মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে আমের

ফসল ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে আমের ফলন প্রাক্কলন শিরোনামে প্রবন্ধটি লিখেছেন ড. মো. সেলিম উদ্দীন, ড. মো. শরফ উদ্দিন ও শামীম আরা বেগম। তারা তিনজনই বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এর ঊর্ধতন কৃষি বিজ্ঞানী ও গবেষক।

কৃষি সহজীকরণের জন্য কৃষি যান্ত্রিীকরণের বিকল্প নেই। আপনারা হয়ত বা জেনে থাকবেন, আমের বাগান ১-১০ বছরের জন্য কেনাবেঁচা হয়। আবার এক মৌসুমেই ৩-৪ বার কেনাবেঁচা হয়ে থাকে।

কিন্তু করোনা প্রভাব শুরু হওয়ার জন্য এ বছর আম বাগান কেনাবেঁচা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের ব্যবসায়ীরা অনুমান করে আম বাগানগুলো কিনে থাকেন। এক সাথে দল বেঁধে কয়েকজন আমগাছকে তারা করেন পরে বাগান মালিকের সাথে দরদাম করে আম গাছ, আম বাগান, ক্রয় করেন।

কিন্তু এই বছর জনগণের চলাচল বাধা, করোনা আতঙ্ক, আম বাজার নিয়ে দুশ্চিন্তা সব কিছুর ফলে আম বাগানগুলো অবিবক্রিত রয়েছে। আম গাছ থাকা অবস্থায় আমের ফলন অনুমান করা ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। কিন্তু বর্তমানে মোবাইল অ্যাপসস ব্যবহার করে আমের ফলন নিরূপণ করা যায়। যা আম বাগান কেনাবেচার কাজে অনেক সহায়ক হতে পারে।

আম এদেশের একটি গুরুত্বপূর্ন অর্থকরী ফসল। ছোট-বড় সকলের নিকট পছন্দনীয় একটি ফল। দেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে আম গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখছে। বর্তমানে আম উৎপাদনে বাংলাদেশ সপ্তম অবস্থানে। আমের প্রধান চাষাবাদ চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী জেলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

কিন্তু বর্তমানে দেশের ২৩ জেলাই আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। আম উৎপাদনকারী প্রধান জেলাগুলো হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, কষ্টিয়া, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, টাঙ্গাইল, জামালপুর, মেহেরপুর, ঝিনাইদাহ, দর্শনা, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, যশোর, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান।

প্রতি বছর বাড়ছে আম চাষাবাদের এলাকা এবং সেই সাথে বাড়ছে আমের ফলন। বিবিএস, ২০১৮ অনুযায়ী এদেশে ৪১৬৭৬ হেক্টর জমিতে আমের চাষাবাদ হচ্ছে এবং উৎপাদিত আমের পরিমাণ ১২.৮৮ লাখ মেট্রিকটন। এদেশে প্রতি বছর নতুন আমের বাগান সম্প্রসারিত হচ্ছে।

ধানের নায্যমূল্য নিশ্চিত না হওয়ার কারণে ধানচাষিরা ঝুকছেন আম চাষের উপর। আম গবেষকরা চেষ্ঠা চালিয়া যাচ্ছেন প্রতি বছর ফলপ্রদানকারী নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতি বছর ফলদানকারী ১২ টি জাত উদ্ভাবন করেছেন।

উদ্ভাবিত জাতগুলো বিভিন্ন জেলায় বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। আমের গুণগতমান নিশ্চিত করণের জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছে আমের আধুনিক উৎপাদন কলাকৌশল যার মধ্যে সার ব্যবস্থাপনা, সেচ ব্যবস্থাপনা, রোগবালাই ও পোকামাকড় দমন ব্যবস্থাপনা। আমকে শতভাগ মাছি পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য এবং আমে বালাইনাশকের ব্যবহার কমাতে উদ্ভাবন করা হয়েছে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি।

আমচাষিকে সব ধরণের সহযোগিতা প্রদানের জন্য মাঠ পর্যায়ে কর্মরত আছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দক্ষ জনবল। ফলে আমচাষিরা আমের ভালোফলন পাচ্ছেন। তবে কখনও কখনও আমের নায্যমূল্য পাওয়া থেকে বিরত থাকেন। এই বিষয়টি নিয়েও গবেষকরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আমের কেনাবেচা কিন্তু অন্য ফল ফসলের মতো নয়। বহুবর্ষজীবি হওয়ায় এক বাগান কয়েকবার কেনাবেচা হয়। কোন কোন সময় দেখা যায়, এক মৌসুমেই কয়েকবার হাত বদল হয়। আবার কেউ কেউ ৩-৫ বছরের বা দীর্ঘ মেয়াদের জন্য আমবাগান বিক্রি করে থাকেন।

যখনই আম বাগান কেনাবেচা হয় তারা কিন্তু আমের ফলন অনুমান করতে ক্রেতাগণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে থাকেন। ফলে ক্রেতা-বিক্রেতার দামাদামি করার তেমন সুযোগ থাকে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন উপায় ছিলনা আমবাগান মালিকদের। আমবাগান কেনাবেচায় মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কোন ভাবেই কমানো সম্ভব হচ্ছিল না।

