কমলা

মাহফুজার রহমান মাহফুজ, ফুলবাড়ী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: কৃষক আবু বকর সিদ্দিকের হাত ধরে ফুলবাড়ী উপজেলার সুজানেরকুটি গ্রামের নামটাই বদলে গেছে। ৬ বছর আগে শুরু করা তার কমলার বাগানের সংগ্রাম অন্য রুপে দেখা দিয়েছে। সুজানেরকুটি এখন কমলার গ্রাম, কপাল খুলেছে কৃষকদের।

গ্রামটিতে লাভজনক ফল কমলা চাষে অনেকেরই ভাগ্য বদল হয়েছে। গতানুগতিক কৃষির বাইরে এসে এ ফল চাষে অনেকেই এখন আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। লাভজনক হওয়ায় প্রতিদিনিই বাড়ছে গ্রামটিতে কমলার চাষ। পুরো উপজেলায় এ গ্রামের সুখ্যাতি ছড়িয়ে যাওয়ায় দূর দূরান্তের অনেকেই এসে কমলা চাষের পরামর্শ ও চারা নিয়ে যাচ্ছেন।

তবে শুরুর চ্যালেঞ্জটা একটু অন্যরকম ছিলো কৃষক আবু বকর সিদ্দিকের জন্য। দেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা উপজেলা ফুলবাড়ী উপজেলায় নেই কোন শিল্প কলকারখানা। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের জীবন জীবিকা কৃষি নির্ভর। আর সমতল ভূমিতে বেশিরভাগ কৃষক ধান চাষাবাদ করে তাদের জীবন জীবিকায় টিকে থাকার লড়াই করেন।

উপজেলার বেশিরভাগ কৃষক যখন প্রধান ফসল হিসেবে ধান চাষাবাদ করে লাভ লোকসানের হিসাব কষতে ব্যস্ত, ঠিক সেসময় উপজেলার ভাঙ্গামোড় ইউনিয়নের সুজানেরকুটি গ্রামের কৃষক আবুবকর সিদ্দিক দার্জিলিং এর সাদকি জাতের কমলা চাষে সফল হোন।

মাত্র ২৮ শতাংশ জমিতে কমলা চাষে কপাল খুলে তাঁর। কমলা চাষে তাঁর এমন সফলতায় এলাকাটিতে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে কমলা চাষ। তাঁর দেখাদেখি প্রতিবেশীরাও করেছেন কমলা বাগান। এরই মধ্যে গ্রামটি নতুনভাবে পরিচিতি পেয়েছে কমলার গ্রাম নামে। গ্রামটির অনেক পরিবারই কমলা বাগান ও গাছ লাগিয়ে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখছেন। আর কমলা চাষের মধ্যে দিয়ে উপজেলার কৃষিতে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে।

এলাকাটিতে গিয়ে দেখা গেছে, বাগান ও বাড়ির আঙিনায় থোকায় থোকায় ঝুলছে কাঁচা পাকা কমলা। বিভিন্ন আকারের রসালো কমলার ভারে নুয়ে পড়া ডালগুলো বাঁশের ‘ঠেকা’ দিয়ে উঁচু করে রাখা হয়েছে। কমলা গাছের এমন দৃশ্য হাসি ফুটিয়েছে কমলা চাষিদের মুখে। কমলা বিক্রি করে অনেকেই পরিবারের সচ্ছলতা এনেছেন।

আবু বকর সিদ্দিক জানান, সুজানেরকুটি গ্ৰামের সমতল ভূমিতে ২০১৬ সালে প্রতিবেশী দেশ ভারতের দার্জিলিং এর সাদকি জাতের কমলা চাষের সূচনা করেন। প্রথমে তিনি ও তাঁর ছোট ভাই আবুল হোসেন বাজার থেকে ৪টি কমলার চারা গাছ কিনে বাড়ির আঙিনায় রোপণ করেন। তিন বছর পর গাছে ফল ধরা শুরু হয়। প্রতিটি গাছে ৭০-৯০ টি ফল ধরে। গাছের টসটসে সুস্বাদু পাকা কমলা দেখে প্রতিবেশীরাও অবাক হয়।

এরপর ২০১৯ সালে আবুবকর সিদ্দিক কমলার বাগান শুরু করেন। যশোর জেলার মহেশপুর গ্ৰামের জনৈক আশরাফুল ইসলামের নার্সারি থেকে দার্জিলিং এর সাদকি জাতের কমলা চারা সংগ্রহ করেন তিনি।

