ডেস্ক প্রতিবেদন, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: অনেক সবজি আছে যেগুলোর ফলই আমরা খাবার হিসেবে গ্রহণ করি। এসব সবজিতে বা একটি বয়স্ক ফল গাছে যেমন ফল ধরে তেমন ফল ঝরে যাওয়ার সমস্যাও দেখা যায়। ফল ঝরে যাওয়ার সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে যদি সঠিক সময়ে সঠিক প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তাহলে একটি ফল গাছ থেকে বা একটি সবজি ক্ষেত থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলন আশা করাই যেতে পারে।পেঁপের ফল ঝরার কারণ ও প্রতিকার লেখাটি লিখেছেন কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম।আসুন জেনে নেই পেঁপের ফল ঝরার কারণ ও প্রতিকার।

বাংলাদেশে সারা বছরই কোনো না কোনো ফল পাওয়া যায়। অর্থাৎ সারা বছরই কোনো না কোনো গাছে ফল ধরে। আবার অনেক সবজি আছে যেগুলোর ফলই আমরা খাবার হিসেবে গ্রহণ করি। এসব সবজিতে বা একটি বয়স্ক ফল গাছে যেমন ফল ধরে তেমন ফল ঝরে যাওয়ার সমস্যাও দেখা যায়। ফল ঝরে যাওয়ার সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে যদি সঠিক সময়ে সঠিক প্রতিকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তাহলে একটি ফল গাছ থেকে বা একটি সবজি ক্ষেত থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলন আশা করাই যেতে পারে। বেশ কিছু জৈবিক ও অজৈবিক কারণে ফল ঝরে পড়ার ঘটনা ঘটে।

ফল ঝরে পড়ার বেশ কিছু জৈবিক কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোথ ফল ধরার পরও ফল হলুদ হয়ে ঝরে পড়া। অনেক ধরনের ফল গাছ আছে যেগুলোয় স্ত্রী ও পুরুষ গাছ দেখা যায়। যেমন পেঁপে গাছ। পেঁপেবাগানে যদি শতকরা ১০টি পুরুষ গাছ রাখা যায় তাহলে পেঁপের স্ত্রী ফুলের পরাগায়ন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয় এবং পেঁপের পরাগায়নজনিত সমস্যায় ফল ঝরা প্রতিরোধ করা যায়। এ ছাড়া অনেক ফল গাছে প্রথম দিকে শুধু পুরুষ ফুল কিংবা অধিকাংশ ফুলই পুরুষ ফুল হিসেবে ফোটে, সে ক্ষেত্রে শেষের দিকে পুরুষ ফুলের সংখ্যা কমে যায় এবং স্ত্রী ফুলগুলো পরাগায়নের অভাবে ঝরে যায়।

নাইট্রোজেন জাতীয় সারের অতিরিক্ত প্রয়োগে বা গাছের অতিরিক্ত গ্রহণে গাছের দৈহিক বৃদ্ধি বা গাছের তেজ বেশি হয়, এতে স্ত্রী ফুলের চেয়ে পুরুষ ফুল কম ফোটে এবং অনেক স্ত্রী ফুল সঠিকভাবে পরাগায়িত না হওয়ায় ফল ঝরে যায়। এ জন্য গাছে মাত্রাতিরিক্ত নাইট্রোজেন জাতীয় সার প্রয়োগ করা যায় না। অর্থাৎ সঠিক মাত্রায় নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ করতে হয়।

ফল গাছে অনেক ধরনের রোগ দেখা দিলে ফল ঝরে পড়ে । যেমনথ পেঁপের গোড়া পচা রোগে ফল ঝরে যায়, নারকেলের কুঁড়ি পচা রোগে কচি ফল ঝরে যায়, এনথ্রকানোজ বা ফোসকা পড়া রোগে কচি আম ও পেয়ারা, কাঁঠালের মুচি ফল ঝরে যায় এবং সাদা গুঁড়া রোগে কুল ঝরে যায়। এসব রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য মেনকোজেব বা সালফার জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়।

মিলিবাগ বা ছাতরা পোকার আক্রমণ হলে কচি ফল ঝরে পড়ে। কুল, পেঁপে, পেয়ারা, কাঁঠালে এ পোকার আক্রমণ দেখা যায়। গাছে পিঁপড়ার আনাগোনা বেড়ে গেলে গাছের কচি অংশ এবং ফুল বা ফলের বোঁটার কাছে লক্ষ্য করলে ছাতরা পোকা দেখতে পাওয়া যায়। পিঁপড়া চলাচল ঠেকানোর জন্য গাছের গোড়ার চারদিকে ছাই ছিটিয়ে দিতে হয়। এ ছাড়া মিলিবাগের আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরপিড জাতীয় কীটনাশক প্রতি ১০ লিটার পানিতে ৫ মিলিলিটার হারে মিশিয়ে আক্রান্ত অংশসহ পুরো গাছে স্প্রে করতে হয়। অনেক সময় নারকেল গাছে ইঁদুরের আক্রমণ হলে ফল ঝরে পড়ে।

