পোল্ট্রি ডেস্ক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: হটাৎ করেই পোল্ট্রি পণ্যের দাম বেড়ে যায় আবার কমেও যায়। এর আসল কারণ অনেকেই জানেন না। ব্যবসায়ীরা কখনো ‘সরবরাহ কম’, ‘আজ বৃষ্টি বেশি’, ‘আজ বেশি রোদ’, এসব অজুহাত দাঁড় করান। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণ করে কারা, কেন ধরা খায় খামারিরা?

মূলত দামের চাবিটা নাড়ায় হাতেগোনা কয়েকজন। গুটিকয়েক পোল্ট্রি কোম্পানির কারসজিতেই হুটহাট দাম চড়ে। জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোটবড় পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠলেও রাজধানীর অদুরে টঙ্গী, বোর্ড বাজার, জয়দেবপুর ও গাজীপুর এলাকাকে ঘিরে দেশের সবচেয়ে বড় পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠেছে। মূলত এখান থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজার।

আরোও পড়ুন: দাম কমেছে সব ধরণের মুরগির

প্রতিদিন সকালে এখানকার ব্যবসায়ীরা ফোনে একে অপরের সঙ্গে পরামর্শ করে দর নির্ধারণ করেন। যার প্রভাব পড়ে প্রায় সারা দেশে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পোল্ট্রি ব্যবসায়ীরাও প্রতিদিন সকালে টঙ্গী, বোর্ড বাজার, জয়দেবপুর ও গাজীপুরের বাজারের দর দেখে নিজেদের বিক্রয়মূল্য ঠিক করে।

একই সঙ্গে এসব শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত পোলট্রি খাদ্য ও ওষুধ আমদানিকারক তিন-চারটি কোম্পানিও এর সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গেছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, এসব কোম্পানি যে দামে ফিড ও ওষুধ আমদানি করে তার তুলনায় অনেক বেশি দামে বাজারে ছাড়ে। বাজার তো অস্থির হবেই। সারা দেশের চারটি কোম্পানি এসব পণ্য আমদানি করে বলে সিন্ডিকেট করা খুব সহজ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাজীপুর এলাকায় সোনার বাংলা পোল্ট্রি খামারের মালিক ইদ্রিস আলী, বোর্ডবাজার এলাকায় সাবিহা-সাহানা পোল্ট্রি খামারের মালিক মকবুল হোসেন ও জয়দেবপুরের আকাশ পোল্ট্রির মালিক গোলাম সরোয়ার; পাইকারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ এই তিনজনই মূলত রাজধানীর পোল্ট্রি বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই তিনজনই যোগসাজস করে প্রতিদিনের ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দর নির্ধারণ করেন। টঙ্গী, বোর্ড বাজার, জয়দেবপুর ও গাজীপুর থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মুরগি ও ও ডিম রাজধানীর গুলিস্তানে জড়ো করে। সেখান থেকে ভোর ৬টার আগেই রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লায় ছড়িয়ে পড়ে।

আরোও পড়ুন: অবশেষে বাড়ছে ডিম-মুরগির দাম

গুলিস্তানের পোল্ট্রি ব্যবসায়ী তোশারফ আলী জানিয়েছেন, গাজীপুর, বোর্ডবাজার ও জয়দেবপুর থেকেই ডিম-মুরগির দর ঠিক করা হয়। দাম বাড়ার জন্য বোর্ডবাজার, গাজীপুর ও জয়দেবপুরের ব্যবসায়ীরা দায়ী। তাদের নির্ধারিত দরের বাইরে কেনার সুযোগ নাই। তাদের কাছ থেকে আমরা যে দামে মাল কিনি, সেই দামের সঙ্গে পরিবহনসহ অন্যসব খরচ বাদ দিয়ে কেজিতে সর্বোচ্চ ৩ টাকা মুনাফা করি। অনেক সময় মুনাফা আরো কম হয়। কারণ অতদূর থেকে আনতে গিয়ে অনেক মুরগি মারা যায়। ডিমও ভেঙে যায়।

