সজিবুল হৃদয় ও ফারহানুর রহমান, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: নাটোরের লালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল জোন এলাকায় প্রায় ৪০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাঠে রেখেই মাত্র ৫২ কর্মদিবসে মাড়াই বন্ধের ঘোষণা দিলো মিল কর্তৃপক্ষ। চলতি মৌসুমে আখের সরবরাহ না পাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়ে শত কোটি টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে সোমবার মাইকিং করে আগামী ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত মাড়াইয়ের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ।

এর আগে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই বন্ধ করতে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসময় অভিযান বন্ধ করতে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে প্রসাশনের ওপর চড়াও হয় দিলালপুর গ্রামের মানুষ। পরে থানা পুলিশের সহায়তায় পাওয়ার ক্রাশার জব্দ ও জরিমানা করা হয়েছে।

★ ক্রাশার বন্ধের অভিযানে প্রশাসনের ওপর চড়াও গ্রামবাসী
★ আমরা চায় ঐতিহবাহী চিনিকলটি বেঁচে থাকুক: ইউএনও
★ প্রশাসনের বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন

আবার লালপুর জুড়ে ‘অবৈধভাবে পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই বন্ধ করতে অভিযান’ করার নামে প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেছে ক্ষুদ্র গুড় ব্যবসায়ীরা।

গত শনিবার (১৪ জানুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টায় উপজেলার দিলালপুর এলাকায় কয়েকশ ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে আখ মাড়াইয়ের ঘোষনা দেন। এবং প্রশাসন এবার বাধাঁ দিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলার হুশিয়ারি দেন।

নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস কেন্দ্রিক একেক পর এক এমন ঘটনায় লালপুর জুড়েই এসব নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা। তৈরি হয়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

স্থানীয় কৃষকরা জানান, মিলে আখ সরবরাহ করে ঠিকমতো টাকা পাওয়া যায় না। ভোগান্তিতে পড়তে হয়। তাছাড়া মিলের চেয়ে মাড়াইকলে বেশি দামে আখ বিক্রি হয়। অনেক সময় অগ্রিম টাকা পাওয়া যায়। যার ফলে মিলে আখ না দিয়ে পাওয়ার ক্রাশারে আখ দিতে সবাই আগ্রহী হচ্ছে কৃষকরা।

আর চিনিকল জোন এলাকায় পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই নিষিদ্ধ থাকায় এসব পাওয়ার ক্রাশার বন্ধে মাঠে নামে প্রশাসন। এতেই বাঁধে বিপত্তি। গত শনিবার (৭ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস জোন এলাকার ওয়ালিয়া ইউনিয়নের দিলালপুর-রায়পুর গ্রামে অবৈধভাবে পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াই বন্ধ করতে অভিযান চালায় প্রশাসন। প্রশাসনের উপস্থিতি টের পেয়ে স্থানীয় মসজিদের মাইকে উস্কানিমূলক ঘোষনা দিয়ে এলাকাবাসী প্রশাসনের লোকজনের ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা চালায় বলে গণমাধ্যমকে জানান নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম-কৃষি) আসহাব উদ্দিন।

তাৎক্ষণিক থানায় খবর দিলে স্থানীয় চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপ ও অতিরিক্ত পুলিশের সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এ সময় তিনিসহ সহকারী কমিশনার (ভূমি) দেবাশীষ বসাক, নাটোর ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান তানভির, মিলের জিএম (প্রশাসন) মুস্তফা সারোয়ার উপস্থিত ছিলেন বলেও জানান।

★ চিনিকলের ঋণের পরিমাণ ছাড়িছে শত কোটি টাকা
★ দূর্নীতি বন্ধ করতে পারলে চিনি শিল্প লাভজনক হবে: শিল্প প্রতিমন্ত্রী
★ চিনিকলকে ধ্বংস করতে চান গুড় ব্যবসায়ীরা: এমডি আনিসুল আজম

