পোল্ট্রি ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: মুরগির বদঅভ্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং ক্ষতিকর হলো ক্যানাবলিজম। এটা যে কোনো বয়সের মুরগির হতে পারে। যেসব কারণে মুরগির ক্যানাবলিজম হয়ে থাকে।

এটা খুবই ব্যয়বহুল সমস্যা, যা খামারির ক্ষতি সাধন করে থাকে কিন্তু অনেক সময় খামারি তা বুঝতে পারেন না।

ক্যানাবলিজমের কয়েকটা ভাগ রয়েছে-

১. ভেন্ট পিকিং
২. ফিদার পিকিং
৩. টই পিকিং

ভেন্ট পিকিং : এটা মূলত বড় মুরগির ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায় এবং লেয়ার মুরগির বদঅভ্যাস। এ অভ্যাসের কারণে মুরগির পায়ুপথের নরম মাংশে আঘাত করে রক্ত গ্রহণ করে। এর ফলে মুরগির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয় এবং মুরগির উৎপাদন কমে যায়। অনেক সময় এর ফলে মুরগির মৃত্যও ঘটে থাকে। আর মুরগি যদি একবার রক্তের স্বাদ পায় তাহলে সে অন্য মুরগিকে ঠোকরাতে থাকে এবং এ অভ্যাসটা পুরো ফ্লকে ছড়িয়ে পড়ে।

নিম্নোক্ত এক বা একাধিক/ যেসব কারণে মুরগির ক্যানাবলিজম হয়ে থাকে-

১. দীর্ঘক্ষণ না খাইয়ে রাখা : মুরগিকে তার প্রয়োজনীয় খাবার সময় মতো খাবার দিতে হয়। দীর্ঘক্ষণ খাবার ছাড়া থাকলে মুরগির ভেতরে ফেদার পিকিং এর প্রবণতা বেড়ে যায়। খাবারের তাগিদে তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে।

২. অতিরিক্ত তাপ : যখন মুরগির খামারে অসহ্য গরম দেখা যায় তখন মুরগির মধ্যে ক্যানাবলিজম মারাত্মক আকারে লক্ষ করা যায়। অতিরিক্ত তাপের ফলে মুরগির বিপাকক্রিয়া ভালো হয় না। যার ফলে মুরগির খাদ্যের প্রতি অনীহা দেখা যায়। গরমে একে অপরের সঙ্গে হিংসাত্মক ভাব প্রদর্শন করে। যার ফলে এক মুরগি অন্য মুরগিকে ঠোকর মারতে থাকে।

৩. অপর্যাপ্ত খাদ্য ও পানির পাত্র : মুরগির জন্য সর্বদা পানির সরবরাহ রাখতে হয়। মুরগি তার প্রয়োজন মতো পানি পান করতে থাকে। পানিপাত্রের অভাব হলে মুরগির মধ্যে হিংসাত্মক ভাব প্রকাশ পায়। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পানি ও খাদ্য গ্রহণ করে। আর এসব অবস্থার জন্য মুরগির মধ্যে ক্যানাবলিজমের প্রভাব বেড়ে যায়।

৪. মুরগিকে শুধুমাত্র দানাদার খাদ্য খাওয়ানো : মুরগির খাদ্যে পিলেট ও ম্যাস উভয়ের মিশ্রণ থাকা খুব জরুরি। শুধু দানাদার খাদ্য খাওয়ালে মুরগির মধ্যে কিছু বদঅভ্যাস সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে ক্যানাবলিজম ও অন্যতম। মুরগির দানাদার খাদ্য খেতে খেতে ঠোকরানো প্রভাব বেশি হতে থাকে। তাই পরিমিত দানাদার ও ম্যাস ফিড (গুঁড়া খাবার) খাওয়ানো উত্তম।

আরোও পড়ুন:মুরগির পায়খানা দেখে রোগ নির্ণয় পদ্ধতি

মুরগির চুনা পায়খানা ও গলা খক খক করা রোগের সমাধান

. খাঁচায় অবস্থান সংকট : খাঁচায় মুরগি পালন করা হলে নিয়মমতো মুরগির জন্য স্থান প্রয়োজন। আর খাঁচায় যদি মুরগি পালন কালে জায়গার ঘাটতি পড়ে তাহলে খাদ্যের ঘাটতির সঙ্গে মুরগির প্রতিযোগিতা স্বরূপ একে অপরের সঙ্গে মারামারিসহ ঠোকরানো শুরু করে। ফলে ক্যানাবলিজমের প্রভাব বাড়তে থাকে।

৬. সময়মতো সঠিক চিকিৎসার অভাব হলে : মুরগি কোনো জীবাণু বা কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হলে চিকিৎসার প্রয়োজন। অন্তত তাকে আলাদাকরণ খুব প্রয়োজন। আর এ চিকিৎসার যদি কোনো ঘাটতি হয় এবং যদি দেরি হয় তাহলে অন্য মুরগি সেই আক্রান্ত মুরগিকে নতুন করে ঠোকরানো শুরু করে। আর এ অবস্থায় যদি কোনোভাবে রক্তের স্বাদ পায় তাহলে সেই মুরগির মধ্যে এ ঠোকরানোর প্রবণতা বেড়ে যায়। এবং এটা খুব অল্প সময়ের মধ্যে খামারের অন্য মুরগির মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যা সহজে রোধ করা কষ্টকর।

