কৃষিবিদ সমীরণ বিশ্বাস, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: কলা ফল হিসেবে বহুল সমাদৃত এবং বারোমাসি একটি ফল। পৃথিবীর ১০টি দেশে এটি উৎপাদিত হয় এবং এটি বিশ্বের চতুর্থ অর্থকরী ফসল। অন্য যে কোনো ফলের তুলনায় কলা সবচেয়ে বেশি খাবার হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তবে,‘সুপার ফ্রুট’ কলা- কখন উপকারী আর কখন ক্ষতিকর? এ বিষয়ে জানতে হবে।

লেখাটি থেকে জানা যাবে যে, কলা আপনার জন্য কতটা উপকারী এবং এর পুষ্টিগুণের ব্যাপকতা, পাশাপাশি কোন-কোন শারীরিক অবস্থায় কলা খাওয়া যাবে না, তা নিয়েও এখানে আলোকপাত করা হয়েছে।

পড়তে পারেন: কাঁচা কলার পুষ্টিগুণ জানলে আপনিও অবাক হবেন

কলায় বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানের সুষম উপস্থিতির কারণে একে ‘সুপার ফ্রুট’ বলা হয়। একটি মাঝারি আকৃতির (১২৬ গ্রাম) কলা থেকে ১১০ ক্যালরি পাওয়া যায়। এতে ৩০ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১ গ্রাম প্রোটিন থাকে, তবে কলায় কোনো ফ্যাট থাকে না। কলায় উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম আছে, যা দিয়ে দৈনিক চাহিদার প্রায় ২৩% পূরণ করা সম্ভব। এছাড়াও ভিটামিন-এ, ভিটামিন-সি, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেশিয়াম, জিংক ইত্যাদি খনিজ উপাদানের আধার বলা যায় কলাকে। কলায় আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাদ্য-আঁশ, যা দৈনিক চাহিদার ১৬% পরিমাণ যোগান দেয়। এত সব খাদ্য উপাদান কলায় আছে বলে একে প্রাকৃতিক মাল্টিভিটামিনও বলা হয়।

পুষ্টি উপাদান কলা (১২৬ গ্রাম)
পরিমাণ
পটাশিয়াম
৪৫০ মিলি গ্রাম
আয়রন বা লৌহ
০.৩ মিলি গ্রাম
ম্যাগনেশিয়াম
৩৪.০ মিলি গ্রাম
ম্যাঙ্গানিজ
০.৩ মিলি গ্রাম
ভিটামিন বি-৬
০.৫ মিলি গ্রাম
ভিটামিন-সি
৯.০ মিলি গ্রাম
রিবোপ্লাভিন
০.১ মিলি গ্রাম
নায়াসিন
০.৮ মিলি গ্রাম
ভিটামিন-এ
৮১.০ আই.ইউ
ফোলেট
২৫.০ মাইক্রো গ্রাম
আঁশ
৩.০ গ্রাম

কলার উপকারিতা: এখুন দেখি কলা কীভাবে আমাদের উপকারে আসে।
১. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে: কলা পটাশিয়ামের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। আর এই পটাশিয়াম দেহের অম্ল-ক্ষার ভারসাম্য-রক্ষায় এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এছাড়াও পটাশিয়াম-এর ঘাটতি থাকলে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন দেখা যায়। এই ঘাটতি পূরণ করতে গবেষকরা প্রতিদিন কলা খাওয়ার পরামর্শ দেন।

