ড. মো. শরফ উদ্দিন, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আরএআরএস, বারি, মৌলভীবাজার: দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর দেশের মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যস্ত হযে পরেন মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব:) সোলায়মান। সোনাগাজী এগ্রো কমপ্লেক্স পরিদর্শনে কথা হলো এই সফল ও সাদামনের মানুষের সাথে যা অনেককেই স্বপ্ন দেখাতে পারে।

এক দশক আগেও দেখা গেছে, সারা দেশে যে পরিমান আম উৎপাদিত হয় তার ৫০-৬০ ভাগই উৎপাদিত হয়েছে দুই জেলা রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে। তবে বর্তমানে দেশের ২২ জেলায় আমের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে এবং অন্যান্য জেলাগুলোতেও আম গাছ জন্মাতে ও ফলন দিতে দেখা যায়।

আর এই আম চাষকে অনেকে পেশা হিসেবে পছন্দ করেছেন। তবে এই প্রকৃতির মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। যেমন শিবগঞ্জের আমচাষী মো. মজিবর রহমান, রংপুরে হাড়িভাঙ্গা আমের জনক আলহাজ্ব আব্দুস সালাম সরকার, চট্টগ্রামের প্রফেসর কাজী শাহাদাৎ হোসেন, ফেনীর মেজর (অব:) সোলায়মান এবং খুলনার এ্যাডভোকেট মো. শাহাদাত হোসেন সকলেই চেষ্টা করেছেন আমের চাষ সম্প্রসারণ করতে ও ভালোমানের উৎপাদন বাড়াতে।

চলতি আমের মৌসুমে হঠাৎ করেই সোনাগাজী এগ্রো কমপ্লেক্সে যাওয়ার সুযোগ হলো। এই কমপ্লেক্সের মালিক বহুদিন আগে থেকেই দাওয়াত দিয়েছিলেন তার বাগানটি পরিদর্শনের জন্য ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরামর্শ প্রদানের জন্য। তবে কোন ভাবেই সময় হচ্ছিল না উনার আম বাগানটি পরিদর্শনের।  প্রয়োজনীয় পরামর্শ মোবাইলের মাধ্যমে আদান- প্রদান হতো।

সরেজমিন আলাপের মাধ্যমে জানা গেল সোনাগাজী উপজেলার মুহুরী প্রকল্প এলাকায় ৭০ একর জায়গায় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এই কমপ্লেক্সটি। প্রথমে মাছ চাষ ছিল। পরে এর সাথে যোগ হয়েছে গবাধিপশু ও ফলবাগান। আম বাগান করেছেন প্রায় ৫ একর জমিতে।

ইচ্ছের কমতি নেই এখনও। এক একর জায়গায় আম বাগান স্থাপনের সর্বাধুনিক ধারণা অতি ঘন পদ্ধতিতে আম বাগান স্থাপন করেছেন যেখানে ব্যানানা ম্যাংগো জাতটিকে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি নিরাপদ, বিষমুক্ত ও স্বাস্থসম্মত আম উৎপাদনে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন।

প্রতি নিয়ত ছুটে বেড়াচ্ছেন নতুন জাতের খোজে। এর পাশাপাশি তিনি মৌমাছি পালন করে বাণিজ্যিকভাবে মধু উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করে থাকেন। বর্তমানে উনার কমপ্লেক্সে ৬৫ জাতের দেশী-বিদেশি আমের জার্মপ্লাজম আছে। এখনও কয়েকটি জার্মপ্লাজম ফল দিতে শুরু করেনি। তিনি স্বপ্ন দেখছেন নিজ বাগানে সারাবছর ফল ফলবে এবং দেশের মানুষ সেগুলো উপভোগ করবে।

