মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: লালন গীতিকা ‘আমি অপার হয়ে বাসে আছি’র মতো জনগণ চালের দাম কমার দিকে চাতকের মতো তাকিয়ে আছে। বোরো মৌসুম পেরিয়ে ভরা আমন মৌসুমেও কমলো না চালের দাম, উল্টো বাড়ছে। তবে, কেন বৃদ্ধি পাচ্ছে তার কারণ জানে না সরকার। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে তাহলে কী সরষে ফুলেই ভূত রয়েছে।

দেশে নেই খাদ্য সঙ্কট, তবুও সরকার ছুটছে চাল আমদানির দিকে। ইতোমধ্যে ৫০ হাজার টন চাল চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছেছে। জানুয়ারির মধ্যে আসছে আরো দেড় লাখ টন। আমদানিতে চালের দাম কমবে না বলেও শঙ্কা রয়েছে। এদিকে সিন্ডিকেটের দখলে চালের বাজার। বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে এ অদৃশ্য শক্তিকে দমন করতেই চাল আমদানি করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

সূত্রে জানায়, উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার প্রায় ২০০ অটো রাইস মিল মালিক ও শতাধিক মজুদ ব্যবসায়ী বাজার রেখেছে নিজের দখলে। পাইকারি চাল ব্যবসায়ী ও খুরচা বিক্রেতাদের অভিযোগ বাজার নিয়মিত মনিটরিং না থাকায় এই চক্রটি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। নিজেদের কাছে জনগণকে জিম্মি করছে। সারাদেশেই এরকম অসংখ্য সিন্ডিকেটের ফসল এই চালের বেপোরোয়া দাম বৃদ্ধি।

রাজশাহী অঞ্চলের ৮ জেলার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে অটো রাইস মিল মালিক ও মজুদদারদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাঁরা ছোট ছোট চালের দোকানের আড়ালে গুদামজাত করছে ধান ও চাল। সরকারের চোখে দৃশ্যমান এসব কাণ্ড। তবে কার্যকরী আইনের প্রয়োগ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।

‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ যেসব কারসাজি বছরের শুরু থেকেই:

সরকারের খাদ্য সংগ্রহের সবচেয়ে বড় মৌসুম ছিল বোরো। এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট সরকারের বোরো ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হতে দেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। চলতি বছরের গত আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে সরকারি গুদামের জন্য বোরো ধান সংগ্রহ শেষ করার করা ছিল খাদ্য অধিদপ্তরের। কিন্তু এ সময়ে (৩১ আগস্ট) পর্যন্ত রাজশাহী অঞ্চলে সরকারি বোরো সংগ্রহ হয়েছিল লক্ষ্যমাত্রার এক-তৃতীয়াংশের কম। অদৃশ্য শক্তি আমন মৌসুমেও সক্রিয় রয়েছে।

এ অঞ্চলের ৮ টি জেলা (রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া,জয়পুহাট, পাবনা) থেকে ধান সংগ্রহ করা হয়। সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে খোলা বাজারে কৃষকদের কাছে থেকে বেশি দামে ধান কিনে নেয় অটো রাইস মিল মালিক ও শতাধিক মজুদ ব্যবসায়ীরা। বোরো মৌসুমে লাখ লাখ মণ ধান মজুদ করে বাজার নিজেদের আয়ত্তে করে এই সিন্ডিকেট। এখন তারা নিজেদের ইচ্ছামতো চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অসংখ্য অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। শুধু রাজশাহী অঞ্চল নয়, সারাদেশেই এ কর্মযজ্ঞ চালায় বলে জানা গেছে।

অভিনব পদ্ধতিতে করোনাকালে মিলারদের হয়ে কাজ করা ছোট ছোট খুচরা ব্যবসায়ীরা মোবাইলের মাধ্যমে ধান কিনে কৃষকের ঘরেই আটকে রাখছে। আবার অসংখ্য মুদি দোকানে মজুদ হয়েছে লাখ লাখ টন চাল। সবমিলিয়ে প্রশাসনের ক্ষমতা প্রয়োগের কোন এখতিয়ারও নেই। ফলে নানান ক্ষুদ্র সমস্যার সমষ্টি হয়ে দাঁড়িয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি। এ যেন সরষে ফুলে ভূত লুকিয়ে!