সহকারী কমিশনার (ভূমি) দেবাশীষ বসাক বলেন, প্রথমে এলাকার দুঃষ্কৃতিকারীরা সরকারি কাজে বাধা প্রদান করেন। পরবর্তীতে স্থানীয় চেয়ারম্যান জনগনের পক্ষে ক্ষমা চেয়ে পুলিশ ও প্রশাসনের সহায়তায় সফল অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় ৫টি মাড়াইকলে অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং ওই গ্রামের চিয়ামত আলীর ছেলে মো. মাহবুল হোসেনের মাড়াইকল জব্দসহ দুজনকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

এদিকে এঘটনাকে প্রশাসনের সেচ্ছাচারিতা অ্যাখা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন দিলালপুরের ক্ষুদ্র গুড় ব্যবসায়ীরা।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যানের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হক, রবিউল ইসলাম, আলাউদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ প্রমূখ।

লিখিত বক্তব্যে গুড় ব্যবসায়ীরা জানান – দেশের উন্নয়নে ও পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে বিসিকের নিবন্ধন ও ট্রাকিং আইডি, বিএসটিআইয়ের অনুমোদন, স্থানীয় সরকারের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে বৈধ ভাবে আখ ও গুড়ের ব্যবসা করছি। অথচ নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন যৌথ অভিযানের নামে সরকারের ভ্যাট ট্যাক্স পরিশোধ করা সত্তেও কাগজ পত্র না দেখে আমাদের জিম্মি করে মারধর করে এবং গুড় তৈরি কারখানায় ভাংচুর করে পাওয়ার ক্রাশার জব্দ করে।

তারা আরো জানান, নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল তার নিজেস্ব কয়েক হাজার বিঘা জমি লিজ দিয়েছেন মানুষকে। এসব জমিতে আখ চাষ না করে আলু, গম, মশুর ডাল চাষ করছে। আর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে ১৮০ টাকা মণে আখ বিক্রি করলেও চিনিকল কতৃপক্ষ ঠিকমত আখের মূল্য পরিশোধ করে না। অথচ গুড় ব্যবসায়ীরা ৩০০ টাকা মণে আখ ক্রয় করে নগদ টাকা প্রদান করে। তাই ক্ষুদ্র শিল্প গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে মিলের চেয়ে বেশি মূল্যে আখ বিক্রয় করেছে চাষিরা। স্বাধীন দেশে আখচাষিরা নিজের জমিতে আখ চাষ করে কোথায় বিক্রি করবে সেই স্বাধীনতা চিনিকল কতৃপক্ষ হরণ করছে। আবার উল্টো চিনিকল কতৃপক্ষ ক্ষুদ্র গুড় ব্যবসায়ীদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালাচ্ছে। আমরা ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।

এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীমা সুলতানা বলেন, সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী অবৈধ পাওয়ার ক্রাশার বন্ধ করার জন্য নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। এখন আইনগত প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে কেউ বেআইনি ভাবে প্রতিবাদ জানালে বিষয়টি দুঃখজনক। এতো বড় একটা ঐতিহ্য বাহী ইন্ডাস্ট্রি আমাদের গর্ব। এখান থেকে অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে এলাকাবাসী ও আমাদের সব সময়ই সহযোগিতা থাকে। আমরা সকলেই চাই লালপুরে ভারি শিল্প ঐতিহ্যবাহী চিনিকলটি বেঁচে থাকুক।

এদিকে সংবাদ সম্মেলন থেকে পূনারায় পাওয়ার ক্রাশারের আখ মাড়াইয়ের ঘোষণা দেন। পাশাপাশি এবার প্রশাসন কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে প্রতিরোধের ঘোষনা আসে দিলালপুরের গুড় ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের থেকে। আর এতে লালপুরের বিভিন্ন এলাকার পাওয়ার ক্রাশার মালিক, গুড় ব্যবসায়ী ও আখের সাথে সংশ্লিষ্টরা এ আন্দোলনে একাত্মা প্রকাশ করেন। ফলে এ আন্দোলন উপজেলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা কথা জানিয়েছেন উত্তরবঙ্গ আখচাষি সমিতির সভাপতি ইব্রাহীম খলিল।

