মেহেদী হাসান, রাজশাহী: সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বছরের শুরু থেকে চলতি আগস্ট পর্যন্ত এই আট মাসে পোল্ট্রি খাদ্যের দাম বেড়েছে চার দফা। সেইসাথে লাগামহীন বেড়েছে ভ্যাকসিন ও বাচ্চার মূল্য। অন্যদিকে কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে খামারে শ্রমিকের মজুরি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণ। ফলে উৎপাদিত পোল্ট্রি পণ্যের দামে উঠছে না উৎপাদন খরচ।

খামারিরা বলছেন, খাদ্যের ডিলার আর ঔষুধের দোকানে বকেয়ার পরিমাণে “গলার কাঁটা” হয়ে দাড়িয়েছে পোল্ট্রি ব্যবসা। এই করুণ পরিস্থিতির জন্য অদৃশ্য সিন্ডিকেটকেই দুষছেন তারা। ইতোমধ্যে রাজশাহীর ৪৫ শতাংশ পোল্ট্রি মুরগি (ব্রয়লার, লেয়ার ও সোনালী) খামার লোকসানে বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে রাজশাহী পোল্ট্রি ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার পুঠিয়া, দূর্গাপুর, তানোর ও বাগমারা উপজেলায় দেড় হাজার খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এরমধ্যে চরম লোকসানের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহীর পুঠিয়ার পোল্ট্রি খামারিরা। উপজেলায় গত এক বছরে প্রায় ৫ শতাধিক এর বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারি ঋণের দায়ে পথে বসেছেন। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে মুরগি পালনের শেডগুলো, নষ্ট হচ্ছে লাখ টাকার কাঠামো। লোকসানে পড়া খামারিদের বাড়িবাড়ি কিস্তির জন্য ঘুরছেন এনজিও কর্মীরা; পালিয়ে বেড়াচ্ছেন খামারিরা।

এ পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে খুচরা ও পাইকারি ডিম-মাংস বিক্রেতা, পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা, খাত সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গড়ে উঠেছে পোল্ট্রি খাদ্যের ডিলার। তারা খামারিদের অর্ধেক টাকা বাঁকিতে খাদ্য ও একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা সরবরাহ করে থাকে। খামারিরা সেই বাচ্চা কয়েকমাস পালনের পর বিক্রয় উপযোগী হলে ডিলার মুরগি বিক্রি করে দেয়। এতে যা লাভ আসে তা খামারিকে দেয় ডিলার। তবে, শর্ত-নির্দিষ্ট ডিলার ছাড়া খাদ্য, ভ্যাকসিন ও খামারের প্রয়োজনীয় পণ্য অন্য কোথাও কিনতে পারবেন না তারা। ফলে, সরকারি পর্যায়ে বস্তাপ্রতি ৩০ টাকা বাড়লে সিন্ডিকেট বাড়ায় ৭৫ থেকে ৯০ টাকা।

অপরদিকে বাঁকি হওয়ায় খামারি পর্যায়ে খাদ্যের প্রতি বস্তায় বাড়ে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। শুরুতেই ভ্যাকসিনের দাম ও পরিমাণভেদে কয়েক’শ টাকা এবং খামার তৈরির উপকরণে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ তুলে নেয় ডিলার। এছাড়া কোম্পানির এজেন্ট অথবা অ-রেজিস্টার্ড ভেটেরিনারি চিকিৎসক অপ্রয়োজনীয় ঔষুধ ব্যবহারে খামারিদের পকেট কাটে কৌশলে। কভিড-১৯ চলাকালে ডিম ও মাংসের দাম কমে যাওয়ায় শত শত খামারি এভাবেই লোকসানে পড়েছে। মহাজনের টাকা শোধ করতে না পারায় পেশা বদলেছে অনেকেই। ফসলি জমি, ঘর-ভিটা বিক্রি করে মহাজনের টাকা শোধ করেছে এমন খামারিও রয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ডিলার ছাড়াও বাচ্চা উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকদের বেশ বড় সিন্ডিকেট রয়েছে। প্রতিপিস সোনালী মুরগির বাচ্চার উৎপাদন খরচ পড়ে ১২ টাকা। একই বাচ্চা খামারিদের হাতে আসা পর্যন্ত দাম বেড়ে হয় ২৫ থেকে ৩৮ টাকা। খামারিরা বলছেন, পোল্ট্রি শিল্পে সবচেয়ে বেশি ভ’মিকা পালন করে এই মালিকরা। ডিলারদের সাথে একটা শতাংশ চুক্তিতে খামারি ধরার মিশনে নামে তারা। কাজ করে এলাকাভেদে কিছু এজেন্ট। একবার বাচ্চা খামারে উঠিয়ে দিতে পারলেই তাদের কাজ শেষ। এবার খামারিদের সারাবছর জোঁকের মতো চুষে খায় ডিলার, ভেটেরিনারি চিকিৎসক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।

