ড. এম. মনজুরুল আলম মণ্ডল, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক বিনাধান-২৩ নামে সমস্ত বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকা এবং জোয়ার ভাটাপ্রবণ এলাকায় চাষের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। যে ধান, ১৫ দিন পানিতে ডুবে থাকলেও মরবে না।

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল জোয়ারভাটাপ্রবণ হওয়ায় প্রতি বছর নিচু এলাকার বিরাট অংশের আমন ধান নষ্ট হয়ে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি করে। জোয়ারভাটাপ্রবণ এলাকায় আমন ধান চাষ উপযোগী জাত উদ্ভাবনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের বিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে জোয়ারভাটা ও আকস্মিক বন্যাসহিষ্ণু আমন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন।

বিনাধান-২৩ জাতটি ৮ ডিএস/মি মাত্রার লবণাক্তা ও ১৫ দিন পর্যন্ত জলমগ্নতা সহ্য করতে পারে। এছাড়া জাতটি স্বল্পমেয়াদি বিধায় এ জাতটি কর্তন করে পরবর্তী রবি ফসল সঠিক সময়ে চাষ করা যায়। এটি উচ্চফলনশীল ও উন্নত গুণাগুণসম্পন্ন রোপা আমন জাত। গাছ শক্ত বলে হেলে পড়ে না। পূর্ণবয়স্ক গাছের উচ্চতা ১১০-১১৬ সেমি.।

পড়তে পারেন: জনপ্রিয় হচ্ছে জিঙ্কসমৃদ্ধ নতুন ধান ‘বঙ্গবন্ধু-১০০’

পাতা গাঢ় সবুজ ও খাড়া। চাল সাদা রঙের, লম্বা ও মাঝারি চিকন। রান্নার পরে ভাত ঝড়ঝড়ে হয় ও খেতে সুস্বাদু। স্বাভাবিক অবস্থায় এর জীবনকাল ১১৫-১২৫ দিন এবং জলমগ্ন অবস্থায় ১৫ দিন ডুবে থাকলে জীবনকাল ১৩০-১৩৫ দিন। যথোপযুক্ত পরিচর্যায় জলমগ্ন অবস্থায় প্রতি হেক্টরে ৪.৫ টন (একরে ৫০ মণ) এবং স্বাভাবিক অবস্থায় ৫.৮ টন (একরে ৬৫ মণ) ফলন দেয়।

বিশেষ গুণ : বিনাধান-২৩ উচ্চফলনশীল এবং এর জীবনকাল তুলনামূলকভাবে অনেক কম বলে শস্য নিবিড়তা বাড়ানোর জন্য খুবই কার্যকর। আগাম পাকা জাত হিসেবে এ জাতটি চাষ করে সঠিক সময়ে তেল ও ডাল ফসল চাষ করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া গম ও আলুর চাষ ও ভালভাবে করা যায়। ফলে এসব ফসলের উৎপাদনও বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে।

আঞ্চলিক উপযোগিতা : লবণাক্ত, জোয়ারভাটা ও বন্যাকবলিত এলাকাসহ মাঝারি-উঁচু থেকে নিচু জমি এ ধানের চাষের জন্য উপযুক্ত। এ ছাড়া রোপা আমন অঞ্চল বিশেষ করে আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকা যেখানে বন্যার পানি এসে ১৫ দিনের মধ্যেই নেমে যায়। বেলে দো-আঁশ এবং এটেল দো-আঁশ জমি বিনাধান-২৩ চাষের জন্য উপযোগী।

পড়তে পারেন: নতুন ধান দুলালী সুন্দরী চাষে আগ্রহ বাড়ছে চাষিদের

চাষাবাদ পদ্ধতি : জাতটির চাষাবাদ পদ্ধতি অন্যান্য উফশী রোপা আমন জাতের মতোই। তবে এর জীবনকাল কম বিধায় ভাল ফলন পেতে হলে চারার বয়স ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। নিম্নে জাতটির চাষাবাদ প্রযুক্তি দেয়া হলো।

বীজ বপনের সময় ও বীজের হার : জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ (শ্রাবণ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ) হতে আগস্টের শেষ সপ্তাহ (ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ) এর মধ্যে বীজতলায় বীজ বপন করতে হবে। প্রতি হেক্টর জমি চাষের জন্য ২৫-৩০ কেজি বা এক একর জমির জন্য ১০-১২ কেজি বীজ প্রয়োজন হয়। উপযুক্ত ফলন নিশ্চিত করতে হলে ভারী, পুষ্ট ও রোগবালাই মুক্ত বীজ বাছাই করতে হবে। বপনের আগে বীজ শোধন করা ভাল। প্রতি কেজি বীজের জন্য ২ গ্রাম ব্যাভিস্টিন বা অন্য কোন উপযোগী বীজ শোধক ছত্রাকনাশক পরিমাণমতো প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে ১২ ঘণ্টা রেখে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে বীজ শোধন করা যায়।

