মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: রাজশাহীর ইয়াসির আরাফাত। আরাফাত রুবেল নামেই বেশ পরিচিত। উচ্চশিক্ষার জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ভর্তি হন ১৯৯৯-২০০০ সালে। স্নাতকোত্তর শেষ করেন ২০০৬ সালে। এরপর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেন। এ উচ্চশিক্ষিত যুবক কোনদিনই চাকরির পেছনে ছুটেননি, হয়েছেন উদ্যোক্তা। এখন শূন্য থেকে কোটিপতি আরফাত রুবেল!

নগরীর রামচন্দ্রপুর কালুমিস্ত্রি মোড়ের বাসিন্দা রুবেল। কাটাখালী শ্যামনগর আবহাওয়া অফিসের পেছনে ‘সওদাগর এগ্রো’ নামে গরুর খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। গতকাল (২১ জুন ২০২১) তাঁর খামারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ব্রাহামা, শাহিওয়াল, দেশাল ও দেশী উন্নত জাতের বড় বড় গরু। একেকটির ওজন ৭০০ কেজি থেকে সর্বনিম্ন দেড়’শ কেজি! এখন তাঁর খামারে রয়েছে ১৬টি গরু। তারমধ্যে ৮টি গরু কোরবানির জন্য প্রস্তুত করছেন। ব্রাহমা ও শাহীওয়াল জাতের এ ৮টি গরুর গড় দাম হাঁকছেন ৪০ লাখ টাকার বেশি।

পড়তে পারেন: হাঁসের খামার করে লাখপতি নওগাঁর খালেক

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবস্থাতেই বেশ পরিশ্রম শুরু করেন রুবেল। চারুকলার ছাত্র হওয়ার সুবাদে দেয়াল লিখনের কাজ করেন। যা আয় হতো তা দিয়ে নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি গড়ে তোলেন প্লাইউডের ব্যবসা। সাইকেলে করে বিভিন্ন দোকানে পৌঁছে দিতেন সেসব। এই ব্যবসায় সফলতার মুখ দেখেন তিনি। এরপর প্রায় ১ দশকের মাথায় পরিশ্রম পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি এই তরুণ উদ্যোক্তার।

খামার শুরুর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারিভাবে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে ব্রাহামা সিমেন্স বিনামূূল্যে বিতরণ করেছিল। আমি সেইসব প্রান্তিক খামারিদের ঠিকানা জোগাড় করে ১২টি ব্রাহামা জাতের বাছুর সংগ্রহ করি। সেই থেকে শুরু আমার গরুর খামার। এখন দেশী ষাঁড় ও দুগ্ধ উৎপাদনের জন্য গাভীর খামার করেছি।

গ্রীষ্মপ্রধান দেশের ব্রাহমা ও শাহীওয়াল জাত বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে সহযেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এছাড়া দেশি গরুতে জন্ম হওয়ায় মায়ের বৈশিষ্ট্য বহন করে অনেকটাই। ফলে, রোগবালাই ও আবহাওয়া পরিবর্তন জনিত কোন সমস্যায় পড়তে হয় না। কৌশল হিসেবে দেশি গরুতে উন্নত জাতের বীজ দিয়ে বাচ্চা সংগ্রহ করেন। বাচ্চা মোটাতাজাকরণ ও গাভী আগের দামেই বিক্রি করেন আরাফাত। ১২ থেকে ১৪ মাসের মাথায় বাচ্চার দাম দাঁড়ায় দেড় থেকে দু-লাখ টাকা।

পড়তে পারেন: সোনালীতেই স্বাবলম্বী দুলালের দুই ছেলে

গরুর খাবারের বিষয়ে জানতে চাইলে রুবেল এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, শহরের বাইরের দিকে জমি লিজের দাম অনেকটা কম। কয়েক বিঘা জমিতে ঘাস চাষ করেছি। এখন কাঁচা ঘাস খাওয়াচ্ছি, মোলাসেস তৈরি করি নিজেই। খরা মৌসুমে মোলাসেস বেশ কার্যকর। কাঁচা ঘাস পর্যাপ্ত থাকতে মোলাসেস খাওয়ানোর প্রয়োজন নেই। প্রতি ১০০ কেজি ওজনের গরু দানাদার খাবার খায় ৩ কেজি। তবে, ওজন যত বেশি; খাবারের পরিমাণ তত কমতে থাকে।

