সময়ের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে রাজশাহীর ঘানিশিল্প

মোফাজ্জল বিদ্যুৎ, রাজশাহী, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: সময়ের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে রাজশাহীর ঘানিশিল্প। আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার হলেও বাপ-দাদার পেশার ঐতিহ্য হিসেবে এখনো অনেকেই বহুকষ্টে টিকিয়ে রেখেছেন ঘানিগুলো। আবার অনেকেই বাধ্য হয়ে ঝুঁকে পড়ছেন অন্য পেশায় ।

রাজশাহী শহর থেকে উত্তরে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে নওগাঁর মান্দা ও রাজশাহী মোহনপুরের মাঝামাঝি চৌদ্দ মাইল মোড়। সেখান থেকে বাগামার হাটগাঙ্গো পাড়া যাওয়ার পথে বেলঘরিয়া গ্রামে এমনই একটি দৃশ্য চোখে পড়ে।

বাপ-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে নানা প্রতিকুলতার মধ্যে আজও সংগ্রাম করে যাচ্ছেন বাগমারা উপজেলার বেলঘরিয়া গ্রামের বাসিন্দা শামিম হোসেন। যেখানে রয়েছে কলু, কলুর বলদ, চটকা কড়াই কাঠ ও বাবলা কাঠ মিশ্রিত ঘানি, দেশি সরিষা আর শতভাগ বিশুদ্ধতা।

কাঠের বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো হাতে তৈরি যন্ত্রের চারিদিকে নির্বিকার ভাবে ঘুরে চলেছে কলুর বলদ, তার দু’চোখ বাঁধা বাঁশের তৈরি বিশেষ ধরণের দুটি ছোট ঝুড়ি তার উপর কাপড় দিয়ে। কোন রকম অসম্মতি ছাড়াই অনবরত ঘুরে চলছে গরু। আর তৈরি হচ্ছে দেশি সরিষার খাঁটি তেল। ফোটায় ফোটায় তেল জমা হচ্ছে নিচে রাখা পাত্রে।

তেল মাড়াইয়ের এই প্রাচীন পদ্ধতিটা নিষ্ঠুর বা কঠিন হলেও সবার কাছে এর চাহিদা দারুণ। ঘানিভাঙা তেলের ঘ্রাণ, স্বাদ খুব সহজে সবাইকে আকৃষ্ট করে। গায়ে মাখা, তরকারিতে ব্যবহার, যেকোনো ধরনের ভর্তা, মুড়ি মাখানো ও সালাদে এই তেল অতুলনীয়। তা ছাড়া সর্দি-কাশিরও বড় ওষুধ এই সরিষার তেল।

তেল ব্যবসায়ী শামিম হোসেন বলেন, গত ২৫ বছর ধরে এই ঘানি ভাঙা খাঁটি সরিষা তেলের ব্যবসা করছি। প্রত্যেক দিন ২১ কেজি করে ঘানি ভাঙায়। যা থেকে আমাদের সংসার চলে। প্রতি কেজি সরিষার তেল ২০০ টাকায় বিক্রি করি। এই ঘানি তেলের চাহিদা ব্যাপক। হাট বাজারে বিক্রি ছাড়াও প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘানি তেলের অর্ডার আসে। এখান থেকে ঘানি তেল ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলাতে পার্সেল যোগে অনেকেই নিয়ে যায়।

তিনি বলেন, প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে তেল তৈরিতে সময়, শ্রম ও খরচ দুটোই অনেক বেশি প্রয়োজন হয়। শক্তিশালী গরু গুলোর খাবার জোগাতেও খরচ হয় অনেক অর্থ। আর তাই এই তেলের দামটিও বেশি। বর্তমানে সরিষার দাম বাড়তি রয়েছে। এতে করে তেলের দাম আরও বাড়বে।

তিনি আরও বলেন, করোনকালে তেল বেঁচা-কেনা কম হয়েছে। সেই সময় সব দিকেই সংকট চলছিলো। এ পর্যন্ত কেউ কোন খোঁজও নেয়নি এবং সরকারি কোন সুযোগ সুবিধা আমাদেরকে দেওয়া হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাগমারা উপজেলার কৃষি অফিসার মো: রাজিবুর রহমান এগ্রিকেয়ার.কমকে বলেন, প্রকৃত কৃষক হলে ৪% মুনাফায় যে কোন ব্যাংক থেকে নির্ধারিত শর্ত সাপেক্ষে নিদির্ষ্ট ফসলের জন্য ঋণ নিতে পারবেন। আর প্রত্নতত্ত্ব যেগুলো রয়েছে সেগুলো নিদিষ্ট গবেষণাগারে রাখা হয়। ঘানি শিল্প সংরক্ষণ তেমন একটা বিষয় না।

আধুনিক সভ্যতার ক্রমবিকাশে তেলের ঘানিশিল্পের পরিবর্তে যন্ত্রচালিত তেলের কল চালু হওয়ায় এবং গৃহস্থরা খাঁটি সরিষার তেলের বিকল্প যেমন সয়াবিন, পামওয়েল, কলের সরিষা তেল ব্যবহারে কারণে সরিষা তেলের চাহিদা দিনে দিনে কমতে থাকায় এ শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে। একই ধারাবাহিকতায় বিলুপ্তির পথে রাজশাহীর ঘানিশিল্প।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