সোলায়মান সাহেবের কাছে আমবাগান বিষয়ে আগ্রহের কথা জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি জানালেন উনার শৈশবকাল কেটেছে আমগাছ দিয়ে ঘেরা বাড়ির মধ্যে। তখন থেকেই আমের সাথে আম বাগানের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে। উনার মনের মধ্যে একটি জিনিস ঘুরপাক খাচ্ছিল কিভাবে সারাবছর আম ফলানো যাবে। সেই থেকেই দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জাতের সংগ্রহ বাড়াতে থাকেন।

উনার কমপ্লেক্সের গুরুত্বপূর্ন জাতগুলো হলো ব্যানানা ম্যাংগো। দেখতে লম্বাটে, কোন কোন আমে বোটার পাশে খয়েরি আভা দেখা যায়। পাকলে সম্পূর্ন হলুদ বর্ন ধারন করে। এই জাতের মাতৃগাছ আছে ৫০০ টি আছে যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আরেকটি আছে মধুরানী জাত। সুমিষ্ঠ স্বাদযুক্ত, বড় আকারের, প্রতিটি ফলের ওজন ৪৫০-৫০০ গ্রাম, পাকলে হলুদ বর্ন ধারণ করে।

এই জাতের মাতৃগাছ আছে ৫০০ টি আছে যা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং অন্য কোথাও নেই। বারি আম-১১ জাতের মাতৃগাছ আছে ২০০ টি। এছাড়াও অন্য জাতগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বারি আম-৩ (আ¤্রপালি), হাড়িভাঙ্গা, ল্যাড়া, ফজলি, আশ্বিনা, তোতাপুরি, ডেওরি, বারি আম-৪ ইত্যাদি। অন্য ফলের মধ্যে আছে ফলের রাজা কাঁঠাল, কলা, লিচু, নারিকেল ইত্যাদি।

তিনি প্রতি বছর পাকা আম দ্বারা ৫০০ কেজি আমসত্ত্ব তৈরী করে থাকেন এবং পরিচিত মানুষ, বন্ধু-বান্ধবদেও মাঝে বিতরণ করে থাকেন। উনার নিজস্ব একটি নাসূারী আছে।

যেখানে সম্ভাবনাময় জাতসমুহের কলম তৈরী কওে আগ্রহীদের চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করা হয়। উক্ত নার্সারীটি একটি অর্থ উপার্জনের উৎস হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই নার্সারী হতে ২০১৬ সালে ৫০০০টি বিভিন্ন ফলের কলম বিতরণ করা হয়েছেযার আনুমানিক মূল্যে বারো লক্ষ টাকা, ২০১৭ সালে ১০০০০টি যার আনুমানিক মূল্যে ২৫ লক্ষ টাকা এবং ২৫০০০টি কলম বিক্রয়ের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন।

আমবাগান হতে আয় আসে ২০ লক্ষ টাকার মতো। আম কেন্দ্রিক ব্যবসা যে মানুষকে কোটি টাকার স্বপ্ন দেখাতে পারে তার বাস্তব প্রমান মেজর (অব:) সোলায়মান। উনার কমপ্লেক্সের নিয়মিত কাজ করে জীবন ধারণ করেন ১০-১২ জন নিয়মিত ও  ১২ জন অনিয়মিত শ্রমিক।

তিনি দেখানোর চেষ্ঠা করেছেন শুধু রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে নয় অন্য জেলাতে ও আমবাগান করার সম্ভবনা রয়েছে। এদেশের যে কোন জায়গায় পরিকল্পনা করে আমবাগান করলে ক্ষতির কোন সম্ভবনা নেই। উনার আশা এই সোনার দেশে সারাবছর আম ফলবে এবং দেশের মানুষ সারাবছর আম খেতে পারবে।

ফলে ভারত ও থাইল্যান্ড হতে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে নি¤œমানের আম আমদানি করতে হবে না। আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষনা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে আম উৎপাদনের সকল ধরণের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে ও ভবিষৎতে এই ধরণের সহযোগিতা অব্যহত থাকবে।

আম বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, পরিকল্পিতভাবে আমচাষ করলে দেশের বেশিরভাগ জেলাতেই সফলভাবে আম উৎপাদন করা সম্ভব।