সরকারের পক্ষ থেকে যা যা বলা হচ্ছে:

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোছাম্মৎ নাজমান আরা খানুম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ‘চালের দাম কেন এই ভরা মৌসুমে বাড়ছে, এটা নিয়ে আমরাও ভাবছি। করোনায় কৃষকরা ধানের দাম বেশির আশায় ধানটা একটু অল্প অল্প করে বাজারে ছাড়ছে।

চালের দাম বৃদ্ধিতে সিন্ডিকেটের প্রভাব এবং খাদ্য সঙ্কট রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশে চালের কোনো সঙ্কট নেই সবার ঘরে ঘরে ধান-চাল আছে। আমরা মোটা চাল আমদানি করছি, যাতে নিম্নআয়ের লোকদের কষ্ট না হয়। আর সিন্ডিকেটের কোন অস্তিস্ব নেই। আমরা নিয়মিত বাজার মনিটরিং করছি। ধানের দাম বাড়ার কারনেই চালের দাম বাড়ছে।

মিলারদের চাল মজুদ ক্ষমতা কমানো হবে কি না জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, আগের মিলারদের পাক্ষিক চালছাঁটাই ক্ষমতার ৫ গুণ মজুদ করার নিয়ম ছিল। তা কমিয়ে বর্তমানে ৩গুণ করা হয়েছে। এসব মজুদ চাল ৩০ দিন পর্যন্ত রাখতে পারবে। এর বেশি রাখলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আগে তারা ২৪ ঘন্টা মিল চালিয়ে দিন হিসেব করত কিন্তু ছাঁটাই করার সময় কমিয়ে ৮ ঘন্টা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সবমিলিয়ে তাঁদের চাল মজুদ করার প্রশ্ন আসে না।

এদিকে রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, চালের দাম বৃদ্ধিতে সিন্ডিকেটের কিছুটা হাত রয়েছে। সারাদেশেই এরকম আছে। তবে সরকারের চাল আমদানি শুরু হলে তারা দমে যাবে। এক্ষেত্রে সরকারের আরোও ভূমিকা রাখা দরকার। সরকার নির্ধারিত ১ হাজার ৪০ টাকা দরে ধান কিনতে পারেনি কেউই। মিলাররা ধান কিনেছে বেশি দামে। কম দামে সরকারকে চাল তারা দেবে কিভাবে? আর ধানের দাম বৃদ্ধির কারণেই চালের দাম বৃদ্ধি।

অভিযোগ অস্বীকার মিল মালিকদের:

খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরকারের শিথীলতা নীতি ও তড়িত ব্যবস্থা এখনই না নেওয়া হলে জনগণকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। ধান-চাল মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে তারা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে। সারাদেশের সিন্ডিকেট চালের বাজার অস্থিতিশীল করে অন্যান্য পেঁয়াজকান্ড লাগিয়ে দিতে পারে।

রাঘববোয়াল অটো রাইসমিল মালিকদের কাছে চাতাল ও অপেক্ষকৃত ছোট পরিসরে চাল উৎপাদনকারীরা নাজেহাল। তারা বলছেন, চালের দাম বাড়লে যাদের লাখ লাখ টন ধান-চাল মজুদ করার ক্ষমতা আছে তাদের লাভ হবে। চাতালের তেমন কোন লাভ নেই। বরং অটো রাইস মিলের দাপটে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না বলেও অভিযোগ চাতাল মালিকদের।

নওগাঁর কয়েকজন মিল চাতাল মালিক ও আড়তদার এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, মৌসুমের শুরু থেকেই ধানের দাম বেশি। প্রথম থেকেই অটো রাইস মিলগুলো উল্লেখযোগ্য ধান সংগ্রহ করেছে। অটো রাইস মিল মালিকরা অনেক বেশি ধান সংগ্রহ করে নিজেদের ইচ্ছামতো চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ছোট ব্যবসায়ীরা বড় ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে।