পড়তে পারেন: নতুন জাত উদ্ভাবন, একটি ধানের জায়গায় ৯টি ধান

চারার বয়স ও রোপণ পদ্ধতি : ২০-২৫ দিন বয়সের চারা রোপণ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। বেশি বয়সের চারা লাগালে ফলন কমে যায়, তাই ৪ সপ্তাহের বেশি বয়সের চারা রোপণ করা কোন অবস্থাতেই উচিত নয়। বীজতলায় চারা করার পর লাইন করে চারা রোপণ করলে ফলন বেশি হয়। ২-৩টি সুস্থসবল চারা একত্রে এক গুছিতে রোপণ করতে হবে। সারি হতে সারির দূরত্ব ২০ সেমি. এবং সারিতে গুছির দূরত্ব ১৫ সেমি. থাকা ভাল।

সার ব্যবস্থাপনা
সারের পরিমাণ সারণি : ১ দ্রষ্টব্য। রোপণের জন্য জমি তৈরির শেষ চাষের আগে সম্পূর্ণ টিএসপি, এমওপি, জিপসাম এবং দস্তা সার জমিতে সমভাবে ছিটিয়ে চাষের মাধ্যমে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া সারের অর্ধেক পরিমাণ চারা রোপণের ৭-৮ দিন পর এবং বাকি অর্ধেক ৩০-৩৫ দিন পর উপরিপ্রয়োগ করতে হবে অথবা এক-তৃতীয়াংশ চারা রোপণের ৭-৮ দিন পর, এক-তৃতীয়াংশ চারা রোপণের ১৮-২০ দিন পর এবং শেষ তৃতীয়াংশ চারা রোপণের ৩০-৩৫ দিন পর জমির উর্বরতার ওপর নির্ভর করে প্রয়োগ করতে হবে। অনুর্বর জমিতে হেক্টরপ্রতি দস্তাসার ৪ কেজি (একরপ্রতি ১.৬ কেজি) হারে দেয়া যেতে পারে। ইউরিয়া সার প্রয়োগের ২/১ দিন আগে জমির অতিরিক্ত পানি বের করে দিতে হবে এবং প্রয়োজন হলে আগাছা দমন করতে হবে। জমির উর্বরতা ও ফসলের অবস্থায় ওপর নির্ভর করে সারপ্রয়োগ মাত্রার তারতম্য করা যেতে পারে।

পড়তে পারেন: নতুন ১০ জাতের ধান নিবন্ধন পেল

বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের জন্য সার : আকস্মিক বন্যায় জমি ডুবে গেলে সারের মাত্রা ও প্রয়োগপদ্ধতি ভিন্নতর হবে। সে ক্ষেত্রে জমি তৈরির সময় সার প্রয়োগের পরিমাণ সারণি-২ দ্রষ্টব্য।

যদি ধান গাছের প্রাথমিক বৃদ্ধিপর্যায়ে বন্যা হয়, তাহলে বন্যার পানি নেমে যাওয়ার ১০ দিন পরে প্রথম কিস্তিতে হেক্টরপ্রতি ৪৫ কেজি (একরে ১৮ কেজি) ইউরিয়া সার এবং হেক্টরপ্রতি ২৩ কেজি (একরে ৯ কেজি) এমওপি (পটাশ) সার প্রয়োগ করতে হবে। প্রথম কিস্তির ২০-২৫ দিন পর হেক্টরপ্রতি ৪৫ কেজি (একরে ১৮ কেজি) ইউরিয়া দ্বিতীয়বার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। তবে জমির উর্বরতার অনুযায়ী ইউরিয়া সারের মাত্রা কমবেশি হতে পারে।

পরিচর্যা : এই জাতের ধানের পরিচর্যা অন্যান্য উফশী জাতের মতোই। তবে এর জীবনকাল কম বিধায় চারা রোপণের পর আগাছা দেখা দিলে দ্রুত আগাছা পরিষ্কার ও মাটি নরম করতে হবে। বর্ষা মৌসুমের শেষে ফসল পাকার কিছু দিন আগে পানির অভাব দেখা দিলে সেচের প্রয়োজন হতে পারে তবে ধান পাকার ১০-১২ দিন আগে জমির পানি শুকিয়ে ফেলা ভাল।

পড়তে পারেন: নতুন ফসল চিয়ার কেজি ৫’শ টাকা, ভাগ্য বদলাচ্ছে কৃষকের!

