এগ্রিকেয়ার২৪.কম ডেস্ক: পোল্ট্রি শিল্পের সাথে জড়িত থাকা অসংখ্য খামারিরা যেন টিকে থাকতে পারে সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ। এ সময় তিনি বলেন, যে কোন মূল্যে খাদ্যকে নিরাপদ রাখতে হবে।

রাজধানীতে দুদিনব্যাপী ‘ফুড এন্ড এনভায়রনমেন্ট সেফটি ইন কমার্শিয়াল পোল্ট্রি প্রোডাকশন’ শীর্ষক এ সেমিনারের শেষদিনে গোল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে মুরগির মাংসের সিংহভাগ এবং ডিমের প্রায় পুরোটাই আসে পোল্ট্রি থেকে। এ শিল্পের সাথে অসংখ্য খামারি জড়িত তাই তাঁরা যেন টিকে থাকতে পারে সে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে। কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে এন্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার (এজিপি) আমদানি করছে এমন অভিযোগের উত্তরে মন্ত্রী জানান, যারা-ই আইন অমান্য করবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ওয়ার্ল্ড’স পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখা (ওয়াপসা-বিবি) আয়োজিত দু’দিনব্যাপি (২১-২২ এপ্রিল) এ সেমিনার একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এর প্রেসিডেন্ট মসিউর রহমান। সঞ্চালনায় ছিলেন বি.এ.আর.সি এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফুড সেফটি’র সভাপতি ডা. মো. রফিকুল ইসলাম।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী নারায়ন চন্দ্র চন্দ বলেন, শুধু খাদ্যের উৎপাদনই যথেষ্ঠ নয়, সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য এবং সাসটেইনেবল হেলদি ফুড সাপ্লাই নিশ্চিত করাটাও বড় একটি চ্যালেঞ্জ। আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ এবং ‘নিরাপদ খাদ্য’ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পে নিরাপদ ও মানসম্মত ডিম ও মুরগির মাংসের উৎপাদন শুরু হয়েছে বলেন জানান মন্ত্রী। সেমিনারে দেশের খ্যাতনামা পোল্ট্রি, পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য বিশেষজ্ঞ ছাড়াও বেলজিয়াম, জার্মানি এবং ভারতের বিশেষজ্ঞগণ অংশগ্রহণ করেন।

সেমিনারে ওয়াপসা-বাংলাদেশ শাখার সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, প্রতিদিন জনসংখ্যা বাড়ছে অথচ কমছে আবাদি জমি। তাই মানুষের জন্য খাদ্যের সংস্থান করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে শুধু খাদ্যের সংস্থান করাটাই যথেষ্ঠ নয় বরং তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা।

তিনি বলেন, তবে অত্যন্ত গর্বের বিষয়টি হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশে এন্টিবায়োটিক গ্রোথ প্রোমোটার (এজিপি) মুক্ত পোল্ট্রি খাদ্য উৎপাদিত হচ্ছে। বিশ্বের সর্বাধিক পোল্ট্রি উৎপাদনকারি দেশ ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এজিপি’র ব্যবহার বন্ধ করতে না পারলেও বাংলাদেশ সরকার তা পেরেছে।

তিনি জানান, বর্তমান বাজারে পোল্ট্রিই হচ্ছে সবচেয়ে সস্তার প্রাণিজ আমিষ। এসডিজি তে যে ১৭টি লক্ষ্য নির্ধারন করা হয়েছে তার মধ্যে ১৪টি লক্ষ্য অর্জনে কোনো না কোনোভাবে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান রয়েছে।

অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান বোঝাতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রসঙ্গ টেনে বলেন- যুক্তরাষ্ট্রে চিকেন ইন্ডাষ্ট্রি ১১,৯৫,৭৪৫ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, মজুরি হিসেবে প্রদান করে থাকে ৬৮.৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার। মোট বার্ষিক ইকোনমিক ইম্প্যাক্ট প্রায় ৩.১৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।

দেশের পোল্ট্রি শিল্পের অন্যতম বড় এ উদ্যোক্তা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পোল্ট্রিখাত উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২০ লাখ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিলিয়ে মোট প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। গ্রামীন পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। গ্রাম থেকে শহরের মাইগ্রেশন কমাতে সহায়ক হয়েছে। তাছাড়া পোল্ট্রি পালন হাউসহোল্ড ইনকাম প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. আইনুল হক বলেন, প্রাণিজ আমিষকে নিরাপদ রাখতে আমরা ফুড সেফটি অথরিটি, ইন্সটিটিউট অব পাললিক হেলথ এবং এফ.এ.ও এর সাথে যৌথভাবে কাজ করছি। খামারিদের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সচেতনতা এবং দক্ষতাবৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এফ.এ.ও এর কনসালট্যান্ট শাহ মুনির বলেন, খামারিরা মধ্যসত্ত্বভোগী শ্রেণীর হাতে জিম্মি হয়ে আছে, তাই প্রোডাকশন এবং মার্কেটিং এর মাঝে লিংকেজ স্থাপন জরুরী। তিনি জানান, ঢাকা শহরের ওয়েট মার্কেটগুলোর উন্নয়নের লক্ষ্যে এফ.এ.ও একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে- এটিও নিরাপদ খাদ্য প্রক্রিয়ায় অবদান রাখবে।

