রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের গুহায় ৩ হাজার খ্রিষ্টপূর্বের শিকার চিত্র সংগৃহীত

মেহেদী রাসেল: কৃষিকাজ শুরুর আগে কী করত আদিম মানুষ? কেমন ছিল তাদের জীবনযাপন? অল্প কথায় বলতে গেলে, এর আগে মানুষ ছিল যাযাবর, ছিল শিকার সংগ্রহকারী। প্রকৃতিতে যা পাওয়া যেত, সেগুলো থেকেই খাবার জোগাড় করত তারা, মেটাত দৈনন্দিন প্রয়োজন।

নিজেরা আলাদা কোনো উৎস তৈরি করার কথা তখনো ভাবেনি মানুষ। বনের গাছপালা থেকে ফলমূল ও সবজির জোগান আসত আর পশুপাখি শিকার করতে হতো পরিশ্রম, সাহস ও বুদ্ধি খাটিয়ে। কিন্তু এর ফলে মানুষকে এক জায়গায় থাকলে চলত না। খাদ্য ও পানির সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হতো নানা অঞ্চলে।

হিংস্র পশু এবং বিরূপ পরিস্থিতির কারণে তখনকার মানুষ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠন করে একসঙ্গে থাকত। কিন্তু ওই জীবন যথেষ্ট আরামদায়ক ছিল না। মানুষ তাই বিকল্প কিছু চিন্তা করল।

১০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাগৈতিহাসিক কালের যাযাবর মানুষেরা দেখল, মাটিতে বীজ পুঁতলে তা থেকে চারা বের হয়। সেই চারা বড় হয়। এরপর সিদ্ধান্ত নিল, তারা এক জায়গায় থিতু হবে; তারা আর শিকার করবে না এবং খাবারের সন্ধানে ঘুরে বেড়াবে না। সেই থেকে কৃষিকাজের উদ্দেশে এক জায়গায় থাকতে শুরু করে আদিম মানুষ। তারাই ছিল পৃথিবীর প্রথম কৃষিজীবী। তাদের মাধ্যমেই সভ্যতার সূচনা পর্বের পত্তন হয়।

কৃষিজীবী মানুষ ধীরে ধীরে মিসর, পশ্চিম এশিয়াসহ ভূমধ্যসাগর থেকে পারস্য উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। অঞ্চলটি ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’ নামে পরিচিত। এ অঞ্চল বেষ্টিত ছিল নীল নদ, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নামের বড় তিনটি নদী দিয়ে। এসব নদীর পানিতে বিস্তৃত অঞ্চল প্লাবিত হতো। ফলে পানির সঙ্গে আসত পলিমাটি। পলি পড়ে উর্বর হতো ভূমি। ফলে এসব অঞ্চল ছিল কৃষিকাজের জন্য একেবারে আদর্শ।

মানুষ যখন কৃষিকাজের কারণে এক স্থানে থিতু হতে শুরু করল, তখন তারা প্রাণীদের ব্যাপক হারে পোষ মানাতে শুরু করল। কুকুর, ছাগল, ভেড়া ও শূকর ছিল প্রথম দিককার গৃহপালিত পশু। যেসব পশু আগে বুনো ছিল, এদেরই নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে মানুষ। ক্রমশ এই পশুরা হয়ে উঠল মানুষের খাদ্যের উৎস। মানুষ এসব পশু থেকে প্রয়োজনীয় দুধ, মাংস ও পশম পেতে লাগল।

যখন মানুষ কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিল এবং নিয়মিতভাবে খাদ্যশস্য ফলাতে শুরু করল, তখনই আসলে প্রকৃত সভ্য সমাজ তৈরি হতে লাগল। এ সভ্যতায় মানুষ নির্দিষ্ট ভূমিতে বছরের পর বছর কৃষিকাজ করতে থাকল। স্বাভাবিকভাবেই কৃষিজমি ও খামারগুলো হয়ে উঠল সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু।

খাদ্যশস্যের পর্যাপ্ত জোগান এবং অতিরিক্ত খাবার মজুত থাকার ফলে মানুষ অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজ করার জন্য সময় বের করতে পারল। ধারণা করা হয়, এভাবেই প্রথম সভ্য সমাজের আরম্ভ। প্রথম দিককার কিছু কৃষিজীবী গ্রামাঞ্চল পরবর্তী সময়ে বড় বড় শহর হয়ে উঠেছিল।

৮ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে পশুপালন ও কৃষিকাজ পূর্ব এশিয়া ও আমেরিকা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এসব অঞ্চলে প্রধানত স্কোয়াশ, ভুট্টা ও ধান ফলত।

এরপর ৭ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে মধ্যপ্রাচ্যে রাইশস্য, বার্লি ও গমের মতো আধুনিক খাদ্যশস্য ফলাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে বিশ্বের নানা জায়গায় খাদ্যশস্যের উৎপাদন শুরু হলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য আমদানি-রপ্তানির বিরাট বাজার তৈরি হয়। রোমান ব্যবসায়ীরা পৃথিবীর নানা অঞ্চল থেকে খাদ্য কিনে এনে মজুত করতে আরম্ভ করে।

এক স্থানে স্থিত এবং দলবদ্ধ মানুষ হয়তো নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে, কিন্তু নিরাপত্তাই তো সবকিছু নয়। এর বাইরেও থাকে নানা বিষয়। সভ্যতার সূচনাকালে প্রথমবারের মতো মানুষ কিছু সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হলো, যেমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ঘনবসতি ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোগবালাই।

যাহোক, পরবর্তী সময়ে মানুষ এসব সমস্যাকেও সমাধানযোগ্য করে তুলতে পেরেছিল। কিন্তু কৃষিই হলো প্রথম বড় ঘটনা, যা মানুষকে সভ্যতা গড়ে তুলতে সহায়তা করেছিল। কে জানে, তখনকার মানুষেরা কৃষিকাজ ও পশুপালন শুরু না করলে আধুনিক সভ্যতার ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো কি না!

লেখাটি লিখেছেন মেহেদী রাসেল। সূত্র: হানড্রেড ইভেন্ট দ্যাট মেড হিস্ট্রি ও প্রথম আলো।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