জেলা প্রতিনিধি (নওগাঁ), এগ্রিকেয়ার২৪.কম: উত্তরের জেলা নওগাঁয় পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে চাষীরা। পাট চাষে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবং পানি সংকটে জাগ দেওয়া সমস্যার কারণে বছর বছর কমছে পাটের আবাদ। বর্তমান হিসেবে জেলায় পাট চাষে বিঘায় খরচ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার। তবে কৃষি বিভাগ বলছে কৃষকদের আগ্রহ বাড়াতে চাষীদের প্রনোদনাসহ সার্বিক সহযোগীতা প্রদান করা হচ্ছে।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে- চলতি ২০২২-২৩ অর্থ বছরে জেলায় ৫ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে পাটের আবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ৭২৫ হেক্টর। ২০২০-২১ অর্থ বছরে পাটের আবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ৯৩৩ হেক্টর। ২০১৯-২০ অর্থবছরে- ৬ হাজর ১৫০ হেক্টর এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬ হাজার ৯৩০ হেক্টর। গত ৫ বছরের ব্যবধানে পাটের আবাদ কমেছে ১ হাজার ৬০০ হেক্টর।

পড়তে পারেন: পাট নিয়ে বিপাকে উত্তরাঞ্চলের চাষিরা

জানা গেছে, এক বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করতে খরচ পড়ে ১০ হাজার থেকে ১৪ হাজার টাকা। এরমধ্যে জমির আইল ঠিক করা ৪০০ টাকা, পানি সেচ ১ হাজার টাকা, হালচাষ তিন টা ১ হাজার টাকা, সার ১২০০ টাকা, বীজ দেড়কেজি ৪০০ টাকা, কীটনাশক ও শ্রমিক খরচ ৫০০ টাকা, পোকা দমনে কীটনাশক খরচ ৭০০ টাকা। ঘাস নিড়ানিতে ৫-৬ জন শ্রমিকের খরচ ১৫০০-১৮০০ টাকা। এরপর পাট কাটতে ৫-৬ জন শ্রমিকের খরচ হিসেবে ২৫০০-৩০০০ টাকা, পরিবহণ খরচ ১৫০০ টাকা এবং জাগ দেওয়া ১৫০০ টাকা। সবশেষে ৬-৭ জন শ্রমিকের পাট পরিস্কারে খরচ পড়ে ৩০০০-৩৫০০ টাকা।

সরোজমিনে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে পানি সংকটের কারণে কৃষকরা পাট বিভিন্ন স্থানে রাস্তার পাশে, বাড়ির উঠোন, বিভিন্ন বাগানে গাছের সাথে ভীরা বেঁধে বেঁধে জমা রেখে দিয়েছে।

জেলায় এ বছর দেশী, তোষা এবং মেস্তা জাতের পাট চাষ হয়েছে। দেশী জাতের মধ্যে সিভিএল-১ ও ডি ১৫৪ জাত। তোষা জাতের মধ্যে ও-৪ এবং ৭২। উপজেলা ভিত্তিক পাট চাষ হয়েছে- সদর উপজেলায় ৬০০ হেক্টর, রানীনগরে ৪০ হেক্টর, আত্রাইয়ে ২৫০ হেক্টর, বদলগাছীতে ১ হাজার ৪৬০ হেক্টর, মহাদেবপুরে ২০০ হেক্টর, পত্নীতলায় ১৫০ হেক্টর, ধামইরহাটে ৮৩০ হেক্টর এবং মান্দায় ১ হাজার ৮০০ হেক্টর। জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় এ বছর কোন পাট চাষ হয়নি বলে জানায় কৃষি অফিস।

পড়তে পারেন: পাট জাগে পুকুর ভাড়া, বিঘায় গুণতে হচ্ছে দেড় হাজার!

একসময় পাটকে বলা হতো সোনালি আঁশ। তবে পাটের সে সোনালি ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে। পানি সংকটে জাগ দেওয়া সমস্যা, শ্রমিক সংকট ও মজুরি বেশি হওয়ায় এবং দাম না পাওয়ায় পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে চাষীরা। তবে উচু জমি ফেলে না রেখে বা অন্য ফসল না হওয়ায় বাধ্য হয়ে চাষীরা পাটের আবাদ করেছেন। এদিকে পাটের আবাদ কমে যাওয়ায় গত দু’বছর থেকে বেড়েছে পাটের দাম। এক বিঘাতে ৮-১২ মণ পাটের ফলন হয়। প্রতিমণ পাট গত বছর ২৪০০-৩০০০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন বলে জানান চাষীরা।

পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ানো বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। সচেতনতা বাড়ানো গেলে মানুষ পাটজাত দ্রব্য ব্যবহারের উৎসাহিত হবেন। এতে করে পরিবেশ যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি চাষিরা পাটের আবাদের দিকে ঝুঁকবেন।