চীনা উন্নত ও দ্রুতবর্ধনশীল জারা-১ জাতের ঘাস চাষ করছেন তিনি। যেটি দিয়ে তিনি নিজের খামারের চাহিদা পূরণ করেন। রেডি খাবারের চেয়ে বাজার থেকে গম, ভুট্টা, ধান কিনে আলাদভাবে খাবার তৈরি করেন রুবেল। সব মিলিয়ে নিজের তৈরি খাবারে খরচ কম হয়। একই পরামর্শ দেন অন্যান্য খামারিদের। গরু পালনে লাভ করতে অবশ্যই খাদ্যের মান নিশ্চিত হওয়া ও খামারে নির্ভেজাল খাবার সরবরাহের প্রতি গুরুত্ব দেন তিনি।

খামার শুরুর প্রতিবন্ধকতা ও কৌশল বিষয়ে প্রশ্নে তিনি বলেন, খামার শুরুর আগে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। বিভিন্ন খামারে গিয়ে তাদের ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ও কৌশল দেখেছি। এরপর গাজীপুরে ন্যাশনাল লাইভস্টক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে ঘাস চাষ ও পশু পালনের ওপরে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেছি খামার। হটাৎ করে খামার করলে লোকসান হতেই পারে। বিষয়টি নিয়ে আগে পরিকল্পনা জরুরি। আমি কি করতে চাই এবং কেন চাই!

পড়তে পারেন: বায়োফ্লকে ৫০ হাজার তেলাপিয়া চাষ, ৫ মাসেই সফল শিহাব উদ্দিন

চাকরি না করে উদ্যোক্তা হওয়ার বিশেষ কোন কারন আছে কিনা জানতে চাইলে রুবেল বলেন, চাকরির পিছনে না ছুটে একটা ব্যবসা করা সম্মানজনক। নিজের স্বাধীনতা বজায় থাকে। অন্যের কাছে নিজের মেধা বিক্রি করে আমরা খুব খুশি হই, মানে চাকরি। এটা আমার ভালো লাগে নি কোনদিন। নিজের মেধা অন্যের কাছে বিক্রি করব কেন? আমার ইচ্ছা ছিল অন্যের অধীনে চাকরি করব না। এখন আমি চাকরি দিই। আমার জন্য কয়েকজন মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তারা সুখে আছে। প্লাইউডের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ৪০ জন কাজ করে, খামারে ৬-৭ জন কাজ করে। রাজশাহীর ছাড়াও আমার ফেসবুক সওদাগর এগ্রোর মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য তরুণ আমার কাছে পরামর্শ চাইছে, ফোন করে। আমি তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার পরামর্শ দিই।

খামার ও প্লাইউডের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন লিটন শেখ। কথা হয় তাঁর সাথে। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, গরুর খামার দেখাশুনা করতে ভালোই লাগে। বড় বড় গরু দেখে চোখ জুড়িযে যায়। সকাল ও বিকেলে গরুগুলোকে গোসল করাই; খাবার দিই। আরাফাত ভাইয়ের সাথে ১৩ বছর ধরে আছি। তিনি প্রতিদিন একবার হলেও খামারে আসেন নিজে দেখাশুনা করেন।

রাজশাহী মেট্রো পশু হাসপাতালের দায়িত্বরত প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ফজলে রাব্বি এগ্রিকেয়ার২৪.কম বলেন, আরাফাত রুবেল একজন সফল খামারী। তিনি ‘সওদাগর এগ্রো’ গড়ে তুলেছেন। গরু মোটাতাজাকরণ ও দুগ্ধের জন্য গাভী পালন করেন। আমাদের সাথে কথা হয় নিয়মিত। অভিজ্ঞ খামারি হওয়ার কারণে তিনিও তরুণ খামারিদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