হাসান চৌধুরী লিটন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, এগ্রি এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ (বাকৃবি) এর প্রাক্তন শিক্ষার্থী জিল হোসেন এর বিষয় প্রায় কম বেশি সবারই জানা।

এতে ক্ষোভ ও ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন অনেকেই। বিশেষ করে জিল হোসেন এর সহপাঠি ও বাকৃবিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা লজ্জা প্রকাশের পাশাপাশি নানা মন্তব্য করেছেন। সেই সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বাকৃবির সাবেক শিক্ষার্থী ও গ্র্যাজুয়েট কৃষিবিদ হাসান চৌধুরী লিটন এগ্রিকেয়ার২৪.কম এ লিখেছেন।

আমার বাড়ী উত্তরবঙ্গে, গাইবান্ধা, গোবিন্দগঞ্জে। বড় ভাইয়ের চাকুরীর সুবাদে ১৯৭২ সালে ঢাকায় আসি। তখনও ঢাকা রংপুর সড়ক তেমনভাবে চালু হয়নি, ঢাকা আসার একমাত্র মাধ্যম ট্রেন। গ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে ২ দিন লাগতো।

প্রমত্ত যমুনা নদী দ্বারা বিভক্ত উত্তর জনপদের জনসাধারনের দৌড় ছিল সর্বচ্চ বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগ। উত্তরবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা ও সুযোগ সুবিধা ছিল পশ্চাৎপদ। গুটিকয়েক সৌভাগ্যবান ছাত্রছাত্রী উচ্চ শিক্ষার জন্য নিদেনপক্ষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেত, ঢাকা বা অন্য কোথাও পড়তে যাওয়ার কথা সে বা তার অভিভাবক চিন্তাও করতে পারতো না।

কিন্তু, ১৯৬৯ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার এক অজপাড়া গাঁ, চিলগাছা গ্রামের ছাত্র জিল হোসেন সাহস দেখায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অনুষদে ভর্তি হওয়ার, স্থান হয় হোসেইন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ৩২৪ নম্বর কক্ষে। শুরু হয় শিক্ষা জীবন।

সেই সময়ে ময়মনসিংহ আসার কোন সড়ক পথ ছিল না, প্রধান মাধ্যম ট্রেন ও সীমিত নদী পথ। বড় জানতে ইচ্ছে করে, ঐ সময় সিরাজগঞ্জ ও সমগ্র উত্তরবঙ্গ থেকে কয়জন ছাত্রছাত্রী উচ্চ শিক্ষার জন্য যমুনা নদী পার হয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৪ সালে সে অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা দেয়। রেজাল্ট হলে জানতে পারে মাত্র আধা নম্বরের জন্য ক্রপ বোটানিতে ফেল করেছে। সে ক্রপ বোটানিতে ৩৯.৫ পেয়েছিল (পাস মার্ক ৪০)। এই ভগ্নাংশকে পূর্ণ পয়েন্ট ধরে তাঁকে পাশ করে দেয়ার জন্য শিক্ষক থেকে শুরু করে প্রশাসনের সবার দাড়ে দাড়ে ঘুরেও লাভ হয়নি।

আমরা ১৯৮৬-৮৭ ব্যাচে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ঐ সময় পরীক্ষা পদ্ধতি ছিল, প্রতি বর্ষে প্রতি বিষয়ের থিওরির ১০০ মার্কের মধ্যে ১০ মার্ক করে ২ পিরিয়ডিক্যাল পরীক্ষায় ২০ মার্ক ও ফাইনালে ৮০ মার্ক এবং প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় একই ভাবে ৫০ মার্কের মধ্যে ১০ মার্ক ২ পিরিয়ডিক্যাল পরীক্ষায় ও ৪০ মার্ক বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষায়। পিরিয়ডিক্যাল পরীক্ষায় ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই ভগ্নাংশ মার্কিং হতো যা বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষায় পূর্ণ নম্বর হিসেবে যোগ হতো।

কিন্তু এই ব্যাপারটি জিল হোসেনের ব্যাপারে ব্যত্যয় ঘটে। শেষে বিষয়টি মেনে নিয়ে ১৯৭৫ সালে আবার পরীক্ষায় বসেন জিল হোসেন। কিন্তু মিথ্যা অজুহাতে তাঁকে পরীক্ষা থেকে এক্সপেলড করা হয়।