গাছে ইঁদুর ওঠা নিয়ন্ত্রণ করতে গোড়ার চারদিকে ৩-৪ ফুট অংশ পাতলা টিন বা পলিথিন দিয়ে এমনভাবে মুড়ে দিতে হয় যেন গাছ ও টিনের মাঝে কোনো ফাঁক না থাকে। এতে টিন বা পলিথিনের পিচ্ছিলতার জন্য ইঁদুর গাছে উঠতে পারে না। অনেক ফল গাছে একই বোঁটায় বা শাখায় একসঙ্গে অনেক ফল ধরে। একসঙ্গে ধরার কারণে সব ফলের আকার এক রকম না হয়ে ছোট-বড় হয়। কিন্তু কিছু ফল যদি ছাঁটাই করে দেয়া যায় তাহলে বাকি ফলগুলো প্রায় একই আকারের ও বড় হয়।

ফল ঝরে পড়ার অনেক অজৈবিক কারণের মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয় খরায় বা মাটিতে রসের অভাব হলে। এতে মাটি থেকে গাছ পুষ্টি উপাদান বা খাদ্য সংগ্রহ করতে পারে না এবং ফল ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পায়। খরার সময় হঠাৎ বৃষ্টি হলে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যায় অথবা খরার সময় মাটিতে হঠাৎ রসের পরিমাণ বেড়ে গেলে ফল ও ফলের বোঁটার সংযোগস্থলে একটি নির্মোচন স্তর তৈরি হয়। এতে কচি ফল ঝরে পড়ে। নিয়মিতভাবে সেচ দিয়ে মাটির রসের পরিমাণ যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তাহলে ফল ঝরা কমানো যায়।

সুসম মাত্রায় সার প্রয়োগ না করার কারণে গাছে পুষ্টির অভাব হলে ফল ঝরে পড়তে পারে। বিশেষ করে পটাশিয়ামের অভাব হলে ফল ঝরা বেশি হয়। বোরনের অভাবেও ফল ঝরে পড়ে। ক্যালসিয়ামের অভাবে টমেটো ও মরিচে ফলের আগা পচা রোগ দেখা যায়। এসব পুষ্টি উপাদান স্প্রে করে বা গোড়ায় প্রয়োগ করে ফল ঝরা প্রতিরোধ করা যায়।

পুষ্টি অভাবের পাশাপাশি গাছের ভেতরে হরমোনগত সমস্যাও দেখা দিতে পারে। হরমোনের অভাব বা সঠিক মাত্রায় গাছের ভেতরে হরমোন তৈরি না হলে অনেক ফুল ধরলে এবং পরাগায়ন হলেও বেশির ভাগ ফলই ঝরে পড়ে বা আকারে খুব একটা বড় হয় না। গাছে হরমোনের সাম্যতা ঠিক রাখার জন্য সুসম মাত্রায় সার প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

ফলন্ত গাছের ওপর দিয়ে যদি ঝোড়ো বাতাস বয়ে যায় তাহলে ছোট-বড় সব আকারের ফলই ঝরে পড়তে পারে। এ জন্য ফলবাগান করার সময় বাগানের চারদিকে বিশেষ করে পশ্চিম ও উত্তর দিকে বাতাস প্রতিরোধী গাছ যেমন নারকেল, তাল, খেজুর, মেহগনি, বাবলা গাছ রোপণ করা যেতে পারে। তীব্র শৈত্যপ্রবাহে গাছের ফল না ঝরলেও গাছের পাতায় শীতের ক্ষত দেখা দিতে পারে এবং গাছে খাবার উৎপাদন ব্যাহত হয়ে গাছ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এতে কিছু ফল ঝরেও যেতে পারে। শৈত্যপ্রবাহের সময় নিয়মিতভাবে শুধু পানি পাতায় স্প্রে করলে পাতা শীতের ক্ষত থেকে রক্ষা পায় এবং পরে ফল ঝরা অনেক কমে যায়।

গ্রীষ্মকালে বাতাসের তাপমাত্রা বেশি এবং আর্দ্রতা কম থাকলে ফল ঝরে পড়ে। ফলের ভেতরের ও বাইরের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার পার্থক্যের কারণে ফলের বোঁটা দুর্বল হয়ে ফল ঝরে পড়ে। আবার তাপপ্রবাহেও গাছের জৈবিক কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায় এবং দৈহিক বৃদ্ধিও স্থবির হয়ে পড়ে। গাছে ভেতরে ও বাইরে আর্দ্রতার হেরফের হওয়ায় ফল ঝরে পড়তে শুরু করে। তাপপ্রবাহের সময় নিয়মিতভাবে মধ্যরাতের দিকে গাছের গোড়ায় ও স্প্রে মেশিন দিয়ে পাতায় স্প্রে করলে ফল ঝরা অনেকাংশে কমানো যেতে পারে।

কোনো একটি ফল গাছে বা ফলবাগানে ফল ঝরে যাওয়ার সমস্যা একটি না হয়ে একসঙ্গে একাধিকও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সঠিক কারণ খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। এ ব্যাপারে যদি বিশেষ কোনো পরামর্শের প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে নিকটবর্তী উপজেলা কৃষি অফিস বা হর্টিকালচার সেন্টারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। ফল ঝরে যাওয়ার সঠিক কারণ বের করে যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়, তাহলে ফল গাছ বা ফলবাগান থেকে কাঙ্ক্ষিত ফলন অবশ্যই পাওয়া সম্ভব।

পেঁপের ফল ঝরার কারণ ও প্রতিকার লেখাটি লিখেছেন কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম, উদ্যানবিশেষজ্ঞ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর অঞ্চল, খামারপাড়া, রংপুর।