প্রান্তিক কৃষকের কাছে ধানের কোন মজুদ নেই। মৌসুমের শুরুতেই মজুদদাররা ধান-চাল মজুদ করে রাখে। তারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এসব সিন্ডিকেট ও মজুদদাররা সুযোগ পেলেই দাম বাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে ধান-চালের দাম বাড়লেও সেই টাকা চলে যায় তাদের পকেটে। কৃষকরা এই টাকার কোন সুফল ভোগ করতে পারেন না বলেও জানান তারা।

নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, অটো রাইস মিল মালিকরা ধানের মজুদ গড়ে তুলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। সারাদেশে কয়েক হাজার চাল কল আছে। নওগাঁতে আছে ১২০০ চালকল, তার মধ্যে ৫৩ টি অটো রাইস মিল। আমরা ইচ্ছা করলেই তো আর দাম বাড়াতে পারিনা। কৃষকরা কম দামে সরকারি গুদামে ধান দেয়নি। শুরু থেকেই ধানের বাজার বেশি। তাই কৃষকের কাছে থেকে আমরা বেশি দামেই কিনেছি। ধান বেশি দামে কেনা থাকলে চাল কমদামে বিক্রি হবে এটা হয়না।

ধান-চাল মজুদ ও অটো রাইস মিলগুলোর দৌরাত্ম্য বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সদস্য এগ্রিকেয়ার ২৪.কম কে বলেন, আমরা ব্যবসা করি সরকারের বেঁধে দেওয়া নীতিমালা অনুযায়ী। আমরা যদি নীতিমালার বাইরে গিয়ে মজুদ করে থাকি তাহলে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অহেতুক গালিগালাজ করা হয় আমাদের। মুনাফাখোর, মজুদদার বলা হয়।

অটো রাইস মিল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, কোথাও বেশি ধান-চাল মজুদ করা থাকলে সরকারিভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হোক এটা আমরাও চাই। তবে, সবসময় সবার গুদামে দিয়ে খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয় না। মজুদদার থাকতে পারে হাতেগোনা দু-একজন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার রাজশাহী দপ্তরের সহকারী পরিচালক মাসুম আলী এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হয়। আমরা সিন্ডিকেটের বিষয়টি দেখতে পাচ্ছি না। ধানের দাম বাড়ার কারণে চালের দাম বাড়ছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চালের দাম বাড়ার পিছনে সরকারের একটি মহলই কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। সরকার অন্যান্য ক্ষেত্রে যেসব পদক্ষেপ যেভাবে দ্রুত নিতে পারছে, ঠিক সেভাবে চালের দাম বৃদ্ধির পেছনে কি কি কারণ রয়েছে তা খুঁজে বের করা সরকারেরই দায়িত্ব। হটাৎ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বৃদ্ধির অবস্থা বেশ কয়েক বছর ধরে চললেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার মজুদদারদের হুঁশিয়ারি করে বলেছেন, অবৈধ মজুদদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কথা সর্বস্ব না হয়ে সরকার ও জনগণ একত্রে সিন্ডিকেট রুখতে ভূমিকা রাখতে হবে।

রাজশাহীর নওগাঁ, নাটোর, তানোর, চাঁপাইনবাগঞ্জসহ জেলার অন্যান্য বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মানভেদে স্বর্ণা ৫০ কেজির বস্তা আগে ২ হাজার ১০০ বিক্রি হলেও বর্তমানে বস্তাপ্রতি ৩০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। এছাড়া কাটারিভোগ সিদ্ধ তিন হাজার ৮০০ থেকে চার হাজার টাকায় ও কালিজিরা চাল চার হাজার ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা, আঠাশ চাল দুই হাজার ৭০০ থেকে দুই হাজার ৮০০ টাকায়, মিনিকেট দুই হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ৮৫০ টাকায়, বাসমতি দুই হাজার ৮০০ থেকে ৩০০ বেড়ে তিন হাজার ১’শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