বাড়ির পাশের ২৮ শতক জমিতে ১৩৫টি কমলার চারা ১০ ফুট অন্তর লাগান। সামান্য রাসায়নিক সারের সাথে প্রচুর পরিমাণে জৈব সার প্রয়োগ করেন। ২৮ মাস পর ফুল আসা শুরু হয়। বর্তমানে গাছের ডালে দুলছে কমলা। বিক্রির উপযোগী হলেও এখন পর্যন্ত  বিক্রি করেননি। ভালোভাবে পাকিয়ে কমলার বীজ সংগ্রহ করে চারা উৎপাদন করবেন। স্থানীয় বাজারে প্রতিটি চারা ৫০থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। চারা বিক্রি করতে পারলে প্রচুর টাকা আয় হবে, জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, দেশে পাহাড়ি এলাকায় কমলা বাগান আছে। এ ছাড়া বাজারে ভুটান ও ভারতের দার্জিলিং থেকে আমদানি করা কমলার প্রাধান্য। তবে তাঁর বাগানে উৎপাদিত কমলাও কোন দিক থেকে পিছিয়ে নেই। তার বাগানের কমলাও রং, রস, স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয়।

প্রতিকূল অবস্থা থেকে সফল এ কমলা চাষি বলেন, ভালো মানের কমলা হওয়ার কারণে আশপাশের অনেকে এখন তাঁর বাগান দেখতে আসছেন। তাঁর এ জাতের সুস্বাদু কমলা চাষ সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পারলে আর বিদেশ থেকে কমলা আমদানি করার প্রয়োজন হবে না। এমন সুস্বাদু কমলা বিদেশে রপ্তানিও করা যাবে। তাঁর এই কমলার চাষ করতে তিনি অন্য চাষিদের উৎসাহিত করছেন। কমলা বাগান করতে তিনি নিজে আরও দুই বিঘা জমি প্রস্তুত করেছেন।

আরও পড়ুন: বারো মাসের ১২ টি ফলের গাছ নির্বাচন ও উৎপাদন কৌশল

খরচ বিষয়ে তিনি জানান, বর্তমান বাগানে যে কমলা আছে তা বিক্রি করলে যাবতীয় খরচ বাদে কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা আসবে। চারা কিনে নিয়ে আসা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত তার ৭৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ চারা সংগ্রহের জন্য যোগাযোগ করছেন।

তাঁর দেখাদেখি প্রতিবেশী সাইদুল হক, মহর উদ্দিন, মেহের আলী, নাজিম উদ্দিন, শাখাওয়াত হোসেন, মজনু মিয়া, আলী হোসেনসহ ২০ জন বাড়ির আঙিনায় ও পতিত জমিতে কমলার চাষ শুরু করেন। এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্ৰামে। সুজানেরকুটি এখন কমলার গ্রাম, কপাল খুলেছে কৃষকদের।

আরও পড়ুন: টবে চায়না কমলা চাষ পদ্ধতি ও পরিচর্যা কৌশল

এদিকে কমলা চাষে আবুবকরের কপাল খুলে যাওয়ার গল্প এখন মুখে মুখে। তাই তো প্রতিদিন কমলা বাগান দেখতে অনেকেই আসেন। এমন দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে তাঁর কমলা বাগানটি একটি পর্যটন কেন্দ্র। তার কমলার বাগানের গাছে গাছে দুলছে কাঁচা পাকা শত শত কমলা।

কমলাগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, স্বাদেও অনেক মিষ্টি। তাঁর এ উদ্যোগ এ অঞ্চলের বেলে-দোআঁশ সমতল মাটিতে কমলা চাষে ব্যাপক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে । আবু বকরের বাগানের প্রত্যেকটি গাছে ৮৫ থেকে ৯০ কেজি কমলা ধরেছে।

আরও পড়ুন: বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে পাকা ধানের ঘ্রাণ

প্রতিবেশী আহাদ আলী বলেন, শুধু এলাকার মানুষ নয়, দূর দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসছেন বাগান দেখতে। এ জাতের কমলা চাষ খুবই সাড়া ফেলেছে। যারাই এখানে আসছেন আকৃষ্ট হচ্ছেন গাছের সৌন্দর্যের প্রতি। আবুবকর সিদ্দিকের বাগান দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই কমলা বাগান করেছেন। কেউ কে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

ওই গ্ৰামের মাইদুল হক জহির উদ্দিনসহ আরো বেশ কয়েক জন বলেন, আমরাও বাগান করেছি। তবে এখনও ফল আসেনি। আমরাও বাগান থেকে ভালো ফলন পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।

সার্বিক বিষয়ে উপজেলা কৃষি কৃষি কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, এ উপজেলার মাটি লেবু জাতীয় ফল চাষের জন্য উপযোগী। এখানকার আবহাওয়া এবং মাটি অনুকূলে থাকায় প্রচুর কমলার চাষ করা সম্ভব। ওই কৃষকের সফলতা দেখে অনেকেই এখন কমলা চাষে আগ্রহী। কমলার আবাদ বৃদ্ধির জন্য বাগান করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।