মৎস্য ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: সাতক্ষীরা জেলায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মিঠাপানির মাছের দেশীয় বাজার তৈরি হয়েছে। এসব মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলার চাষীদের মধ্যে আশা জাগিয়েছে মিঠাপানির মাছ।

জানা যায়, আশির দশক থেকে উপকূলীয় জেলা খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর ও নড়াইলে ব্যাপক শুরু হয় চিংড়ি চাষ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতে, এর মধ্যে কেবল সাতক্ষীরায় ৬০ ভাগ চিংড়ি উৎপাদন হতো।

চিংড়ির তুলনামূলক ঝুঁকি কম থাকায় সাতক্ষীরায় মিঠাপানির মাছ চাষ বাড়ছে। অনেক চিংড়ি চাষী মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন। জেলায় বর্তমানে রুই, কাতলা, মৃগেল, পাবদা, কালিবাউস, ব্লাককার্প, বাটা, মনোসেক্স ও জাপানি রুইসহ বিভিন্ন প্রজাতির মিঠাপানির মাছ চাষ হচ্ছে। ফলে বছরে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মিঠাপানির মাছ উৎপাদন হচ্ছে। মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, জেলার কমপক্ষে পাঁচ লাখ মানুষের সরাসরি জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে সাদা বা মিঠাপানির মাছ উৎপাদন করে।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসের তথ্যানুযায়ী চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমে জেলার সাতটি উপজেলায় ৬০ হাজার হেক্টর পরিমাণ জমির ৬৩ হাজার ২০০টি ঘেরে মিঠাপানির মাছ চাষ হচ্ছে। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩০ হাজার টন। ২০০ টাকা কেজি দরে গড় দেশীয় বাজার মূল্য ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

গত বছর একই পরিমাণ ঘেরে মিঠাপানির মাছ উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ২৫ হাজার টন। যার বাজার মূল্য ছিল ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দুই-তিন বছরের ব্যবধানে জেলায় মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বেড়েছে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ।

সাতক্ষীরার সদর উপজেলার জেয়ালা গ্রামের মৎস্যচাষী আব্দুল গফুর জানান, ১২ বছর ধরে চিংড়িসহ অন্যান্য মাছ চাষ করে আসছেন, কিন্তু চিংড়ি চাষে অব্যাহতভাবে লোকসান করার পর গত সাত-আট বছর ৮০ বিঘা পরিমাণ জমির ঘেরে মিঠাপানির মাছ চাষ করছেন।

উন্নত জাতের রুই, কাতল, মৃগেল, সিলভার কার্প, বাটাসহ অন্যান্য প্রজাতির সাদা মাছ উৎপাদন করেন তার ঘেরে। জমির লিজ মূল্য, মাছের পোনা ক্রয়, খাদ্য, শ্রমিকের বেতনসহ অন্য খরচ উঠিয়েও বছরে ২৫-৩০ লাখ টাকা লাভ হয় তার। এখন আর লোনাপানির চিংড়ি চাষ করেন না এ মৎস্য চাষী।

একই উপজেলার চুপড়িয়া এলাকার চাষী তানজির আহমেদ জানান, চার-পাঁচ বছর যাবত ৪৫ বিঘা পরিমাণ জমির ঘেরে বিভিন্ন ধরনের মিঠাপানির মাছ চাষ করেন। এর মধ্যে রয়েছে রুই, কাতল, পাবদা, পাঙাশ, কালিবাউস ও অন্য কার্পজাতীয় মাছ। গত মৌসুমেও একই পরিমাণ ঘেরে মিঠাপানির মাছ চাষ করেন। সব খরচ তুলে তার ১২ লাখ টাকা লাভ হয়। ফলে আগামীতে আরো বড় পরিসরে মিঠাপানির মাছের ঘের করবেন।

মিঠাপানির এসব মাছ কিনতে জেলার আড়তগুলোয় আসছেন অন্যান্য জেলার ব্যবসায়ীরা। সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বিনেরপোতা মৎস্য আড়ত জেলার মধ্যে বৃহত্তম। এছাড়া সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর বড়বাজার আড়ত, দেবহাটার গাজীরহাট আড়ত, আশাশুনি উপজেলার মহেশ্বরকাঠি আড়ত, খুলনা-বাইপাস সড়কের পাশে বকচরাসহ জেলার প্রায় ২৫০টি মৎস্য আড়ত ভোর থেকেই বেচাকেনা জমে ওঠে।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আব্দুর রব জানান, জেলায় মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বেড়েছে। জেলার প্রায় ২৫০ মৎস্য আড়তে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মিঠাপানির মাছ বিক্রি হচ্ছে। এসব মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয়। তিনি বলেন, চিংড়ি উৎপাদনে মৎস্যচাষীরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু মিঠাপানির মাছ চাষে তেমন ঝুঁকি থাকছে না। ফলে দিন দিন বাড়ছে মিঠাপানির মাছ চাষ ও বাজার।

সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান জানান, জেলায় কার্পজাতীয় মিঠাপানির মাছের উৎপাদন ও বাজার প্রসার হচ্ছে। বিশেষ করে করোনার পর থেকে মিঠাপানির মাছ উৎপাদন বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চাহিদার পাশাপাশি দাম কমে যাওয়ায় চাষীরা মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে ঝুঁকে পড়ছেন।

তিনি আরো জানান, জেলায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মিঠাপানির মাছের দেশীয় বাজার তৈরি হয়েছে। এসব মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে। আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদন বাড়াতে জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে চাষীদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শের পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি সহযোগিতা করা হচ্ছে। বর্তমানে এ জেলায় বছরে ১ লাখ ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টন মিঠাপানির মাছ উৎপাদন হচ্ছে। যার গড় দেশীয় বাজারমূল্য ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকার বেশি।