এই অন্যায় মেনে নিতে পারেন নি জিল হোসেন। অজ পাড়া গাঁ থেকে আসা একজন নিরীহ ছাত্র কতখানি বঞ্চিত হলে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস দেখায়? তিনি ১৯৭৫ সালে ময়মনসিংহ জেলা জজ আদালতে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

মামলা করার ৬ মাসের মাথায় জিল হোসেন মামলার রায় পান, বিজ্ঞ আদালত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জিল হোসেনকে পাশ করানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জেলা জজ আদালতে। বিজ্ঞ আদালত এই আপিল খারিজ করে আগের রায় বহাল রাখেন। এইবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আপিল করে উচ্চ আদালতে।

জিল হোসেন উচ্চ আদালতে ৬ বার রায় পান, শেষ পর্যন্ত ১৯৮৩ সালে উচ্চ আদালত জিল হোসেনকে পাশ করে দেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।

রায় পাওয়ার পর জিল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাড়ে দাড়ে ঘোরেন, সব জায়গায় পান চরম উপহাস ও অপমান। শেষে ১৯৯৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জিল হোসেনকে পাশ ঘোষণা করে মার্কসীট প্রদান করে। কিন্তু এর মধ্যে কেটে গেছে শিক্ষা জীবন, অর্থ উপার্জন ও সামাজিক মর্যাদার প্রতি পদে পদে বঞ্চনার শিকার জিল হোসেনের ২৩ টি বছর।

জিল হোসেন তাঁর এই অধিকার আদায়ের লড়াইয়ের খরচ যোগাতে বিক্রি করতে বাধ্য হন তাঁর পৈত্রিক সব জমি। প্রায় ৫০/৬০ লক্ষ টাকা ব্যয় করতে হয় মামলার পিছনে। ১৯৯৭ সালে পাশের স্বীকৃতি পাওয়ার পর ২০০০ সালে ২ কোটি টাকার ক্ষতি পূরণ মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

দীর্ঘ ৮ বছর আইনি লড়াইয়ের পরে ২০০৮ সালে রায় পান জিল হোসেন। বিজ্ঞ আদালত জিল হোসেনকে ২ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করার জন্য নির্দেশ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্টার ও ডীনকে।

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই রায় মানতে নারাজ, তাঁরা আপীল করে উচ্চ আদালতে। প্রভাব ও অর্থ ব্যয় করে মামলা বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করে, মামলার শুরু থেকে নিয়োগ দেয় দেশ বরেণ্য নামকরা দামী দামী সব ব্যারিস্টারদের, তাঁদের পিছনে খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটি কোটি টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে অপরাধ করেছিল, সেটা ধামাচাপা ও জায়েজ করার জন্য মুক্ত হস্তে খরচ করেছিল এবং এখনও করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ।

৪৪ বছর আগে হওয়া এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়া জিল হোসেন ২০০৮ সালে ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে এখন অচল প্রায়। জীবনের শেষ লগ্নে এসেও পরাজয় মানতে নারাজ।

যমুনা টিভিতে এই প্রতিবেদন দেখানো না হলে হয়ত আমরা এতো বড় অন্যায়ের কথা জানতে পারতাম না। তাঁর প্রাপ্য তাঁকে দেয়ার জন্য আজ মিছিল হচ্ছে, ফেসবুকে প্রতিবাদ হচ্ছে, হচ্ছে মানব বন্ধন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষ অনড়, তাঁরা তাঁদের করা অন্যায়কেই প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন।

হয়ত একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হবে, হয়ত সেদিন জিল হোসেন বেঁচে থাকবেন না। জীবিত কাউকে আমরা স্বীকৃতি দিতে চাই না, আমরা মরণোত্তর স্বীকৃতিতে বিশ্বাসী।

জিল হোসেন, আপনার জীবদ্দশায় হয়ত আপনি এই লড়াইয়ের জয় দেখে যেতে পারবেন না, কিন্তু আপনি আপনার সর্বস্ব দিয়ে শেষ পর্যন্ত অধিকার আদায়ের যে যুদ্ধ করেছেন, তা আজ সবার কাছে উদাহরণ।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্র্যাজুয়েট হিসেবে আপনার প্রতি করা অন্যায়ের জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।