ইউসুফ আলী সুমন, মহাদেবপুর (নওগাঁ) প্রতিনিধি: জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে ক্রমেই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে। ভরা বর্ষা মৌসুমেও মুষলধারে কাঙ্খিত বর্ষণ হচ্ছে না। ফলে প্রকৃতির এমন বিরুপ আচরণে পাট নিয়ে বিপাকে পড়েছেন উত্তরাঞ্চলের চাষিরা।

পানি ও জলাশয় সঙ্কটে পাট জাগ দিতে না পেরে জমিতেই ফেলে রাখতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। কেউ গাড়ি ভাড়া করে দূরবর্তী নিচু এলাকার জলাশয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ পুকুর ভাড়া করে সেচ দিয়ে পাট জাগ দিচ্ছেন। এতে পাট উৎপাদনে কৃষকদের প্রতি বিঘায় ১০০০-১৫০০ টাকা খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও পাট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, চাষিদের আগ্রহ বাড়াতে প্রণোদনা দেয়াসহ সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। যেখানে পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। আর কৃষকরা বলছেন, পর্যাপ্ত প্রচার-প্রচারণা না থাকায় রিবন রেটিং পদ্ধতি সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না।

পড়তে পারেন: পাট জাগে পুকুর ভাড়া, বিঘায় গুণতে হচ্ছে দেড় হাজার!

প্রকৃত চাষিদের হাতে সরকারি সহায়তা পৌঁছায় না বলে অভিযোগ তাদের। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ অঞ্চলে প্রচুর খাসপুকুর রয়েছে। সোনালি আঁশের সুদিন ফিরাতে এখন ওই পুকুরগুলো পাট জাগ দেয়ার জন্য উন্মুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন চাষিরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কয়েক বছর থেকে বাজারে কাঁচা পাটের দাম বেশ ভালো যাচ্ছে। গত বছর অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ দামে বিক্রি হয়েছে। মৌসুমের শেষ দিকে প্রতিমণ পাটের দাম ৬-৭ হাজার টাকায় পৌঁছায়। পাটের দামের এমন উত্থানে মজুতদারদের কারসাজি থাকলেও কৃষকরা তুলনামূলক ভালো দর পেয়েছেন। বাড়তি দামে লাভ হলেও পাট চাষে কৃষকরা আগ্রহ হারাচ্ছেন।

পড়তে পারেন: জাগ দেওয়া পাট থেকে চকচকে আঁশ পাওয়ার কৌশল

আর এর পেছনে অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পাট পচানোর জন্য প্রয়োজনীয় পানির অভাব এবং পাটের দামে মজুতদারদের কারসাজির কারণে লোকশানের শঙ্কা। এছাড়া প্রতি বছর পাটের দামের অস্বাভাবিক ওঠা-নামার কারণে অনেক সময় কৃষকদের লোকসানের কবলে পড়তে হয়। ফলে কৃষকরা এখন পাটের বদলে অন্য ফসল ফলানোর দিকে বেশি মনোযোগী হচ্ছেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২০২৩ মৌসুমে এ অঞ্চলে ৫৯ হাজার ২৯৩ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। এ পরিমাণ জমি থেকে ১ লাখ ৫৪ হাজার ১৬১ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে কৃষি বিভাগ। বরেন্দ্র অঞ্চলের জেলা নওগাঁয় আশঙ্কাজনক হারে কমছে পাটের চাষাবাদ।

পড়তে পারেন: পাটের সঠিক বীজ বপন পদ্ধতি, জমি তৈরি ও পরিচর্যা

জেলায় এবার পাট চাষ হয়েছে ৫ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে নওগাঁ সদর উপজেলায় উপজেলায় ৬০০, বদলগাছীতে ১ হাজার ৪৬০, মান্দায় ১ হাজার ৮০০, ধামইরহাটে ৮৩০, মহাদেবপুরে ২০০, আত্রাইয়ে ২৫০, ধামইরহাটে ৮৩০, পত্নীতলায় ১৫০ এবং রানীনগরে ৪০ হেক্টর। জেলার ১১টি উপজেলার মধ্য সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় এ বছর পাট চাষ হয়নি বলে জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে।

