মাহফুজার রহমান মাহফুজ, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: স্বামী সংসার নিয়ে ঘরের কাজের মধ্য সময় চলে যাবে এমন স্বপ্নে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন আকলিমা। কিন্তু তিন সন্তান রেখে স্বামীর ছেড়ে যাওয়ায় বড় হোঁচট খান তিনি। চরম সঙ্কটের মধ্যে দিন যেতে থাকে তার। সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। অবশেষে বাদাম ভুট্টা ধান চাষে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন আকলিমা।

কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার শিমুলবাড়ী ইউনিয়নের চরপেচাই গ্রামের বাসিন্দা আকলিমা বেগমের (৪০) গল্প যেন রুপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। তিনি জানান, তার বিয়ে হয়েছে ২০ বছর আগে। তিন সন্তানের মা আকলিমা ওই এলাকার তহিদুল ইসলামের স্ত্রী। স্বামী তহিদুল দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালালেও অভাব তাদের নিত্য সঙ্গী ছিলো। অভাবের কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রায় সময় ঝগড়া বিবাদ চলতো। তারপরেও স্ত্রী আকলিমা স্বামীর কথায় তেমন কিছু মনে করতেন না।

আকলিমা বলেন, তিন সন্তানকে মানুষ করার লক্ষে সমস্ত দোষ শিকার করেই স্বামীর সংসারে মানিয়ে চলতাম। কিন্তু স্ত্রী-সন্তানের মায়া ত্যাগ করে অন্য জায়গায় গিয়ে নতুন করে সংসার পাতেন তার স্বামী। টানা ৬ মাস স্বামী তহিদুলের পথ চেয়ে থাকলেও তাদের খোঁজ খবর নেয় নি তহিদুল। এরপর আকলিমা স্বামীর ভিটা ছেড়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে তিন সন্তানকে নিয়ে একই এলাকায় ভাইয়ের বাড়ীতে আসেন।

আরও পড়ুন: সয়াবিনে ১৪ টাকা কমিয়ে ১৫ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব

সংসারের হাল ধরতে তিন সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে একজন কৃষক হিসেবে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়েন আকলিমা। ভাইয়ের বাড়ীতে থেকে আকলিমা বেগম কৃষি কাজে মনোযোগ দেন। ভাইয়ের সহযোগীতায় চরপেচাই এলাকায় অন্যের জমি লিজ নিয়ে বাদাম, ভুট্টা ও ধানের চাষাবাদ করছেন।

আকলিমার বড় ছেলে রায়হান (১৮)। সংসারে অভাব থাকায় ৭ম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ালেখা করেই সমাপ্তি ঘটে তার পড়াশোনার। বর্তমানে বড় ছেলে রায়হান মা আকলিমার খেতের কাজে সহযোগীতা করে। দ্বিতীয় ছেলে রাকিবুল হাসান ৫ম শ্রেনী ও ছোট মেয়ে প্রথম শ্রেণিতে পড়েন।

আলাপকালে জানা যায়, আকলিমা বেগম এ বছর দেড় বিঘা জমিতে বাদাম ও দেড় বিঘা জমিতে ধান চাষাবাদ করেছেন। নিজের জমি না থাকলেও তিনি অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করে গত ৫ বছর ধরে অনেকটা স্বচ্ছল ভাবে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। পুরুষ চাষিদের সাথে পাল্লা দিয়ে একজন নারী হয়েও চাষাবাদ করছেন। তিনি গত ৫ বছর ধরে বাদাম, ভুট্টা ও ধানের চাষাবাদ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।

প্রতিবেশিরা জানান, এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আকলিমা বেগমের বাদাম ও ধানের ফলন ভালই দেখা যাচ্ছে। আকলিমা বেগমের বাদাম খেত দেখলেই মন জুড়িয়ে যায়। শুধু বাদাম নয় তার আমন ধানের খেত দেখলেও বুঝা যায় তিনি একজন জাত চাষি। উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে শতশত বিঘা জমিতে বাদাম চাষ করেছেন চাষিরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এ বছর বাদামের ভালো ফলন আসবে এমনটাই আশা চাষিদের।

আকলিমা বেগম বলেন, আমার স্বামী ৫ বছর ধরে কোন খোঁজ খবর রাখেনি। দুই ছেলে ও ১ মেয়েসহ চারজনের পরিবারের চাহিদা মেটাতে চাষাবাদ করি। কিছু জমাতে না পারলেও স্বচ্ছল ভাবে জীবিকা নির্বাহ করছি। এক দিকে স্বামী থেকেও নেই, অন্য দিকে অভাবের কারণে বড় ছেলের পড়ালেখা বন্ধ হয়েছে। তাই বড় ছেলেসহ আমি খেতে কাজ-কাম করে ছোট ছেলে ও মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি।

সবার কাছে দোয়া চেয়ে এ সংগ্রামী নারী বলেন, আমাদের জন্য দোয়া করবেন আমি যেন দুই সন্তানের পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারি। মানুষের মত মানুষ করতে পারি। আকলিমা আরও জানান, এখন আমার স্বামী না আসলেও কোন সমস্যা নেই। জায়গা জমি না থাকলেও ভাইয়েরা আমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সব সময় ভাইয়েরা খোঁজ খবর নেন। কৃষি কাজেও ভাইয়েরা অনেক সহযোগীতা করেন। আমি এভাবেই আজীবন কৃষি কাজ করে তিন সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

এ সময়ে তিনি উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষি কাজের সব ধরণের সহযোগিতার জন্য সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন। আকলিমার ভাই ফজর আলী বলেন, আমার ছোট বোন আকলিমা খুবই পরিশ্রমী। তিন চার বিঘা জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফসল ফলান। চাষাবাদ করতে কোন প্রকার শ্রমিক নেয় না। সব কাজই সে নিজেই করে। মাঝে মধ্যে তার বড় ছেলে একটু সহযোগীতা করেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি হাঁস, মুরগী ও ছাগলও লালন পালন করেন। এভাবেই মাঠে ময়দানে লড়াই সংগ্রাম করেই যাচ্ছে আকলিমা।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন জানান, আকলিমার মতো নারীরা কৃষি কাজে এগিয়ে আসলে কৃষিতে আমূল পরিবর্তন আসবে। সেই সাথে কৃষি প্রধান দেশ হিসাবে নারীদের যেমন কৃষির উপর আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে, অন্য দিকে বাড়বে কৃষি উৎপাদন। কৃষি বিভাগ থেকে আকলিমাকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাদাম ভুট্টা ধান চাষে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন আকলিমা এমন সংবাদে অনেক নারী উৎসাহিত হবেন।