কৃষি গবেষকরা এই বিষয়ে অবগত ছিলেন কিন্তু সমাধানের তেমন কোন উপায় তাদের হাতে ছিল না। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মার্ণে রূপকল্প-২০২১ সামনে রেখে কৃষির বিভিন্ন সেক্টরে বিভিন্ন অ্যাপসের ব্যবহার শুরু হয়েছে।

বারি উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোকে হাতের মুঠোই আনতে উদ্ভাবন করা হয়েছে মোবাইল ভিত্তিক অ্যাপস ‘কৃষি প্রযুক্তি ভান্ডার’।

এই অ্যাপস ব্যবহার করে পৃথিবীর যে কোন জায়গা থেকে বারি উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। চাষি ভাইয়েরা ইচ্ছে করলেই ঘরে বসে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট হতে উদ্ভাবিত যে কোন ফল-ফসলের চাষবাস, পরিচর্যা, রোগ-বালাই দমন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

আমবাগান কেনাবেঁচায় আমের ফলন নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন থেকে মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে আগাম জানা যাবে আমের ফলন। ইমেজ এনালাইসিসের মাধ্যমে যে কোন জাতের ফলন আগাম নির্নয় করা সম্ভব হবে।

এই অ্যাপস দিয়ে আমের ফলন প্রাক্কলন করতে প্রয়োজন হবে আমসহ গাছের ছবি, এই ছবি এনালাইসিস করে আমের সংখ্যা বের করা হবে। আমগাছের বয়স অনেক বেশি হলে বা ক্যানোপির বিস্তার বেশি হলে একটি গাছের কয়েকটি ইমেজ নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এরপর প্রত্যেক জাতের আমের গড় ওজন দিয়ে গুন করলে ফলন বের হবে।

এই ম্যাগো অ্যাপস ব্যবহার করে অত্যন্ত স্বল্প খরচে ও কম সময়ে অনেকাংশে নির্ভুলভাবে আমের ফলন প্রাক্কলন সম্ভব হবে। অথচ বর্তমানে আম গাছের ফলন প্রাক্কলনের প্রধান ও একমাত্র উপায় হলো প্রতিটি গাছের আম গননা করেপ্রাপ্ত সংখ্যাকে প্রত্যেক জাতের গড় ওজন দিয়ে গুন করে ফলন প্রাক্কলন করা হয়।

বাগানের মালিক এই ভাবে ফলন বের করার দুঃসাহস কখনও করেন না। শুধুমাত্র দালাল বা ফড়িয়ারা এইভাবে আমের ফলন অনুমান করে আম বাগান ক্রয় করে থাকেন। ফলে আমবাগান মালিক বা আমচাষির ক্ষতির সম্ভবনা বেশি থাকে।

অপরপক্ষে দালাল বা ফড়িয়াদের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। শুধু তাই নয়, এই প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে সারাদেশের আমের ফলন ও নির্নয় করা সম্ভব। বর্তমানে দেখা যায়, এক বছর আমের দাম বেশি হয় এবং অন্য বছর একবারে দাম কমে যায়।

দেশের আগাম ফলন জানা থাকলে আম সংরক্ষন, বাজারজাতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রপ্তানি বিষয়ে সঠিক পরিকল্পনা করা সম্ভব। বিবিএস এর তথ্য বিশ্লেষন করে পরিকল্পনা করলে তা তেমন কাজে আসবে না। এমতাবস্থায়, বারি উদ্ভাবিত ম্যাংগো অ্যাপস (http://bariprecisionagriculture.org/) ব্যবহারের মাধ্যমে প্রতিটি আম গাছের ফলন, প্রতিটি বাগানের ফলন সঠিকভাবে প্রাক্কলন করা সম্ভব। প্রাপ্ত প্রাক্কলিত ফলনের উপর ভিত্তি করে আম বাগান কেনা-বেচা করে আম বাগান মালিক, কৃষক, আড়ৎদার, বাগানক্রেতা সকলেই প্রতারণার হাত হতে রক্ষা পাবেন।

এদেশে উৎপাদিত আমের সম্ভাবনা অনেক। দেশিয় ও বিদেশি বাজারে ক্রমাগতভাবে বাড়ছে সুস্বাদু আমের চাহিদা। এমতাবস্থায়, আম চাষ, আমের ব্যবসা লাভজনক হোক এমনটিই প্রত্যাশা করছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।

মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে আমের ফলন প্রাক্কলন শিরোনামের লেখক পরিচয় হলো: ড. মো. সেলিম উদ্দীন এসএসও, পিজিআরসি, ড. মো. শরফ উদ্দিন এসএসও, ফল বিভাগ, এইচআরসি এবং ও শামীম আরা বেগম এসএসও, বীজ প্রযুক্তি বিভাগ বারি, জয়দেবপুর, গাজীপুর। লেখাটি সংগ্রহ করা হয়েছে কৃষি তথ্য সার্ভিস এর কৃষিকথা থেকে।

আরও পড়ুন: চাঁপাইনবাবগঞ্জকে ছাড়িয়ে আম উৎপাদনে শীর্ষে নওগাঁ