গোলাম মর্তুজা সেলিম, সিকৃবি প্রতিনিধি, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বছরে ৭ থেকে ৮ মাস হাওরে চারিদিকে থৈথৈ পানি থাকে। শুধুমাত্র বসতভিটার উঁচু জায়গাটুকুই দ্বীপের মত ভাসমান থেকে যায়। বোরো ফসল নির্ভর হাওরাঞ্চলে এক সময় শীতকালেও মাঠের পর মাঠ পতিত থাকত।

সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনায় হাওরে জীবনমান উন্নয়নে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (সিকৃবি) এর কার্যক্রমে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সিকৃবির প্রচেষ্টায় সেখানে ফিরে এসেছে সচ্ছলতা।

২০১৫ সাল থেকে সুনামগঞ্জের দেখার হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের প্রান্তিক কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে সিকৃবি নানাবিধ পদক্ষেপ নিয়েছে।

সিকৃবির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের সহায়তায় কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন (কেজিএফ) এর অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পে খরিপ ও রবি মৌসুমে লাগসই প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে প্রান্তিক জনপদের বিভিন্ন উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।

প্রকল্পের প্রধান গবেষক প্রফেসর ড. মো. আবুল কাশেম, প্রফেসর ড. মো. আবু বকর সিদ্দিক, প্রফেসর ড. মো. শহীদুল ইসলাম, প্রফেসর ড. জসিম উদ্দিন আহাম্মদ. পিএইচডি ফেলো সহযোগী প্রফেসর মো. আব্দুল আজিজ, গবেষণা সহযোগী মান্না সালওয়া সহ অন্যান্য গবেষকদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে লাগসই ধান চাষ, সবজি চাষ, মাছ চাষ, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগী পালন, কবুতর পালন সহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

সুনামগঞ্জের দেখার হাওরের কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন ফসলের চারা, সার, ধান, হাঁস-মুরগী, ছাগল-ভেড়া প্রদান করা হয়েছে। বোরো ধান নির্ভর কৃষকরা বসতবাড়িতে সারা বছর সবজি চাষের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি স্বল্পপুজিঁতে হাঁস-মুরগী, ছাগল-ভেড়া পালন, কবুতর পালন, মৌসুমি পুকুরে মাছ চাষের সমন্বিত উদ্যোগের ফলে পরিবারের সচ্ছলতা ফিরে এসেছে।

প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫৭টি পরিবারের সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন কৃষি উপকরণ দিয়ে সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। পূর্বে তারা প্রচলিত পদ্ধতিতে মূলা, পাট, কলমি, লাউসহ ৭ ধরনের সবজি চাষ করলেও বর্তমানে লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রীষ্ম ও শীত মৌসুমে ২০ প্রজাতির সবজি চাষ করেও সারাবছর নিজেদের চাহিদা পূরণের পর বিক্রিও করছে।

এর ফলে ২০১৫ সালের আগে সবজি চাষ পরিবার প্রতি খরচ বাদে ২১৪ টাকা আয় করতে পারলেও ২০১৭ সালে পরিবার প্রতি ২৩ হাজার টাকার উপরে আয় করতে সক্ষম হয়েছে।

এক সময় গরু ও ভেড়ার খুরা রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে লোকসান দিয়ে গবাদিপশু বিক্রি করতে হলেও বর্তমানে ভেকসিন দিয়ে সহায়তার কারণে গরু ও ভেড়া পালন করে লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি গরু মোটাতাজাকরন ও দুগ্ধ উৎপাদনবাড়ানোর লক্ষ্যে সুষম খাবার তৈরি করার প্রযুক্তি কৃষকদের হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে।

শীতকালে মৌসুমি পুকুরে সরপুঁটি, তেলাপিয়া, রুই ও কাতলা মাছ চাষে প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করায় মৎস্যউৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্নত জাতের সবজি ও ফসলের চাষাবাদ করায় রমজান আলী, মো. সাখাওয়াত হোসেন, মো. আলমগীর হোসেন, সালমা বেগম, দিলারা বেগম, মাফিয়াবেগমসহ ১৫৭ কৃষক পরিবারের জীবনমানেপ্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে।

এদের মধ্যে জবান আলী ২০১৬ সালে মিষ্টিকুমড়া বিক্রি করে প্রায় ২৩ হাজার টাকা, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগী পালন করে প্রায় ৪৯ হাজার টাকাসহ গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন সবজি চাষ করে আর্থিকভাবেস্বাবলম্বী হয়েছেন। মো. আলমগীর হোসেন ২০১৭ সালে বন্যা পরবর্তী সময়ে খাঁচায় মাছ চাষ করে ৭০ হাজার টাকা আয় করেছেন। এছাড়া ২ বিঘা পতিত জমিতে মো. সাখাওয়াত হোসেন সরিষা সহ উন্নত জাতের সবজি ও ফসলের চাষাবাদ করে প্রায় ৪৫ হাজার টাকা লাভ করেছেন।

রমজান আলী ব্রি ৫৮ জাতের উচ্চফলনশীল ধান ও সুষম সার ব্যবহারের ফলে প্রতি বিঘায় ১৮-২০ মণের অধিক ধান উৎপাদনে সক্ষম হয়েছেন। এছাড়া দিলারা বেগম ৬ ছেলে মেয়ের সংসারে হাঁস-মুরগী পালনের পাশাপাশি বাড়ির আঙ্গিনায় টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। সর্বোপরি ২০১৭ সালে প্রতি পরিবারের গড় আয় ৫০ হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ লক্ষ ৫৮ হাজারে উন্নীত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে সিকৃবির ভিসি প্রফেসর ড. মো. মতিয়ার রহমান হাওলাদার এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, সরকারী বেসরকারি পর্যায়ে সহযোগিতা পেলে হাওর অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি জাতীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা সম্ভব।