আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম

নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: দেশে তেল নিয়ে তেলেসমাতি যেন থামছেই না। বিগত কয়েক মাসের ব্যবধানে কয়েকবার বেড়েছে তেলের দাম। এমন পরিস্থিতিতে রমজানের আগেই আরেকদফা তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে ব্যবসায়ীরা।

প্রতিবছরই রমজান মাসকে সামনে কেন্দ্র করে তেল, চিনি, ছোলা, ডালসহ কয়েকটি পণ্যের চাহিদা বাড়ায় এ সময় নিত্যপণ্যের দাম বাড়ান ব্যবসায়ীরা। নতুন করে রমজানের আগেই আরেকদফা তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়ে রমজানের আগে তেলের দাম আর বাড়ানো হবে না।

সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীতে আয়োজিত পোস্ট ইনভেস্টমেন্ট সামিটে বাণিজ্যমন্ত্রী এ কথা বলেন।

তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে টিপু মুনশি বলেন, ব্যবসায়ীরা আমাদের কাছে এসেছিলেন। তেলের দাম বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাব করেছেন। তবে কত টাকা বাড়াতে চান সে দামের কোনো কথা উল্লেখ করা হয়নি। আমরা তাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করার জন্য অনুরোধ করেছি। রমজানের আগে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো হবে না। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম আরও বাড়লেও বাড়বে না। বিশ্ববাজারে যদি বাড়েও, ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করব সেটা সহ্য করার জন্য।

পড়তে পারেন: যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে অর্গানিক সয়াবিনের আবাদ

এর আগে গত ৬ ফেব্রুয়ারি লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৬৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। একমাসও যায়নি আবার দাম বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা। ১ মার্চ থেকে ১৮০ টাকা লিটার দরে সয়াবিন তেল বিক্রির কথা জানিয়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি সরকারকে চিঠি দেয় ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম তিনমাসে রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। মূলত পাম অয়েলের বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির বিপরীতে উৎপাদন কমছে। এ কারণে অন্যান্য ভোজ্যতেলের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়া শুরু করেছে। এ প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ছে ভোজ্যতেলের দাম।

পড়তে পারেন: ফের মোটা চাল-সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, ডিমের দাম বাড়তি

পাম অয়েলের মজুদও কমছে, বাড়ছে সরবরাহ সংকট। ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে বৈশ্বিক মূল্যসূচক। বিদায়ী বছরের শেষার্ধ থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া হতে শুরু করেছে ভোজ্যতেলের দাম। গত তিন মাসেই দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। এ সময় ধরন বুঝে টনপ্রতি ভোজ্যতেলের দাম ১০০ ডলার পর্যন্ত বেড়েছে।

মূলত এ সময়ে অপেক্ষাকৃত স্বল্পমূল্যের ভোজ্যতেলের বাজারে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে পাম অয়েলের দামে। তবে সে তুলনায় বাড়েনি অপেক্ষাকৃত মূল্যবান ভোজ্যতেলের দর।

ফলে এ দুই ধরনের ভোজ্যতেলের মধ্যে বিদ্যমান দামের তফাত কমে এসেছে। মূল্যসূচক অনুযায়ী, উল্লিখিত সময়ে পাম অয়েল ও সরিষা তেলের মধ্যকার দামের পার্থক্য ৫০ শতাংশ কমে টনপ্রতি ৩৬০ ডলার থেকে ১৮০ ডলারে নেমেছে।

পড়তে পারেন: মিল মালিকদের প্রস্তাব মতোই সয়াবিনে বাড়লো ৮ টাকা

একইভাবে পাম অয়েলের সঙ্গে সয়াবিন তেলের দামের পার্থক্য ৭৫ শতাংশ কমে টনপ্রতি ১৬০ ডলার থেকে ৪০ ডলারে নেমেছে। পাম অয়েলের দাম বৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে ভোজ্যতেলের বাজার চাঙ্গা করতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। কৃষিপণ্যটির বৈশ্বিক উৎপাদন ক্রমে কমছে। এ ধারা চলতি বছরেও অব্যাহত থাকতে পারে।

এদিকে শীর্ষ উৎপাদক ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বজুড়ে পাম অয়েলের ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষত বায়োডিজেল উৎপাদনে। গত বছর পাম অয়েলের বৈশ্বিক ব্যবহার আগের বছরের তুলনায় ৬০ লাখ টনের মতো বেড়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা, যা পণ্যটির উৎপাদন বৃদ্ধির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

উৎপাদন কমার বিপরীতে চাহিদা বাড়ায় পণ্যটির বৈশ্বিক মজুদ কমছে দ্রুতগতিতে। ফলে তৈরি হচ্ছে সরবরাহ সংকট। স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে দাম।

পড়তে পারেন: যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানি বাড়িয়েছে চীন

এদিকে ভোজ্যতেলের শীর্ষ ভোক্তা দেশ চীনে সয়াবিনের আমদানি প্রবৃদ্ধি কমেছে। একদিকে আফ্রিকান সোয়াইন ফ্লুর প্রকোপ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের জেরে গত বছর দেশটিতে কৃষিপণ্যটির আমদানি প্রবৃদ্ধি কমেছে। সয়াবিন আমদানি কমায় তেল উৎপাদন রয়েছে নিম্নমুখী। ফলে চাহিদা পূরণে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সয়াবিন তেলে আমদানি বাড়াতে হয়েছে দেশটিকে।

এদিকে পাম অয়েল ও অন্যান্য তেলের দামে ব্যবধান হ্রাসে ক্রেতারা তুলনামূলক সস্তা পরিপূরক ভোজ্যতেলের দিকে ঝুঁকেছে। তবে বিদায়ী বছরের শেষার্ধে চাহিদার তুলনায় সয়াবিন ও সরিষা তেলের বৈশ্বিক সরবরাহ ছিল সংকটপূর্ণ।

ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রে বায়োডিজেল তৈরিতে সয়াবিনের ব্যবহার বেড়েছে। ফলে আর্জেন্টিনা থেকে রফতানি বৃদ্ধির পরেও বৈশ্বিক পরিসরে পণ্যটির রফতানি প্রাপ্যতা সীমিত ছিল।

এদিকে বীজের পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও মাড়াইয়ের অভাবে সরিষা তেলের শীর্ষ রফতানিকারক কানাডা পণ্যটির রফতানি কমিয়েছে। ফলে বিশ্ববাজারে উদ্ভিজ্জ তেলটির যথেষ্ট সরবরাহ সংকট দেখা গেছে এ সময়ে। তবে সূর্যমুখী তেলের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও তা চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয়। পণ্যবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারে পাম অয়েলের পর্যাপ্ত সরবরাহ না হওয়া পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দরপতনের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না তারা।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