তবে এবিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হন নি লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহা. মোনোয়ারুজ্জামান। তিনি বলেন, কেউ আইন অমান্য করলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে

চিনিকল সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে মিল এলাকায় ১৮ হাজার ১০০ একর জমিতে দুই লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন আখ উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে এক লাখ ৪০ মেট্রিক টন আখ মাড়াইয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার নির্ধারণ করা হয় ৯ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। চিনি আহরণের হার ধরা হয় শতকরা ৭ ভাগ

তবে লক্ষমাত্রা পূরণে ব্যর্থতার পাশাপাশি নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের ইতিহাসে এবছর সবচেয়ে কম আখ মাড়াই হয়েছে।

চলতি মৌসুমে ৫২ কর্মদিবসে (১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত) এই মিলে মাড়াই করা হয়েছে প্রায় ৮১ হাজার ৮৪০ মেট্রিক টন আখ। চিনি উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় চার হাজার ২০০ মেট্রিক টন। চিনি আহরণের হার ছিল শতকরা ৫ দশমিক ৩৪ ভাগ।

এবিষয়ে মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিসুল আজম বলেন, চলতি মৌসুমে পর্যাপ্ত আখ উৎপাদনে চাষিদের সার-বীজ দিয়ে সহায়তা করা হয়। কিন্তু তারা আখ সরবরাহ না করায় কষ্ট নিয়ে মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছি। তবে মিলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আখের দাম বাড়ানোসহ বিভিন্ন দাবির ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক। আশা করি, মিল এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের কথা ভেবে চাষিরা আগামীতে বেশি বেশি আখ মিলে সরবরাহ করবেন।
তিনি আরো বলেন, গুড় ব্যবসায়ীরা চান সরকারি চিনিকলটি বন্ধ হয়ে যাক

চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলে গুড় ব্যবসায়ীরা আখ চাষিদের জিম্মি করে কম মূল্য আখ ক্রয় করতে পারবে। তাই প্রান্তিক চাষিরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য কৃষি বান্ধব সরকার লোকসানের পরও সরকারি চিনিকলটি টিকিয়ে রেখেছে। এ চিনিকলকে ধ্বংস করতে কিছু গুড় ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে থেকে ঝণ নেওয়া আখ চাষিদের থেকে উচ্চ মূল্য আখ ক্রয় করে মাড়াই করেছে। এতে সরকারি সম্পদ ধ্বংসের মুখে চলে যাচ্ছে। আর প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে গেলে চিনিকল সংশ্লিষ্ট এতগুলো লোক কর্মহীন হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।

এছাড়া গত ২৫ নভেম্বর ২০২২-২০২৩ মাড়াই মৌসুমের উদ্বেধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আরিফুর রহমান অপুর সভাপতিত্বে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বলেন, স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এক সময় এ দেশের শিল্প কারখানা পানির দরে বিক্রি করে দিয়েছিল। তাদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ নেই। তাই বর্তমান সরকারের এ উন্নয়ন তারা সহ্য করতে পারছে না। তাদের সঙ্গে বিদেশিরাও সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের ষড়যন্ত্র রুখে দেবে।

শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, চিনি শিল্পকে লাভজনক করতে চিনিকলে কর্মরত অতিরিক্ত কর্মকর্তার সংখ্যা কমানো হবে, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। সরকার কৃষি যান্ত্রিকিকরণের পদক্ষেপ গ্রহন করেছে। এর মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দূর্নীতি বন্ধ করতে পারলে চিনি শিল্প লাভজনক পর্যায়ে যাবে।