এ বিষয়ে সোনার বাংলা পোল্ট্রি খামারের মালিক ইদ্রিস আলী জানিয়েছেন, সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াই -এমন অভিযোগ ঠিক নয়। আমরা ব্যবসায়ীরা আলাপ আলোচনা করে দর ঠিক করি। কারণ, মুরগির বাচ্চা, মুরগির খাবার ও ওষুধের দাম, শ্রমিকের বেতনসহ সব খরচ মিটিয়ে আমাদেরও তো বেঁচে থাকতে হবে। উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে মুনাফার বিষয়টি নিশ্চিত করতেই পরামর্শ করি। এটাকে সিন্ডিকেট বলা ঠিক নয়।

তিনি জানান, ‘দেশের সর্বত্র এখন পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠছে। প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে হচ্ছে। এমন অবস্থায় তিন-চারজন মিলে বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। কাজেই এ অভিযোগ মনগড়া।’

ইদ্রিস আলী আরও জানান, ‘বিভিন্ন দুর্যোগে খামারে মুরগি মরে যায়, অসুখে মরে, ঠাণ্ডা বেশি পড়লেও মরে। নানা জটিলতায় মুরগি ঠিক সময়ে ডিম দেয় না। এসব কারণে অনেক খামারি ব্যবসাও গুটিয়ে নিয়েছেন। তাদের খবর কেউ রাখে না।’

আরোও পড়ুন: এক কেজি মুরগির দাম ৪৫০ টাকা!

এদিকে পোল্ট্রি খামারিদের অভিযোগ, পোল্ট্রি শিল্প বর্তমানে অনিশ্চিয়তার বেড়াজালে বন্দি। এর জন্য বাচ্চা ও খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী। তাদের একচেটিয়া ব্যবসার কারণে ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার পথে। তাদের অভিযোগ কাঁচামাল আমদানিকারক ও সয়াবিন মিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পোল্ট্রি ফিডের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এতে পোল্ট্রি পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে বাজার অস্থির হয়।

তাদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী গত তিন মাসে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে সয়াবিন মিলের, যা প্রায় ৫০ শতাংশ। ভুট্টার বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বাইপ্রোডাক্ট হচ্ছে সয়াবিন মিল, যার মূল কাঁচামাল ফূলফ্যাট সয়াবিন সিড যা আমদানি নির্ভর।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশে হাতেগোনা কয়েকটি গ্রুপ সয়াবিন তেল ও সয়াবিন মিলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে- এগুলো হচ্ছে সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, গ্লোব এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও যমুনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এসব কোম্পানির সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করে পণ্যের দাম।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিত সাহা জানিয়েছেন, এ কোম্পানি তেল, আটা চিনিসহ বিভিন্ন খাদ্য আইটেম উৎপাদন করে। সেখানে পোল্ট্রি ফিডের ব্যবসা মুখ্য নয়। সয়াবিনের বাইপ্রোডাক্ট সয়াবিন মিল। কাজেই সেই বাজারে কোনও মনোপলি করার সময় বা ইচ্ছা এসব বড় কোম্পানিগুলোর নেই। পোল্ট্রি ফিডের সঙ্গে সম্পৃক্ত পণ্যগুলো আমদানি নির্ভর। এসব পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি মূল্য বাড়লে আমাদের তো কিছুই করার থাকে না।

এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক জানিয়েছেন, ‘দেশের পোল্ট্রি একটি উদীয়মান শিল্প। এ কারণেই সরকার এ শিল্পের প্রসারে নানা সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে। এ শিল্পে জড়িতরা এ সব সুবিধা নিয়ে ভালো মুনাফা করছেন। এ শিল্পের ক্ষতি হয় এমন কিছু কাউকেই করতে দেওয়া হবে না। সরকার এ বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ।’

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