৭. পরজীবী ও উকুনের আক্রমণ : মুরগি খুব সংবেদনশীল পাখি। অল্পতেই যে বিরক্ত এমনকি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। গরম ঠাণ্ডার বেশি পার্থক্য হলেই অল্পতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর মুরগিতে পরজীবীর আক্রমণ খুব সাধারণ একটা বিষয়। পরজীবীর আক্রমণ হলে মুরগি খুব অশস্তি বোধ করে। এর ফলে আক্রমণের স্থান চুলকায়। যার কারণে সে নিজের ঠোঁট দিয়ে তা চুলকাতে চেষ্টা করে।

এতে কাজ না হলে পরে অন্য কোনো শক্ত জিনিসের সঙ্গে নিজের শরীর লাগিয়ে দিয়ে সেই যন্ত্রণা হতে মুক্তির চেষ্টা করে। আর এ রকম অবস্থায় মুরগির পালক উঠে যায় এমনকি মুরগির রক্তক্ষরণও হতে পারে। যদি মুরগির সেই ক্ষরিত রক্ত কোনো মুরগি গ্রহণ করে তাহলে সেই মুরগির মধ্যে রক্তের নেশা লেগে যায়। ফলশ্রুতিতে অন্য সুস্থ মুরগিকে আক্রমণ করে রক্ত শোষণ করতে শুরু করে। পরে এক সময় তা ব্যাপক হারে মুরগির ফ্লকে ছড়িয়ে পড়ে।

আরোও পড়ুন:মুরগির ঘাড় বাঁকা রোগের কারণ লক্ষণ ও প্রতিকার

মুরগির রাণীক্ষেত রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার

৮. সময়মতো ও সঠিক মাত্রায় মুরগির ঠোঁট না কাটা : মুরগির ক্ষেত্রে ঠোঁট কেটে ছোট করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত লেয়ার (ডিম পাড়া) মুরগির ক্ষেত্রে। মুরগির ঠোঁট বেশি বড় থাকলে সে যেমন খাদ্যের অপচয় করে ঠিক তেমনি তার বড় ঠোঁটের বড়ত্ব দেখিয়ে অন্য মুরগিকে আক্রমণ করে থাকে। আর এ ধরনের মুরগির মধ্যে ডিম খাওয়ার প্রবণতাও বেশি থাকে। এর ফলে মুরগির উৎপাদনের অনেকটা ক্ষতি হয়।

. মুরগির ঘনত্ব বৃদ্ধি : মুরগিকে তার প্রয়োজন মতো জায়গা দিতে হয়। সেক্ষেত্রে যদি তার জায়গার ঘাটতি হয় সেক্ষেত্রে এ বদঅভ্যাস শুরু হয়ে যেতে পারে। বাচ্চার জন্য নির্ধারিত জায়গা হলো-

প্রতি বাচ্চার জন্য (প্রথম ২ সপ্তাহ) ১/৪ স্কোয়ার ফিট, প্রতি মুরগির বাচ্চার জন্য (৩-৮ সপ্তাহ) ১/২ স্কোয়ার ফিট, প্রতি মুরগির জন্য (৮-১৬ সপ্তাহ) ১ স্কোয়ার ফিট, প্রতি মুরগির জন্য (১৬ সপ্তাহের পর থেকে) ১৫ স্কোয়ার ফিট। এর কম হলে ক্যানাবলিজম দেখা যায়।

১০. ঘরে আলোর তীব্রতা বেশি হলে : প্রয়োজন মতো আলো মুরগির জন্য খুবই জরুরি। এর চেয়ে মাত্রা বেশি হলে তা ক্ষতিতে রূপ নিতে থাকে।

১১. মুরগির বংশগত স্বভাব হলে : কিছু মুরগির বংশগতভাবে ফিদার পিকিং এ আক্রান্ত থাকে। যার ফলে খামারে তা রোধ করা সহজ হয় না।

১২. উচ্চ পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্য এবং কম ফাইবার যুক্ত খাবার : মুরগির ক্ষেত্রে অতি উচ্চশক্তির খাদ্য খাওয়ালেও এ সমস্যা সৃষ্টি হয়। আর খাবারে ফাইবার কম থাকাটাও একটা অন্যতম কারণ। যার ফলে ক্যানাবলিজমের স্বভাব বৃদ্ধি পায়।

যেসব কারণে মুরগির ক্যানাবলিজম হয়ে থাকে লিখেছেন মো. মোস্তাফিজুর রহমান শিক্ষার্থী, ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স অনুষদ, ৪র্থ বর্ষ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। লেখাটি কৃষি তথ্য সার্ভিস থেকে নেওয়া হয়েছে।