রুবাইয়াদ ইসলাম, হাবিপ্রবি (দিনাজপুর): ফসলে নাইট্রোজেন নিয়ন্ত্রকারী নতুন জিন আবিস্কার করেছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) প্রাক্তন ছাত্র মো. নূরে আলম সিদ্দিকী। নূরে আলম সিদ্দিকী ২০০৯ সালে হাবিপ্রবির কৃষি অনুষদ থেকে স্নাতক এবং ২০১২ সালে বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিষয়ের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এরপর জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্রপ মলিকুলার জেনেটিক্সের ওপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

এরপর গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিসিস্ট্র অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তার পিএইচডি গবেষণার বিষয় ছিল জেনেটিক বেরিয়েশন ইন রুট আর্কিটেকচার ট্রেইটস ফর নাইট্রোজেন ইউজ ইফিসিয়েন্সি ইন হুইট অ্যান্ড বার্লি।

নূরে আলম সিদ্দিকী তার পিএইচডি গবেষণার বিষয়ে জানান, মাটিতে প্রচুর পরিমাণে নাইট্রোজেনের উপস্থিতি গাছ তথা উদ্ভিদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি হলে তা দ্রবীভূত হয়ে এক সময় বাতাসে অ্যামোনিয়ার পরিমাণ বৃদ্ধি করে। কৃষক অধিক ফসল উৎপাদনের আশায় মাটিতে অতিরিক্ত মাত্রায় নাইট্রোজেন (ইউরিয়া সার) প্রয়োগ করেন। ফলে অব্যবহƒত কিছু নাইট্রোজেন গ্যাস আকারে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

এতে করে পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়। আবার কিছু নাইট্রোজেন শোষিত বা লিচিং হয়ে ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্গে মিশে পানিকে দূষিত করে, যা জলজ প্রাণীর জন্য হুমকিস্বরূপ। এজন্য ফসলের জমিতে নাইট্রোজেনের ব্যবহার কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সেটি নিয়ে গবেষণা করা জরুরি। যদি সেটি করা যায় তাহলে একদিকে অতিরিক্ত নাইট্রোজেন ব্যবহারে কৃষকের যে আর্থিক অপচয় তা কমবে। অন্যদিকে পরিবেশ ও পানিদূষণ রোধ সম্ভব হবে।

তিনি আরও বলেন, গাছ সাধারণত শিকড়ের মাধ্যমে মাটি থেকে পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে। সেই পুষ্টি উপাদান গাছের ওপরের অংশে (কাণ্ড ও পাতায়) পৌঁছে দেয়ার জন্য নাইট্রেট ট্রান্সপোর্টার হিসেবে বিভিন্ন ধরনের জিন কাজ করে। আমরা আমাদের গবেষণায় উদ্ভিদে নাইট্রেট ট্রান্সপোর্টার হিসেবে সর্বপ্রথম ৬০টির মতো জিনের সন্ধান পেয়েছি। এর মধ্যে গম এবং বার্লিতে একই ধরনের একটি নাইট্রেট ট্রান্সপোর্টার জিন পেয়েছি। এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং কার্যাবলি নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছি।

তিনি জানান, গবেষণায় আমরা দেখেছি এই জিন গাছের মধ্যে উপস্থিত থাকলে নাইট্রোজেন বেশি দিলে সেটি তা সক্রিয়ভাবে (নাইট্রেট) গ্রহণ (আপটেক) ও ট্রান্সপোর্ট করতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন মলিকুলার প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই জিনের কার্যক্রম নিষ্ক্রিয় করা হয়, তখন কম পরিমাণ নাইট্রোজেন দিলেও উদ্ভিদের শিকড়ের বৃদ্ধির মাধ্যমে নাইট্রেট গ্রহণ ও ট্রান্সপোর্ট ত্বরান্বিত করে। মাঠপর্যায়ে কম পরিমাণ নাইট্রোজেন প্রয়োগ করেও দেখা গেছে এটি উদ্ভিদের নাইট্রোজেন ব্যবহার সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। আমি মনে করি, ভবিষ্যতে যদি এটি নিয়ে আরও গবেষণা করা যায় তাহলে মাটিতে নাইট্রোজনের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে এবং কৃষকেরাও আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হতে পারবেন।

উল্লেখ্য, মো. নূরে আলম সিদ্দিকী ১৯৮৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম জেলার অর্ন্তগত সদর উপজেলাধীন কাঠালবাড়ী ইউনিয়নের খোলারপাড় গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। ২০১১ সালে জাপানের জাইকা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক জেনেসিস (জাপান ইস্ট এশিয়া নেটওয়ার্ক ফর এক্সচেঞ্জ অব স্টুডেন্টস অ্যান্ড ইয়ুথ) প্রোগামে ভিজিটিং ফেলো হিসেবে জাপানের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শনসহ বেশ কয়েকটি সেমিনারে তিনি অংশ নেন।

পরে ২০১২ সালে জামালপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজে (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের প্রভাষক পদে এবং পরে ২০১৩ সালে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন।

২০১৫ ও ২০২২ সালে যথাক্রমে সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক (এখনও যোগদান হয়নি) পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ২০১৮ সালে সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন ফেলোশিপ একাডেমিক এক্সচেঞ্জ (ডিএএডি) নিয়ে তিনি জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্ল্যান্ট মলিকুলার জেনেটিক্স বিষয়ের ওপর পিএইচডি করার জন্য যান। সেখানে দীর্ঘ চার বছর অত্যন্ত গবেষণা করার পর গত ৫ অক্টোবর তাকে পিএইচডি ডিগ্রি দেয়া হয়।