রাজেকুল ইসলাম, রাণীনগর ( নওগাঁ) প্রতিনিধি: একেক ধরনের ফলের জন্য একেক এলাকার মাটি ও পরিবেশ বিশেষ উপযোগী হলেও পরিশ্রমের মাধ্যমে এই ধারণা পাল্টে দিয়েছেন নওগাঁর বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষেরা। প্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে নিরন্তর এগিয়ে যাচ্ছে তারা। বাণিজ্যিকভাবে পাহাড়ি ফল মাল্টা চাষে ঝুঁকছেন এখানকার চাষিরা

জেলা কৃষি বিভাগ জানায়, জেলার ১১ উপজেলার মধ্যে পোরশা, সাপাহার, নিয়ামতপুর, পত্নীতলা ও ধামইরহাট উপজেলায় বেশি মাল্টা চাষ হয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আদিবাসী অধ্যুষিত বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষরা বাণিজ্যিক ভাবে গড়ে তুলছেন মাল্টা, লেবু, বরই ও আমসহ নানা জাতের অধিক লাভজনক ফলের বাগান। এরমধ্যে পোরশায় পাঁচ বছর আগেও মাত্র একটি বাগান থাকলেও বর্তমানে উপজেলায় রয়েছে প্রায় ২০০টি মাল্টা বাগান।

বাগানে সারি সারি মাল্টা গাছ। ছোট ছোট গাছে ঝুলছে থোকা থোকা সবুজ মাল্টা। জেলার পোরশা উপজেলা মাল্টার চাষের জন্য ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। উপজেলার নিতপুর, ঘাটনগর, সরাইগাছী, তেঁতুলিয়া, বড়গ্রাম, তিলনা, গাঙ্গুরিয়া এলাকায় মাল্টা বাগানের সংখ্যা বেশি। বর্তমানে ১৫০জন বাগান মালিকের ২০০টির বেশি মাল্টা বাগান রয়েছে। এই সব বাগানে উৎপাদিত বিষমুক্ত মাল্টা নওগাঁর চাহিদা পূরণ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, একেকটি গাছে ১৫০-২০০ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত মাল্টা ধরে আছে। বাগানের প্রায় সব গাছের মাল্টাই পরিপক্ক হয়ে গেছে। গাঢ় সবুজ রঙের মাল্টাগুলোর কোনো কোনোটিতে হলুদাভ ভাব এসেছে। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, মাটির গুণাগুন মাল্টা চাষের উপযোগী হওয়ায় আকারে বড় ও সুমিষ্ট হওয়ায় এলাকার মাল্টা ব্যাপক জনপ্রিয়। ফলে আমের পর নওগাঁর বরেন্দ্র এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে মাল্টা চাষের বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

পোরশা উপজেলা সদরের মাল্টা বাগানের মালিক ওবায়দুল্লাহ শাহ জানান, উপজেলায় তিনিই প্রথম মাল্টা চাষ ২০১৬ সালে শুরু করেন। তিনি আগ্রহ দেখালে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তাকে বারি মাল্টা-১ জাতের ৬০টি মাল্টা গাছের চারা দিয়ে লাগানোর প্রস্তাব দেন। ওই চারা ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আনা একই জাতের আরও দেড় হাজার মাল্টা গাছের চারা লাগিয়ে উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে নিজের ৭ বিঘা জমিতে গড়ে তোলেন মাল্টার বাগান। এক বছরের মাথায় তার গাছগুলোতে ১০-১২টি করে ফল ধরে। পরের বছর গাছগুলোতে আরও ফল ধরে। এ বছর একটি গাছ থেকেই দেড় থেকে দুই মণ মাল্টা সংগ্রহ হবে বলে আশা করছেন তিনি।

এই চাষি আরোও জানান, চলতি বছর আরও ছয় বিঘা জমিতে নতুন করে মাল্টা বাগান গড়ে তুলেছেন। কিন্তু কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শে ওই বছরের মাল্টা পরিপক্ক হওয়ার আগেই ফেলে দেয়। যাতে গাছের পুষ্টিবৃদ্ধি হয়। বাণিজ্যিকভাবে ২০১৮ সাল থেকে বাগানের মাল্টা বিক্রি শুরু করেন। ওই বছর আড়াই লাখ টাকার মাল্টা বিক্রি করেন। গত বছর মাল্টা বিক্রি হয়েছে ৬লাখ টাকার।

মাল্টা বাগান করার পরিকল্পনার কথা জানালে প্রথমে এলাকার অনেকেই তাকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছেন। তার আত্মীয়-স্বজন ও গ্রামের অনেক মানুষই তখন বলেছিলেন এই এলাকার মাটি মাল্টা চাষের উপযোগী নয়। এখানে মাল্টা গাছ হবে না। গাছ হলেও এখানকার মাল্টা সুমিষ্ট হবে না। তারপরেও তিনি মাল্টা চাষের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেননি। সাহস করে বাগান করেছেন এবং তাদের সব কথা মিথ্যে প্রমাণ করেছেন। যারা তখন তাকে নিরুৎসাহিত করেছিলেন এখন তারাই মাল্টা চাষের জন্য তার কাছে পরামর্শ চাইতে আসেন। যোগ করেন এই সফল মাল্টা চাষি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পোরশা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহফুজ আলম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, মাল্টা চাষকে জনপ্রিয় করা গেলে একদিকে কৃষকেরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারবেন অন্যদিকে পুষ্টিকর এ ফল আমদানি নির্ভরতা কমবে। ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে এই এলাকার মাটির গুণাগুন মাল্টা চাষের উপযোগী। পাঁচ বছর আগেও মাত্র একটি বাগান ছিল। এখন উপজেলায় প্রায় ২০০টি মাল্টা বাগান। এখানকার উৎপাদিত মাল্টা বেশ সুমিষ্ট হওয়ায় স্থানীয় বাজারে এর ব্যাপক জনপ্রিয়তার সৃষ্টি হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো: সামছুল ওয়াদুদ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, নওগাঁ জেলা গত কয়েক বছর ধরে আম উৎপাদনে প্রথম স্থানে রয়েছে। প্রতি মৌসুমেই আমের বাগান বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি গড়ে উঠছে মাল্টা, লেবুসহ অন্যান্য অধিক লাভজনক ফলের বাগান। এই সব বাগান তৈরি করতে আগ্রহী ব্যক্তিদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে আসছি।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