মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: ডিম-মুরগির দাম নিয়ে আলোচনা সমালোচনা থেমে নেই। ক্রমাগত পোল্ট্রি পণ্যের দাম উঠানামায় নাজেহাল খামারিরা। তবে কিছু কিছু খামারি কৌশলে লাভবান হচ্ছেন বলে জানা গেছে। তেমনই একজন খামারি মাহমুদ মোর্শেদ। যিনি মাত্র ২৮’শ লেয়ার মুরগিতে দিনে ৫ হাজার লাভ করছেন।

শুনতে সামান্য কটু লাগলেও এমনই দাবি করেছেন এই পোল্ট্রি খামারি। শুনিয়েছেন তাঁর লাভবান হওয়ার পেছনের কৌশল।

রাজশাহীর দূর্গাপুর উপজেলার কিসমতমাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা মাহমুদ মোর্শেদ। পিতা মোল্লা আব্দুল ওয়াহেদ ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান। সেই সুবাদে মোর্শেদদের ৪ ভাই আর ৩ বোনকে বেশ শিক্ষিত করেছেন। শিখিয়েছেন স্বাবলম্বী হওয়ার মূলমন্ত্র। চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট মোর্শেদ।

পড়াশোনা শেষ করেছেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে। ২০০২ সালে বিএফএ ও এমএফএ ডিগ্রি নিয়ে সোজা নেমে পড়েন ক্ষেত-খামারে। সমাজের মানুষের টিপ্পনি উপেক্ষা করে মনোযোগ দেন চাষাবাদে। আমের বাগান, মাছ চাষ, ফসলের ক্ষেত হয়ে উঠে মোর্শেদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

পড়তে পারেন: দেশ সেরা খামারি হলেন রাজশাহীর ইয়াসির আরাফাত

গত ২৩ সেপ্টেম্বর সরেজমিনে তাঁর পোল্ট্রি সেক্টরের বিষয়ে বেশ আলাপ-আলোচনা করা হয়। বাবার আমবাগানের ভেতর বিঘা দুয়েক জমির উপর করেছেন পোল্ট্রি খামার। সাদা লেয়ার ও লাল লেয়ার পুষছেন এখানে। সাদা লেয়ার এখনও উৎপাদনে আসেনি। বর্তমানে তাঁর এক খামারে ২৮’শ লাল লেয়ার রয়েছে। ডিম দিচ্ছে ৯৩ শতাংশ। আর বাজারে এসব ডিমের পাইকারি পিস হিসেবে তিনি বিক্রি করছেন ১০ টাকা দরে। সে হিসেবে প্রতিদিন প্রায় ২৬’শ ডিম পাচ্ছেন তিনি। আর বাজারদর হিসেবে ২৬ হাজার টাকা আসছে ডিম থেকে।

তিনি জানান ২৮শ মুরগিকে প্রতিদিন প্রায় ৭ বস্তা খাবার খাওয়াতে হয়। প্রতিবস্তা খাবার ২৮’শ টাকা হিসেবে তাতে খচর হয় প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার টাকা। ২৬ হাজার টাকার মধ্যে ১৯ হাজার খরচ হলে প্রতিদিন তাঁর পকেটে ঢুকছে প্রায় ৭ হাজার টাকা। তবে এই ৭ হাজারের মধ্যে হাজার দু’য়েক টাকা অন্যান্য খরচ করতে হয় ফলে তাঁর টিকে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা।

পড়তে পারেন: পাঙ্গাস চাষে কোটিপতি সিঙ্গাপুর ফেরত বেলায়েত

মাহমুদ মোর্শেদ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, লেয়ার মুরগিতে এখন বেশ লাভ হচ্ছে। ডিমের দাম যদি সাড়ে ৯ টাকা থেকে ১০ টাকার মধ্যে থাকে তাহলে প্রতিটি খামারি লাভবান হতে পারবেন। আমি সবকিছু (খাবার, ভ্যাকসিন, মেডিসিন) নগদ টাকায় কিনি। ধরুন-কোম্পানি রেটে ২৮’শ টাকা বস্তা খাদ্য পাই আমি।