আরোও পড়ুন: কলার যেসব উপকারি গুন

২. স্ট্রোক-এর ঝুঁকি হ্রাসে: বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দেহে পটাশিয়াম-এর লেভেল কমে গেলে হৃদস্পন্দনের হার অস্বাভাবিক হয়ে যায়, যা স্ট্রোক-এর ঝুঁকি সৃষ্টি করে। কলায় রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাশিয়াম। The Author নামক একটি প্রসিদ্ধ Neurology journal-এ গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে, প্রতিদিন একটি ক’রে কলা খেলে তা স্ট্রোক-এর ঝুঁকি হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৩. প্রাকৃতিক অ্যান্টাসিড: The Journal of Nutritional Biochemistry ’র একটি গবেষণায় উঠে এসেছে কলার আলসার বিরোধী ভূমিকার কথা। কলা গ্যাস্ট্রিক জ্যুস-এর অ্যাসিডিটি নিষ্ক্রিয় করার ক্ষেত্রে দারুণ কাজ করে। এটি পাকস্থলীর অভ্যন্তরীণ দেয়ালে একটি আবরণ সৃষ্টি ক’রে আলসার প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।

৪. ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং কোলেস্টেরল-এর মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে: কলায় যে খাদ্য-আঁশ আছে, তা শরীর থেকে ফ্যাট শোষণ ক’রে ব্যক্তির ওজন কমাতে সাহায্য করে। কলায় কোলেস্টেরল নেই বললেই চলে। তাছাড়া কলায় আছে খাদ্য-আঁশ, যা রক্তের কোলেস্টেরল-এর মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক।

৫. স্ট্রেস ও ইনসমনিয়া হ্রাসে: কলায় রয়েছে ট্রিপ্টোফ্যান নামক উপাদান, যা দেহে গিয়ে সেরাটোনিন নামক হরমোনে পরিবর্তিত হয়। এই হরমোন মানুষকে হাসি-খুশি ও প্রাণবন্ত রাখতে কাজ করে। ফলে, অতিরিক্ত চাপ কমে ও আরামদায়ক ঘুম হয়। তাই এখন থেকে মন খারাপ হলে ঝটপট একটি কলা খেয়ে নিতে পারেন, আপনার মন ভালো হয়ে যাবে।

আরোও পড়ুন: বাতাবি লেবু খাওয়ার উপকারিতা

৬. শিশুদের ব্লাড ক্যান্সার নিরাময়ে: American Journal of Epidemiology’র গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, প্রতিদিন নিয়ম ক’রে একটি কলা খেলে ০-২ বছর বয়সের বাচ্চাদের লিউকেমিয়া নামক ব্লাড ক্যান্সার নিরাময়ে সহায়ক হয়।

৭. শিশুদের শ^াসকষ্ট প্রতিরোধে: European Respiratory Journal প্রায় ২,৬৪০ জন প্রাথমিক স্কুলগামী বাচ্চাদের ওপর একটি গবেষণা ক’রে দেখা গিয়েছে যে, প্রতিদিন একটি ক’রে কলা খেলে বাচ্চাদের অ্যাজমায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়।

৮. ডায়াবেটিক রোগীর ক্ষেত্রে: কলার গ্লাইসেমিক ইন্ডেক্স ৫১। অর্থাৎ কলায় যে সামান্য পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট আছে, তা রক্তের শর্করা মন্থরভাবে বৃদ্ধি করে। আর তাই ডায়াবেটিক রোগীরা অনেকটাই নিশ্চিন্তে দৈনিক কলা খেতে পারেন, যেখানে অন্যান্য ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বাধা থাকে।

৯. অন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া রক্ষায়: কলায় আছে সেলুলোজ, হেমি-সেলুলোজ, আলফা-গ্লুকানের মতো খাদ্য-আঁশ, যা অন্ত্রের কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। এছাড়া এটি কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া উভয়টির নিরাময়ে ভূমিকা রাখে। কলায় বিদ্যমান উপাদান প্রচুর পরিমাণে পানি শোষণ করে অন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া বজায় রাখে। কলায় রয়েছে fructo-oligo-saccharide নামক উপাদান, যা অন্ত্রে বিদ্যমান অক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়ার পুষ্টির যোগান দেয়। এই ব্যাক্টেরিয়া অন্ত্রে ভিটামিন সংশ্লেষ করে এবং খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে।