গত মৌসুমে এ জেলায় পাটের আবাদ হয়েছিল ৫ হাজার ৭২৫ হেক্টরে। কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে গত ৫ বছরের ব্যবধানে জেলায় পাটের আবাদ কমেছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ হেক্টর। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে জেলায় ৩ হাজার ১৭৫ হেক্টর জমিতে পাটের চাষাবাদ হয়েছে। প্রায় ৯ হাজার ৫০ মেট্রিক টন উৎপাদন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, রিবন রেটিং পদ্ধতি ফ্লপ করেছে। এটি তেমন একটা কার্যকর নয়। এ পদ্ধতিতে পাটের আঁশ পচাতে ১২-১৫ জন অতিরিক্ত শ্রমিক ও ৩৫০০-৪৫০০ টাকা বেশি খরচ হয়। এ কারণে কৃষকেরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

বরেন্দ্র অঞ্চলের নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কোলা ভান্ডারপুর গ্রামের পাট চাষি স্বপন কুমার জানান, বিগত বছরগুলোতে তিন বিঘা জমিতে পাট চাষ করলেও এবার পানি সঙ্কটে এক বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছেন। কিন্তু কাঙ্খিত বৃষ্টি না হওয়ায় পড়েছেন চরম বিপাকে। গাড়ি ভাড়া করে দূরবর্তী নিচু এলাকার জলাশয়ে পাট নিয়ে গিয়ে জাগ দিতে হয়েছে। এতে তার অতিরিক্ত প্রায় দেড় হাজার টাকা খরচ হয়েছে।

একই গ্রামের কামাল জোয়াদ্দার বলেন, প্রতি বিঘায় পাট চাষ করতে খরচ হয় ১৪-১৫ হাজার টাকা, ফলন পাওয়া যায় ১১-১২ মণ। বর্তমানে বাজারে প্রতিমণ পাট ২৫০০-৩০০০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাটের রঙের ওপর দাম নির্ভর করে। পানির অভাবে এবার রঙ ভালো হবে না।

তিনি আরও বলেন, পাটের জমিতে ধান ভালো হয়। পাট চাষ করে লাভ না হলেও লোকসান হয় না। পাট কাঠিও কাজে লাগে। বলা যায় পাটকাঠিই কৃষকের লাভ। একই কথা বলেন আরও ২০-২৫ জন কৃষক।

রাজশাহীর বাঘার হামিদকুড়া গ্রামের পাট চাষি রুবেন হোসেন জানান, বৃষ্টি না থাকায় পাট জাগ দিকে পারছিলেন না। পাট কাটার পর জানতে পারেন আড়ানী পৌরসভার জোতরঘু গ্রামের মন্টু হোসেন নামের এক ব্যক্তি সেচ দিয়ে পাট জাগ দেয়ার জন্য পুকুর প্রস্তুত করেছেন।

এক বিঘা জমির পাট জাগ দিয়ে পুকুর মালিককে দিতে হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এলাকার অনেকেই পুকুর ভাড়া করে পাট জাগ দিচ্ছেন বলেও জানান তিনি। পদ্মার কালিদাসখালী চরের আশরাফুল ইসলাম এবার তিন বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন। তিনি জানান, অনাবৃষ্টি আর প্রচন্ড খরতাপের কারণে পাটগাছ খর্বাকৃতির হয়ে গেছে। জমির বেশির ভাগ পাটগাছ মরে যাচ্ছে।

পাট চাষাবাদ ও চাষিদের নানা সঙ্কটের বিষয়ে জানতে পাট অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলের সহকারী পরিচালক সাইফুল ইসলামের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের রাজশাহী আঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক শামছুল ওয়াদুদ জানান, যেখানে পানির অভাব সেখানে রিবন রেটিং পদ্ধতিতে পাট পচানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। পাট চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে প্রণাদনাসহ কৃষি বিভাগ থেকে সার্বিক সহযাগীতা করা হচ্ছে। বর্তমান বাজারে পাটের দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকরা অধিক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এবারও উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রমের প্রত্যাশা করছেন তিনি।

‘বরেন্দ্র অঞ্চলে খরা ও পানি ব্যবস্থাপনা’ বিষয়ক এক সংলাপে রাজশাহী সাংবাদিক ইউনিয়ন মিলনায়তনে পানি বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য চৌধুরী সরওয়ার জাহান সজল বলেন, বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রচুর খাসপুকুর। কিন্তু সেগুলো সাধারণ মানুষের ব্যবহারের সুযোগ নেই। দলীয় নেতারা উঠেপড়ে লাগেন ইজারা নেওয়ার জন্য। উপজেলা প্রশাসন ইজারা দেয়। এটাও একটা সংকট। এলাকার প্রভাবশালী মহল পুকুরগুলো ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করছে। এখন পাট জাগ দেওয়ার জন্য কৃষক পানি পাচ্ছে না। ওই পুকুরগুলো থাকলে কৃষকের কাজে লাগত।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