মান্দা উপজেলার ভরট্ট শিবনগর গ্রামের পাটচাষী মোকসেদ বলেন, বিগত বছরগুলোতে ৩ বিঘা জমিতে ভেলি (দেশি) জাতের পাটের আবাদ করতাম। পানি সংকটে পাট জাগ দেওয়ার সমস্যায় এ বছর দেড় বিঘাতে আবাদ করেছি। এ বছর বৃষ্টি না হওয়ায় পাট চাষিদের জন্য বেশি সমস্যায় পড়তে হয়েছে। প্রায় তিন কিলোমিটার দুরে ট্রাক্টর দিয়ে পাট নিয়ে গিয়ে জাগ দিতে হবে। পরিবহন খরচ পড়বে দেড় হাজার টাকা। পাট কাটতে খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং ধোঁয়ার সময় খরচ হবে আরো ৪ হাজার টাকা।

পড়তে পারেন: রোদের তাপে পুড়ছে পাট, দিশেহারা কৃষক

তিনি বলেন, পাট চাষে শ্রমিকের মজুরি ও উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আবার দাম না পেয়ে লোকসান গুনতে হয়। প্রবাদ আছে- ‘পাটের টাকা পাটে (শ্রমিক) খায়’। প্রতি বিঘায় ৮-১৪ মণ পাটের ফলন পাওয়া যায়। আবার পাট কাঠি পাওয়া যায়। দেখা যায় সব মিলিয়ে আয়-ব্যয় সমান হয়। আমাদের শুধু কষ্টই করা হয়। এসব কারণে পাট চাষে আগ্রহ কমছে।

একই গ্রামের গোলাম মোস্তফা বলেন, দেড় বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। পাটের জমিতে ধান ভাল হয়। পাটের পাতা জমিতে পড়ে উর্বরতা বাড়ে। এতে করে সারের খরচও কম হয়। এ জমিতে বছরে তিনটা ফসল হয়। ধান, পাট, পিয়াজ, রসুন, আলু ও খিরা। এ জমিতে আগে খিরা চাষ করেছিলাম। এরপর পাট লাগিয়েছি। পাট তুলে আমনের ধান রোপন করা হবে। পাটের আবাদ করে লাভ না হলেও লোকসান হয় না। পাট কাঠিও কাজে লাগে। বলা যায় পাটকাঠি লাভ।

পড়তে পারেন: জাগ দেওয়া পাট থেকে চকচকে আঁশ পাওয়ার কৌশল

মান্দা উপজেলার আরেকজন পাটচাষি মমতাজ বলেন, পাটের আবাদ করতে বিঘাপ্রতি প্রায় ৫-৬ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু পাট কাটা, পরিবহন, জাগ দেওয়া ও পাট পরিস্কার করতে আরো ৬-৭ হাজার টাকা খরচ হয়। গত কয়েক বছর থেকে পাটের দাম পাওয়া যায়নি। কিন্তু গত দুই বছর থেকে সরকার আবারও দাম দিচ্ছে। পাটের রঙের ওপর দাম নির্ভর করে। প্রতি মণ পাটে ২৫০০-৩০০০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। পানির অভাবে এবার রঙ ভাল হবে না। ব্যবসায়ীরা দাম পেলেও আমরা পাইনা। তবে দাম যদি আরেকটু বাড়ানো হয় আমাদের জন্য সুবিধা হবে।

মান্দা উপজেলার গ্রামের পাট চাষী বাবু বলেন, আগে পাটের দাম পেতাম না। পাট জমিতেই নষ্ট হয়ে গেছে। যা পরে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে দু’বছর থেকে আবারও সরকার পাটের দাম দিচ্ছে। এ বছর ২ বিঘা জমিতে দেশিয় জাতের পাট চাষ করেছি। পাট উঠানোর পর ওই জমিতে আতব ধান লাগানো হবে। পাট জাগ দেওয়া বড় সমস্যা অনাবৃষ্টিতে নদী-নালা ও ডোবায় পানি না থাকা।

পড়তে পারেন: এক মাসেই বিক্রি হবে বিনা উদ্ভাবিত পাটশাক

নওগাঁ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) একেএম মনজুরে মাওলা বলেন, চলতি অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৪২৫ হেক্টর কম অর্জিত হয়েছে। পানি সংকটে পাট জাগ দেওয়া (পঁচানো) সমস্যার কারণে কৃষকরা নিরুৎসাহীত হওয়ায় কম পরিমানে আবাদ হয়েছে। বাজারে বর্তমানে পাটের দাম ভাল হওয়ায় কৃষকরা আগ্রহী হয়ে উঠছে।

তিনি বলেন, পাট একটি রপ্তানি পন্য এবং এর বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে। বাজারে এতো পরিমাণ পলেথিন আছে যা পরিবেশের জন্য বিপর্যয়। পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়ানো গেলে পরিবেশ যেমন রক্ষা পাবে তেমনি পাটের হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরে আসবে। পাট চাষে কৃষকদের উদ্বৃদ্ধ করতে প্রণোদনাসহ কৃষি বিভাগ থেকে সার্বিক সহযোগীতা করা হচ্ছে। পানি সংকট নিরসনে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পুকুর খনন বা নদী ড্রেজিং (খনন) করে পানি ধরে রাখা যেতে পারে। এতে করে কৃষকরা পাট জাগ দেওয়া সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে পারে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