এই ত্রিমুখী সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো: এনামুল হক  এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, এখন বড় বড় কোম্পানি পোল্ট্রি খাতে বিনিয়োগ করেছে। তারা ইচ্ছামতো খাদ্যের দাম বাড়ায়। কারণ তারা নিজেরাই খাদ্য, বাচ্চা, মাংস ও ডিম উৎপাদন করে। আর এর বাইরে যেসব খামারি থাকেন তাদেরকে ডিলাররা চুষে খায়। বছরের যেকোন দুই সময় মুরগির মাংস ও ডিমের দাম বাড়ায় তারা। যাতে নতুন খামারি তৈরি হয়। আবার সারাবছর ধরে লোকসান দেয় খামারিরা। পোল্ট্রি সেক্টরে গরুর মতো হটাৎ বিক্রি করে দেওয়া যায় না। জমি বিক্রি করে হলেও মুরগিকে খাওয়াতে হয়। সয়ং সরকারও এই সিন্ডিকেট ভাঙতে ব্যার্থ। প্রতি ডিমের উৎপাদন খরচ ৬ টাকা ১০ পয়সা, বিক্রি হয় ৫ টাকা ২০ পয়সা। চোরাবালিতে আটকে গেছে খামারিরা।

পুঠিয়ার লেয়ার মুরগির খামারি সৈয়দ আলী এগ্রিকেয়ারকে জানান, গত তিন বছর আগে ব্যাংক ঋণ ও ধারদেনা করে উপজেলা সদর এলাকায় ৭ হাজার ৫০০ লেয়ার মুরগির খামার গড়ে তোলেন তিনি। যখন আশানুরুপ ডিম শুরু হয় তখন ডিমের বাজার পড়ে যায়। ৫০ কেজির বস্তা ১৮০০ টাকা থেকে বেড়ে ২১০০ টাকা হয়ে যাওয়ায় কয়েক মাস চালিয়ে খামার বন্ধ করতে হয় তাঁকে। প্রায় ৩৬ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে তাঁর। তিনি বলেন, “আমার মত এরকম কয়েকশ’ খামারিরা পথে বসেছেন।”

উপজেলার ভালুকগাছি এলাকার জাকির হোসেন বলেন, স্থানীয় এক পোল্ট্রি ডিলারের পরামর্শে একটি কোম্পানীর সাথে বয়লার মুরগি পালনে চুক্তি করেছি। কোম্পানির চুক্তি মোতাবেক তারা বাচ্চা, খাদ্য ও চিকিৎসা খরচ বহণ করে। আমি শুধু খামারে লালন-পালনের কাজ করি। অল্প আয়ে বেঁচে আছি।

ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে কথা হয় দেড় যুগ আগের পোল্ট্রি পণ্য ডিলার “আদর্শ পোল্ট্রি, ফিস ও ডেইরি ফিড”র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এইচ এম আরিফুজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন, সরকার সিন্ডিকেটের কিছুই করতে পারেনা। আগে আমার আন্ডারে ৮০ থেকে ৯০ হাজার মুরগি পালন করত খামারিরা। এখন ৩০ হাজারে নেমে এসেছে। গতকালও (২২ আগস্ট) প্রতিবস্তায় খাদ্যের দাম ৭৫ টাকা বেড়েছে। দাম বাড়ার কোন কারন নাই। ভুট্টা, সয়ামিল কোনকিছুর দাম বাড়েনি। সরকারের সাথে লিংক করে কোম্পানিরা দেশটাকে চুষে খাচ্ছে। খামারিরা ধ্বংশ হয়ে গেলো।

পোল্ট্রি ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, গত দেড় বছরে বাচ্চা, খাদ্য, মুরগির চিকিৎসা ও শ্রমিকের মুজরির ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। অথচ মুরগির ডিম বা মাংশের দাম তুলনামূলক অনেক কম। এখন আগের মত মুরগি পালনে তেমন একটা লাভজনক নয়। অধিকাংশ খামারিরা ঋণগ্রস্থ্য হয়ে পথে বসেছেন। এর মধ্যে কিছু খামারিরা কোম্পানির সাথে চুক্তিতে বয়লার ও সোনালী মুরগি পালন করছেন। আর হাতে গোনা দুই চারজনের লেয়ার মুরগি খামার রয়েছে। সবকিছু সিন্ডিকেটের কাজ। জমি বিক্রি করেও টিকতে পারলাম না। সরকার নিজেই সিন্ডিকেট রুখতে পারে না, আর আমরাতো আমজনতা। অভিশাপ দেওয়া ছাড়া কিছু করার নাই।

সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মোঃ আখতার হোসেন  বলেন, হটাৎ চালের দাম বেড়ে গেলে মানুষ বলে-সিন্ডিকেটের কাজ। সারাদেশের অবস্থা একইরকম। পোল্ট্রি খাদ্য তৈরি হয় ঢাকায়; ফিড মিলের সবগুলোই তাদের হাতে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এটি নিয়ন্ত্রণের কোন উপায় নেই। আমদানি, উৎপাদন, বিপনন সবকিছুই তাদের হাতে। সিন্ডিকেট কোথায় নেই বলেন! প্রশ্ন রাখেন এই কর্মকর্তা।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