ড. মো. জহুরুল ইসলাম, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বিনা, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: দেশের ক্রমবর্ধমান  জনসংখ্যার সুস্বাস্থ্য ও সুখী-সমৃদ্ধ জীবন অর্জনের লক্ষ্যে কৃষি প্রধান এ দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য খাদ্যোৎপাদন চাহিদা দিন দিন বেড়ে চলেছে। দানা জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পুর্ণতা অর্জন করলেও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জন এখনও সম্ভবপর হয় নি।

শর্করা জাতীয় ফসল ধান, গম প্রয়োজন মাফিক উৎপন্ন হলেও প্রোটিন, তেল ও খনিজ খাদ্য ফসলের  প্রচুর ঘাটতি রয়েছে দেশে। প্রোটিনের মধ্যে প্রাণীজ প্রোটিনের অভাব অনেক এবং তা পুরণ করতে হয় উদ্ভিদ প্রোটিনের মাধ্যমে।

এ প্রেটিনের ঘাটতি মেটানোর সহজ পদ্ধতি হলো উদ্ভিদ প্রোটিনের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। প্রোটিন, চর্বি এবং খনিজের ঘাটতি পুরণ সম্ভব হবে লিগুমিনাস ডাল, তেল ও সবজী ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির দ্বারা।

এ দেশে উৎপন্ন ডাল ফসল যেমন- মসুর, খেসারী, ছোলা, মাষকলাই, মুগ, ফেলন, অড়হর ও মটর যথেষ্ট প্রেটিন সমৃদ্ধ। গবেষণা থেকে দেখা যায়, মসুরে ২৬-২৯%, খেসারীতে ২৪-২৬%, ছোলাতে ২৩-২৭%, মুগে ২০-২৪%, মাষ কলাইয়ে ২১-২৪% ও ফেলনে ২৫-৩০% প্রোটিন বিদ্যমান। 

অড়হর এবং মটরেও যথেষ্ট পরিমান প্রোটিন থাকে। তা ছাড়া তেল জাতীয় ফসল চিনাবাদামে ২২-২৯% এবং সয়াবিনে ৪০-৪৫% প্রোটিন রয়েছে। চিনাবাদামে প্রচুর প্রোটিন থাকায় খাদ্যের তালিকাতেও রাখা যায়। পার্শবর্তি দেশ মালয়েশিয়াতে তেলে ভাজা চিনাবাদামের দানা নিয়মিত খাদ্যের সাথে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। সয়াবিনের ব্যবহার এখন অনেকভাবে করা হয়ে থাকে।

সয়াবিস্কেট, সয়াডাল, সয়ামিট, সয়ামিল্ক, সয়াসস ইত্যাদি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। সবজী ফসল শিম, বরবটি, মটরসুটি, ঝাড়শিম ইত্যাদিতে প্রোটিন এবং খনিজ দুটোই বিদ্যমান থাকে। ফেলনের কাঁচা ফল সবজি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং প্রোটিনের সাথে তাতে যথেষ্ট পরিমান খনিজও থাকে যা মানবদেহের জন্য খুবই উপযোগী।

এ সকল লিগুমিনাস ফসলের শিকড়ের নড্উিলে থাকে রাইজোবিয়াম জেনাসের ব্যাক্টেরিয়া যা বাতাস থেকে নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে এবং গাছের নাইট্রোজেনের চাহিদা মেটায়। এ সকল ব্যাক্টেরিয়াকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পৃথকীকরণ ও ল্যাবরেটরীতে বিভিন্ন প্রকার পরীক্ষা, বিভিন্ন এলাকার মাটি ও জলবায়ুতে অভিযোজন ও ফলন পরীক্ষা করে জীবাণু সার আবিষ্কার করা হয়েছে।

বর্তমানে বিনা’তে ৮টি ফসল -মসুর, ছোলা, মুগ, মাষকলাই, বরবটি, চিনাবাদাম, সয়াবিন এবং ধৈঞ্চা এর জীবাণু সার উৎপাদন ও কৃষকদের মাঝে বিতরণ চলছে। বিনা প্রধান কার্য়ালয় ময়মনসিংহ এবং ১৩টি উপকেন্দ্র- ঈশ্বরদী, মাগুরা, সাতক্ষিরা, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, কুমিল্লা, নোয়াখালি, খাগড়াছড়ি, সুনামগঞ্জ, রংপুর, চাপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুর এবং নালিতাবাড়ি (শেরপুর) থেকে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।

এ সারের ব্যবহারে ডাল ও তেল জাতীয় ফসলের ফলন বাড়ে মসুরে ১৫-৩০%, ছোলাতে ১৫-৩৫%, মুগে ২০-৪০%, মাষকলাই-এ, ১৫-৩৫%, ফেলনে ১৫-২৫%, বরবটিতে ২০-৩৫%, চিনাবাদামে ১৫-৪০% এবং সয়াবিনে ৭০-১৫০%।