ড. ললিতা ভট্টাচারিয়া বলেন, নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান খুবই সুস্পষ্ট। ড. নীতিশ দেবনাথ বলেন, ডিএলএস  পোল্ট্রি উৎপাদনে নজর দিলেও রিস্ক ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে তার কোন উদ্যোগ নাই। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. জসিমউদ্দিন বলেন- সেফ ফুড নিশ্চিত করতে হলে সেফ ফিডের নিশ্চয়তা দিতে হবে। ফিড অ্যাক্ট সঠিকভাবে প্রয়োগ হচ্ছেনা বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

হুভে ফার্মা’র (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া) প্রেসিডেন্ট ও.পি. সিং বলেন- বাংলাদেশে পোল্ট্রি’র উৎপাদন বেড়েছে। উৎপাদন বাড়লে কিছু রিস্কও তৈরি হয় তবে এতে উদ্বিগ্ন না হয়ে বরং তা সমাধান করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এজন্য একটি ন্যাশনাল প্লান দরকার বলে মনে করেন মি. সিং।

বি.এল.আর.আই এর মহাপরিচালক নাথুরাম সরকার বলেন- ২০০৮ সালে একটি পোল্ট্রি নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে এটির আধুনিকায়ন প্রয়োজন। তিনি জানান, একটি ম্যানুয়ার ম্যানেজমেন্ট পলিসি’র ড্রাফটিং এর কাজ চলছে এটি গৃহিত হলে পোল্ট্রিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহজতর হবে।

বক্তারা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। জিডিপি ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ অর্থনীতির সাইজ ৩.০৬৪ ট্রিনিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। কাজেই সেই অর্থনীতিতে মানুষকে প্রাণিজ প্রোটিন পর্যাপ্ত পরিমানে সরবরাহ করতে হবে।

২০১৬ সালে দেশে মাথাপিছু বার্ষিক চিকেন কনজাম্পশন ছিল ৬.৩ কেজি, ২০৫০ সালে আমাদের প্রয়োজন হবে নূন্যতম ৪৫ কেজি। কাজেই একদিকে যেমন ডিম ও মুরগির মাংসের মত প্রোটিন জাতীয় খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে একই সাথে সাসটেইনেবল এবং সেফ পোল্ট্রি প্রোডাকশন নিশ্চিত করতে হবে।

তারা বলেন- আমাদের দেশে পোল্ট্রিতে হেভি মেটাল সমস্যা প্রায় শূণ্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এন্টিবায়োটিকের যতগুলো বিকল্প আমাদের দেশে আছে অনেক দেশেই তা নাই।

দেশীয় কোম্পানীগুলোকে ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য সরকারকে অনুমতি দিতে হবে এবং ব্যাকওয়ার্ড পোল্ট্রিতে ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পোল্ট্রি ফিডে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের নীতিমালা আছে কিন্তু পানিতে এন্টিবায়োটিক ব্যবহারের কোন নীতিমালা নেই।

কাজেই অতিস্বত্তর এই নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। বক্তাগণ খোলাবাজারে জীবন্ত মুরগি বিক্রি, অবৈধ ফিড মিলগুলো পুরোপুরিভাবে বন্ধ করা, সারাদেশের খামারিদের জন্য ওয়াটার স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা, খামার পর্যায়ে জীবনিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং এ বিষয়ে সারাদেশের খামারিদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও দক্ষতাবৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন।

ওয়াপসা-বাংলাদেশ শাখার সাধারন সম্পাদক মাহাবুব হাসান বলেন- দুদিনব্যাপি সেমিনারে নিরাপদ পোল্ট্রি উৎপাদন এবং খামারে জীবানুমুক্ত স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিষয়ে যে সকল সুপারিশ দেয়া হয়েছে তা শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সহায়ক হবে।

দুদিনব্যাপি আয়োজনে বাণিজ্যিক পোল্ট্রি উৎপাদন, প্রসেসিং, সংরক্ষণের ঝুঁকি এবং তা মোকাবেলায় করণীয় বিষয়ে আলোচনা হয়। প্রথমদিন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এমদাদুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক ড. প্রিয়মোহন দাস, ড. এস.ডি. চৌধুরী  এবং শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ সায়েম উদ্দীন আহমেদ টেকনিক্যাল পেপার উপস্থাপন করেন। এছাড়াও ভারতের ড. জে.আই. ভেগাদ, বেলজিয়ামের মি. হ্যানস মিয়্যানস্ এবং জার্মানীর ড. কাই-জে. কুলম্যান পেপার উপস্থাপন করেন।