আরোও পড়ুন: জেনে নিন ফুলকপির গুনাগুণ ও উপকারিতা

১০. স্নায়ুতন্ত্রের সুরক্ষায়: Cornell University’র একটি গবেষণায় দেখা যায় যে, কলায় উপস্থিত ফেনোলিক ফাইটোকেমিক্যাল স্নায়ুকোষের বিষাক্ততা দূর করতে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও প্রতিদিন নিয়মিত কলা খেলে তা স্নায়ুকোষের চাপ কমাতে সাহায্য করে, যা আলঝেইমার-এর মতো স্নায়বিক রোগের বিপরীতে কাজ করে।

১১. বাচ্চাদের সুষম খাবার: বাচ্চারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঠিকমতো খেতে চায় না। ফলে ওদের দেহ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানের ঘাটতি দেখা দেয়। এক্ষেত্রে কলা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা কলায় রয়েছে বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ উপাদান। তাছাড়া কলা সহজে হজমযোগ্য হওয়ায় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে তা কোনো ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে না।

১২. পেশীতে খিঁচ ধরা রোধে: অনেক সময়েই দেখা যায় যে, ঘুমের মধ্যে অথবা খেলতে গেলে পায়ের মাংসপেশিতে খিঁচ ধরে বা রগে টান ধরে। এই সমস্যা সমাধানে কলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেননা কলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম। পটাশিয়ামের অভাবে সাধারণত এই সমস্যার উদ্ভব ঘটে।

১৩. রক্তস্বল্পতার ক্ষেত্রে: কলায় আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে আয়রন। আর এই আয়রন দেহে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে ভূমিকা রাখে এবং রক্তস্বল্পতা দূর করতে ভূমিকা রাখে।

আরোও পড়ুন: পুদিনা পাতার ব্যবহার ও উপকারিতা

১৪. শক্তির যোগানদাতা : কলায় আছে সুক্রোজ, ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজের মতো প্রাকৃতিক শর্করা এবং খাদ্য-আঁশ। এই উপাদানগুলো দেহে শক্তির যোগান দেয়।

৫. দেহের প্রতিরক্ষাতন্ত্রের সহায়ক: কলায় ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স আছে, তা আমরা আগেই জেনেছি। এই বি-কমপ্লেক্স-এর একটি উপাদান হচ্ছে ভিটামিন-বি৬। কলায় এই ভিটামিন-বি৬ রয়েছে দৈনিক চাহিদার প্রায় ২৫%। এটি দেহে অ্যান্টিবডি ও লোহিত রক্তকণিকা তৈরি করে, যা দেহকে যে কোনো ধরনের সংক্রমণ হতে সুরক্ষা দেয়।

কলার ক্ষতিকর দিক:
কিছু মানুষের কলায় অ্যালার্জি থাকে। তারা কলা খেলে গলা চুলকাতে পারে, হাঁচি হতে পারে আবার চামড়ায় গোটা-গোটা হতে পারে, যাকে আমবাত (Hives) বলে।

এছাড়া কিডনিতে যাদের সমস্যা থাকে, তাদের কিডনি রক্ত থেকে অতিরিক্ত পটাশিয়াম দূর করতে পারে না। এজন্য তাদের শরীরে পটাশিয়ামের মাত্রা কম রাখতে হয়। কলা যেহেতু উচ্চ পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার, তাই কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের কলা না খাওয়াই ভালো।

কলায় বেশ ভালো পরিমাণে আঁশ থাকে, যা অনেকের দেহে অ্যাসিডিটি তৈরি করে। এর ফলে কলা খেলে অনেকের পেট ফাঁপা, পেট কামড়ানো অনুভূতি হয় এবং এই অ্যাসিডিটির কারণেই মাইগ্রেনের রোগীদের মধ্যে অনেকেরই গলা ব্যথা শুরু হয়।
কলা একটি স্বাস্থ্যকর খাবার, যা পুষ্টিগুণে ভরা। কিছু বিশেষ অবস্থা ছাড়া কলা শরীরের জন্য অনেক উপকারী। তাই সচেতন ব্যক্তি মাত্রই প্রতিদিন অন্তত একটি করে কলা খান।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