জীবাণু সার পরিবেশ বান্ধব, মাটি, পানি ও বাতাসের উপর কোন প্রকার ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না। এ ছাড়া জীবাণু সার বিভিন্ন প্রকার প্রান রাসায়নিক পদার্থ নিঃসৃত করে যা ফসলের রোগ জীবাণু দমনে সহায়তা করে। জীবাণু সার প্রয়োগে গাছের ডালপালা, পাতা, নডিউল  ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়।

এগুলো পচে জৈব পদার্থ মাটিতে যুক্ত হয় ফলে নাইট্রোজেনসহ মুখ্য ও গৌণ উভয় প্রকার খাদ্যাপাদানের পরিমান বৃদ্ধি পায়। মাটিকে উর্বর করে এবং মাটির ভৌত ও রাসায়নিক অবস্থার উন্নতি হয়। মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে, পিএইচ মানের উন্নতি হয়, অম্লত্ব কমায় এতে মাটির স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটে ফলে পরবর্তি ফসলে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

গবেষণায় দেখা যায়, জীবাণু সার ব্যবহারকৃত ডার ফসলের পরবর্তি ধান ফসলে ১০-২৫% ইউরিয়া ব্যবহার কম করলে চলে। একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে সয়াবিন পরবর্তি বোনা আউশ ধানে ২৯% কম ইউরিয়া প্রয়োজন হয়।

এ ছাড়া ধান, গম ও অন্যান্য অলিগিউম তেল ও সবজি ফসলের শিকড়ে ও শিকড়   সংলগ্ন (রাইজোস্ফেয়ার) মাটিতে প্রচুর সংখ্যক নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী, ফসফেট দ্রবীভুতকারী, গ্রোথ হরমোন নিঃসরণকারী (মুক্তভাবে বসবাসকারী) ব্যাক্টেরিয়া থাকে।  এদেরকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পৃথকীকরণের মাধ্যমে তৈরী করা হয় এ সকল ফসলের জন্য জীবাণু সার।

এ গবেষণাও চলমান রয়েছে। এ জীবাণু সার ব্যবহারে ফসলের ১০-২০% পর্যন্ত ফলন বৃদ্ধি পেতে পারে। নাইট্রোজেন সংবন্ধন, ফসফেট দ্রবীভুতকরণ, গ্রোথ হরমোন উৎপাদন, রোগ জীবাণুকে দমন ইত্যাদির মাধ্যমে ফসলের ফলন বৃদ্ধি করে থাকে।  সাথে সাথে মাটিতে অবস্থিত উপকারী জীবাণুকে তাদের কাজে সহযোগিতা করে। এদের দেহ নিঃসৃত বিভিন্ন প্রান রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে মাটির ভৌত ও রাসায়নিক অবস্থার উন্নয়ন তরান্বিত করে ফলে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যও পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য অধিক পরিমান খাদ্য উৎপাদন তথা  ফলন ও নিবিড়তা বাড়ানো  হচ্ছে। পূর্বে যেখানে একটি ফসল ফলানো হতো সেখানে এখন উচ্চ ফলনশীল দু’টি, তিনটি এমনকি চারটি ফসল ফলানো হচ্ছে একই জমিতে।

ফলে মাটির স্বাস্থ্যের উপর যথেষ্ট চাপ পড়ছে। মাটির এ অধিক ফসল ফলানোর চাপ সহনের জন্য ক্ষতিকর প্রভাবযুক্ত রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে হবে। বিশে^র বিভিন্ন দেশে অর্গানিক ফার্মিং নামে রাসায়নিক সার বিহীন ফসল উৎপাদন ব্যবস্থা চালু হচ্ছ্।

নাইট্রোজেন সারের অধিক ব্যবহার মটির অম্লত্ব বৃদ্ধি করে যা মাটির মূখ্য উপাদানগুলোর বেশীর্ভাগের সহজ লভ্যতায় বাধা সৃষ্টি করে। নাইট্রোজেন চুয়ানির মাধ্যমে পানীয় জলের সাথে যুক্ত হয়ে তাকে দুষিত করে এবং পানের অযোগ্য করে তোলে।

মাটির উর্বরতা ও টেকসই ফসল উৎপাদনের জন্য এ রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব বৈশিষ্ট্যের জীবাণু সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। উপকার ভোগ অর্থাৎ ফসলের উৎপাদন বজায় রেখে এ রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমাতে হলে জীবাণু সারের ব্যবহার বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই।

লেখক: ড. মো. জহুরুল ইসলাম, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, বাংলাদেশ পরমাণু কুষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ।