার অনেকাংশে কম হতো।

উত্তরের চার আঞ্চলিক কৃষি দপ্তরের হিসাবে ২০২২-২৩ মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ৭ লাখ ৭০ হাজার ৯৫৩ টন ইউরিয়া, ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৮৪০ টন টিএসপি, ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৮৫ টন ডিএপি ও ৮ লাখ ৮০ হাজার ২৬ টন এমওপি সারের চাহিদা রয়েছে। এসব চাহিদার বিপরীতে ধানের নাড়ায় ১৬ জেলায় যদি ৩০৬ কোটি টাকার সার সাশ্রয় সম্ভব হলে তা অভিনব ফল হিসেবেই বিবেচিত হবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