রোগ ও পোকামাকড় দমন : পোকামাকড়ের আক্রমণ দেখা দিলে প্রচলিত তরল বা দানাদার কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ছাড়া খোল ঝলসানো, ব্যাক্টেরিয়াল লিফব্লাইট বা পাতা ঝলসানো ও অন্যান্য রোগ দেখা দিলে উপযুক্ত ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

খোল ঝলসানো, কাণ্ড পচা রোগ দেখা দিলে ফলিকুর, স্কোর বা বেনলেট মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে। মাজরা পোকার আক্রমণ হলে দানাদার কীটনাশক (মার্শাল ৬জি/কুরাটার ৫জি) মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া ব্লাস্ট রোগ দমনের জন্য ট্রুপার মাত্রা অনুযায়ী প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং প্রয়োজনে নিকটস্থ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার উপদেশ মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

বিনাধান-২৩ চাষে সতর্কতা : বিনাধান-২৩ চাষে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

যেমন : (১) ১৫ দিন জলমগ্ন থাকার পর বন্যার পানি জমি থেকে সরে যাওয়ার পরে গাছের শিকড় পচে কালো রং ধারণ করবে। এ অবস্থায় কমপক্ষে ৭ দিন জমিতে নামা যাবে না। ৭ দিন পর যখন নতুন চারা/কুশি গজাবে তখন জমিতে সার প্রয়োগসহ অন্যান্য পরিচর্যা করা যাবে। (২) জমি থেকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গাছের পাতায় পলি কিংবা বালু জমতে পারে। ফলে পাতার স্টোমাটা বন্ধ হয়ে পাতা জ্বলে সাদা হয়ে যেতে পারে।

পড়তে পারেন: সুগন্ধি ধানের দামে রেকর্ড, খুশি চাষিরা

তাই বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর পরিষ্কার পানি স্প্রে মেশিনের সাহায্যে গাছের পাতা ধুয়ে পরিষ্কার করে দিতে হবে। (৩) বন্যার পানি সরে যাওয়ার ১০-২০ দিন পর জলজ আগাছাসহ অন্যান্য আগাছা এবং ধানের পচা পাতা পরিষ্কার করে দিতে হবে। (৪) যে সব এলাকায় বন্যার পানি এসে ১০-১৫ দিনের মধ্যে পানি নেমে যায় এবং ক্ষেতে কোন পানি জমে থাকে না এমন জমিতে বিনাধান-২৩ চাষ করা যাবে। (৫) বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর জমিতে ১০-২৪ সেমি. (৪-১২ ইঞ্চি) পানি থাকা স্বাভাবিক। তবে দীর্ঘদিন ৩৫-৪০ সেমি. (১৪-১৬ ইঞ্চি) এর বেশি পানি থাকে, এমন জমিতে এ জাতটি চাষ করা যাবে না।

ফসল কর্তন, মাড়াই ও বীজ সংরক্ষণ : ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সঠিকভাবে ধান কর্তন ও বীজ সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগমুক্ত, পরিপুষ্ট ও বিশুদ্ধ বীজ ভাল ফলনের পূর্বশর্ত। এ জন্য ক্ষেতে যে স্থানে ভাল ফলন হয়েছে সে স্থান থেকে আগেই ভিন্ন জাতের গাছ তুলে ফেলতে হবে। অতঃপর ধান কর্তন করে এমন ভাবে মাড়াই ও ঝাড়াই করতে হবে যাতে অন্য জাতের ধান মিশ্রণ ঘটতে না পারে।

ধান মাড়াই করার সময় তিন বারি দিয়ে যে পুষ্ট বীজ পাওয়া যায় তাই বীজ হিসাবে রাখতে হবে। বীজ ভালভাবে শুকিয়ে নিয়ে (১২-১৪% আর্দ্রতা) টিন, প্লাস্টিক অথবা মাটির তৈরি মটকার উভয় পাশে এনামেল পেইন্ট দিয়ে ৬-৮ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। উল্লেখ্য, বীজ সংরক্ষণের পাত্রটি বায়ু নিরোধক অবস্থায় রাখা প্রয়োজন এবং পাত্রটিতে বীজ রাখার পর ফাঁকা স্থান অন্য কিছু দিয়ে ভরে রাখা প্রয়োজন।

ফলে কীটপতঙ্গের বংশবৃদ্ধি ও পোকার ক্ষতি থেকে বীজ রক্ষা পাবে। তাছাড়া নিমপাতা শুকিয়ে অথবা নিমের তেল বীজের সাথে মিশিয়ে রাখলে পোকার আক্রমণ হয় না ফলে বীজ ভাল থাকে।

১৫ দিন পানিতে ডুবে থাকলেও মরে না নতুন ধান বিনা-২৩ লেখাটি লিখেছেন ড. এম. মনজুরুল আলম মণ্ডল চিফ সায়িন্টিফিক অফিসার, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ, মোবাইলঃ ০১৭১৬৭৪৯৪২৯। ই-মেইল : [email protected]

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