এই খাদ্য অন্যান্য খামারিরা ৩ হাজার টাকা দরে কিনে। ডিলার প্রতিবস্তায় লাভ নেয় দুইশ টাকা। যদি মাসে ২০০ বস্তা খাবার কিনতে হয় আর ২০০ টাকা করে বাড়তি হয় তাহলে প্রায় ৪০ হাজার টাকা ডিলারের পকেটে গেলো। আর লাভের অংশ যদি ডিলারের পকেটে যায় তাহলে খামার টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। আর এ কারণেই রাজশাহীর অনেক ছোট খামার বন্ধ হয়ে গেছে।

পোল্ট্রি সেক্টরের সমস্যা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিম-মুরগির দামে উঠানামা এ সেক্টরের সবচেয়ে বড় সমস্যা। সবচেয়ে বড় বিষয় শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। যারা খাদের দাম বৃদ্ধি করে প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারিদের পথে বসিয়েছে। বেশি মুরগি যেমন ৫ হাজার দশ হাজারের খামার ছাড়া ৫শ ১ হাজারের খামার বন্ধ। আগে ডিলাররা খাবার, ঔষুধ বাঁকিতে দিতো কিন্তু এখন আর তারা দেয়না। ফলে পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা করার মতো ছাড়া বাঁকিতে ব্যবসা করার খামারগুলো বন্ধ হয়েছে। এতে সগুনা, নারিশের মতো কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে একচেটিয়া ব্যবসা চলে গেছে।

পড়তে পারেন: মরুর দুম্বা পালনে ৪ বছরে কোটিপতি বরিশালের বাদল

পোল্ট্রিতে লাভের টাকায় কৃষির অন্যান্য সেক্টরে বিনিয়োগ করেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ১৫ বিঘার মতো পুকুর আছে। বছরের পুরোটা সময় জুড়ে পোল্ট্রির টাকা দিয়ে মাছের খাবার ও গরুর খামারে বিনিয়োগ করি। মাছ ধরি বছরে একবার। ৯ থেকে ১০ কেজি ওজনের মাছ হলে সেগুলো তুলে ঢাকায় বিক্রির জন্য পাঠিয়ে দিই। একবারে ৫ লাখ কিংবা ৭ লাখ টাকা আসে। এদিকে পোল্ট্রি থেকে বছরে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা আসে। সবমিলিয়ে বছরে ২০ লাখ টাকা লাভ হয়।

একজন কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে আশেপাশের মানুষদের সহযোগিতা কতটুকু করতে পারেন-এমন প্রশ্নে মোর্শেদ বলেন, আমি আমার আশেপাশের গরীব মানুষদের গাভী কিনে দিই। আর গাভীর বাচ্চা হওয়ার পর অর্ধেক টাকা আমি নিই। পরবর্তীতে গাভী দিয়ে দিই। আশেপাশের অন্তত ১০ থেকে ১২টি পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। আমার খামারে মোট ৩ জন কাজ করে। তাদের প্রত্যেকের মাসিক বেতন ১২ হাজার টাকা।

পড়তে পারেন: মায়ের দেওয়া গাভী থেকে কোটিপতি আরাফাত

এই খামারের সাথে থেকে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন। আমি চাই আমার খামারটা আরো বাড়াতে। যাতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারি। কৃষির সেক্টরভিত্তিক বিনিয়োগে যেমন নিজে লাভবান হওয়া যায় তেমনি আশোপাশের মানুষেরও কর্মসংস্থান হয়।

জেলার পোল্ট্রি সেক্টরের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো: জুলফিকার আখতার হোসেন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, এখন ডিম-মুরগির দাম বেড়েছে। আগের বন্ধ হওয়া খামার এখন চালু হচ্ছে। আমরা প্রতিনিয়ত খামারিদের পরামর্শ প্রদান করছি। তাদের প্রয়োজনে সবসময় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর পাশে আছে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