মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে মহামারি রোধে দফায় দফায় দেওয়া হয়েছে লকডাউন। বর্তমানে আবারও টানা ৭ দিনের লকডাউনে সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ। গতবছর থেকে এরকম লকডাউন পরিস্থিতি বারবার সামাল দিতেই রাজশাহীর ডেইরি খামারিদের লোকসান হয়েছে প্রায় ১২ কোটি টাকা।

রাজশাহী ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গোলাম রাহিদ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, রাজশাহীর ৯ টি উপজেলা ছাড়াই শুধুমাত্র মেট্রো এলাকার আড়াই’শ ডেইরি খামারির ক্ষতি হয়েছে ১২ কোটি টাকার বেশি। মহামারির শুরু থেকেই এসব খামারে উৎপাদিত প্রায় ৩০ হাজার লিটার দুধের বেশিরভাগই স্বল্পমূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। প্রতি লিটার দুধ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলতে হিমসিম খাচ্ছেন এখানকার খামারিরা।

খামারি ও ডেইরি অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ, অন্যান্য দপ্তরের সাথে প্রাণিসম্পদ দপ্তরের আন্ত:সম্পর্কের ঘাটতি রয়েছে। লকডাউনে খামারি ও দুধ বিক্রেতাদের হয়রানি করা হচ্ছে। রাস্তায় বাধার মুখে পড়ছেন তারা। এছাড়া খামারে উৎপাদিত দুধ বিপণনের সঠিক ব্যবস্থা করা হয়নি। খামারিরা নিজ উদ্যোগে বাসাবাড়ি; ভ্রাম্যমাণ ও মিষ্টির দোকানে দুধ বিক্রি করেছেন। বর্তমানে মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকায় গরুর খাবার কমিয়ে দিয়েছেন যাতে দুধের উৎপাদন কম হয়। হাজারো সমস্যায় জর্জরিত খামারিদের পাশে প্রশাসন কিংবা প্রাণিসম্পদ দপ্তরকে পাশে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ একাধিক খামারির।

জেলা প্রাণিসম্পদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জেলার ৯টি উপজেলা ও একটি মেট্রো অঞ্চল মিলিয়ে দেশী ও সংকর জাতের গাভী থেকে দুধ উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ২৭ মেট্রিক টন। সদ্য বিদায়ী বছর ২০২০ সালে দুধ উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার ২৬ মেট্রিক টন। ২০১৬ সালের তুলনায় জেলায় ৪ বছরে দুধ উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন। পরের বছরগুলোতে পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে দুধের উৎপাদন। করোনাকালে এ বিপুল পরিমাণ দুধ বিক্রির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভ্রাম্যমাণ দুধ বিক্রির ব্যবস্থা করলেও তা তেমন কার্যকর হয়নি।

রাজশাহী ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের সহ- সভাপতি সাথী আক্তার এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, তাঁর খামারে ২৩ টি গরুর মধ্যে দুধ দেয় ১২ টি। প্রতিদিন ১১০ লিটার দুধের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ লিটার দুধ অবিক্রীত থেকে যায়। দুধ দোহানোর জন্য গোয়ালের কাছে এ অবিক্রীত দুধ অল্পদামে বিক্রি করেন তিনি।

সাথী আক্তার জানান, খাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা বেড়েছে। গমের ভুষি, ডালের কুড়া, এ্যাংকর ভুষি সবকিছুর দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ৬৮ টাকা এমনকি ১৫ টাকা পর্যন্ত। সে অনুযায়ী দুধের দাম নেই। ৪০ টাকা লিটার দুধ বিক্রি করে গরুর খাবারের দাম আসেনা। সরকার নূন্যতম চোখ মেলে ডেইরি শিল্পের দিকে তাকায় না বলে অভিযোগ এই খামারির।

নগরীর কাটাখালী শ্যামনগর এলাকার খামারি রবিউল করিম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, লকডাউনের শুরু থেকে তাঁর লোকসান হয়েছে প্রায় ৪ লাখ টাকা। বাঁকিতে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হয়ে পরে পাননি টাকা। চলতি লকডাউনে অবিক্রীত দুধ থেকে নিজেই তৈরি করছেন ছানা। তাঁর চুক্তিবদ্ধ মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকায় এ কৌশল হাতে নিয়েছেন তিনি। এছাড়াও রাজশাহী অঞ্চলের জন্য সরকারিভাবে দুধ পাস্তরাইজেশনের জোর দাবি জানান তিনি।

নগরীর বনগ্রাম এলাকার মকবুল, বারোরাস্তার মোড় এলাকার ফরিদ, টিকাপাড়া এলাকার মিনসহ অন্তুত ১০ জন খামারি জানান, তারা প্রণোদনার একটি টাকাও পাননি। একদিকে দুধের দাম নেই অন্যদিকে লকডাউনে দুধ বিপণনের ব্যবস্থা করেনি সরকার। সঠিক পরিকল্পনায় কিভাবে ডেইরি শিল্পকে বাঁচানো যায় তার নকশা আঁকতে বলছেন খামারিরা। সেইসাথে প্রণোদনার টাকা না পাওয়ায় প্রাণিসম্পদ দপ্তরের কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।

এ বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো: ইসমাইল হক এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, খামারিরা লোকসান গুনছেন এ বিষয়টি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। এজন্য ভ্রাম্যমাণে দুধ-ডিম- মাংস বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া মিষ্টির দোকান বন্ধ, মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা না থাকায় দুধ বিক্রিতে সমস্যা হচ্ছে।

প্রণোদনার ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রথম ধাপের প্রণোদনায় মেট্রো এলাকার খামারিরা বদ পড়েন। কিন্ত জেলার অন্যান্য খামারি বা ৫ টি গরু যাদের আছে তারা প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপে প্রণোদনার যে টাকা এই টাকা মেট্রোর খামারিরা খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিলে দেওয়া লকডাউনে প্রতিদিন ১২০ লাখ থেকে ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রীত থাকে ফলে প্রায় ৫৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয় প্রতিদিন।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