এম এনামুল হক ও সামিনা হক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: আমকে সমানভাবে পাকাতে ও আকর্ষণীয় রঙ করতে ও কিছুটা আয়ু (সেলফ লাইফ) বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কিছু আম ব্যবসায়ীর আমে কয়েক ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করেন। আসলে এসব ক্যামিকেল বা রাসায়নিক ব্যবহার কতটা যৌক্তিক এবং রাসায়নিক ব্যবহৃত ফল শোধনের ঘরোয়া উপায় সম্পর্কে জানব:-

আমে ব্যবহৃত রাসায়নিক গুলোর মধ্যে ইথোফেন, ফরমালিন ও কার্বাইড অন্যতম। আম ফলে এসব রাসায়নিকের প্রভাব সম্বন্ধে কোনো প্রকার জ্ঞান বা ধারণা আহরণ না করেই অনেক পরিবেশবাদী, বুদ্ধিজীবী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিভিন্ন মিডিয়া কেমিক্যাল ব্যবহারের কুফল সম্বন্ধে অপপ্রচারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

১। ইথোফেন-ইথরেল (২ ক্লোরোইথেন ফসফরিক এসিড) :

ইথোফেন একটি প্লান্ট গ্রোথ হরমোন, তবে ইহা পরিপক্ব ফলকে পাকাতে এবং সংরক্ষণে ব্যবহার প্রচলন সারা পৃথিবীতে রয়েছে। গবেষকেরা বিভিন্ন মাত্রায় (২৫০-১০০০০ পিপিএম) ইথোফেন পরিপক্ব কাঁচা আমে স্প্রে করার ২৪ ঘণ্টা পর পুনরায় তার উপস্থিতি মাত্রা নির্ণয় করতে গিয়ে দেখতে পান যে উহা দ্রুত ফলের উপরিভাগ থেকে উড়ে যায়।

পড়তে পারেন: কাঁঠালের বিচি খাওয়ার উপকারিতা

তবে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তা ঋঅঙ/ডঐঙ কর্তৃক নির্ধারিত গ্রহণযোগ্যতা মাত্রার (এমআরএল-২পিপিএম) অনেক নিচে নেমে যায়। তাই ইথোফেন দিয়ে ফল পাকানোর স্বাস্থ্যগত কোনো ঝুঁকি নেই বলে বিজ্ঞানীদের মতামত। তবে আম চাষিরা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় ইথোফেন ব্যবহার না করে এবং উহা কেবলমাত্র পুষ্ট কাঁচা আমে ব্যবহার করে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান ও বহুল প্রচার ব্যবস্থা নেয়া অত্যাবশ্যক।

২। ফরমালিন :

আমের স্বাস্থ্য, উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি ও আয়ু (সেলফ-লাইফ) বৃদ্ধির জন্য কোনো কোনো আম ব্যবসায়ী কাঁচা আমে ফরমালিন ব্যবহার করে থাকে। তবে ব্যবহারের ৫-৭ দিন পর এ ধরনের ফরমালিনের তেমন কোনো প্রভাব থাকে না বলে গবেষকদের অভিমত। অধিকন্তু আমের বাইরের চামড়া বা ছিলকা পুরু হওয়ার কারণে আমের আহার্য অংশে তা প্রবেশ সম্ভবনা খুবই কম।

ফরমালিনের উপস্থিতি নির্ণয়ে বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে যে ফরমালডিহাইড টেস্ট মিটার (জেড-৩০০) ব্যবহার করা হচ্ছে তার কার্যকারিতা নিরূপণে গবেষকরা ব্যবস্থা নেন। ইথোফেন মিশ্রিত পানিতে এবং ফরমালিন মিশ্রিত পানিতে আম চুবানোর একদিন পর এ টেস্ট মিটার দিয়ে তারা পরীক্ষায় একই ফল দেখতে পান। কাজেই ফরমালডিহাইড মিটার (জেড-৩০০) দিয়ে ফরমালিন মাপা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে তাদের অভিমত। প্রকৃত পক্ষে ফরমালিন হলো ৩৭% ফরমালডিহাইড। মানবদেহে প্রতি মিলিলিটার রক্তে প্রকৃতিগতভাবে সর্বোচ্চ ২.৫ মাইক্রোগ্রাম ফরমালিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। মানবদেহে মেটাবিলিজম প্রক্রিয়ায় ফরমালডিহাইড প্রয়োজন।

পড়তে পারেন: আদা মিশ্রিত পানির উপকারিতা জানলে অবাক হবেন

হজম প্রক্রিয়ায় উহা ফরমিক এসিডে রূপান্তরিত হয় এবং তা প্রস্রাবের সাথে এবং সামান্য অবশিষ্ট অংশ নিশ্বাসের সাথে কার্বনডাইঅক্সাইড আকারে বের হয়ে যায়। এমনকি তা দেহের চর্বিতে ও জমা থাকে না। ফরমালিন পানিতে দ্রুত গলে বা মিশে যায় এবং কর্পুরের মতো বাতাসে উড়ে যায়। গবেষকেরা বিভিন্ন ফলবাজার ঘুরে সংগৃহীত নমুনায় কোনো ফরমালিনের উপস্থিতি পাননি। তথাপি সন্দেহ হলে আহারের আগে ফলকে পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিয়ে একদিন পরে তা আহার করলে নিরাপদ বলে বিবেচিত। তাই আমে ফরমালিনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে যে নানামুনি নানা প্রচারণা ছড়াচ্ছে তা ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মাণ হয়।

৩। ক্যালসিয়াম কার্বাইড :

পরিপক্ব ও অপরিপক্ব উভয় ধরনের আমে কার্বাইড ব্যবহার করলে তাতে ফলের উপরিভাগে পাকা আমের মত রঙ আসে। অপরিপক্ব টমেটোতে ইহা প্রয়োগ করে আগাম পাকানোর প্রচলন দেখা যায়। তবে অপরিপক্ব আমে কার্বাইডের ব্যবহার তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। কোনো কোনো অসাধু আম ব্যবসায়ী পরিপক্ব কাঁচা আম ঝুড়িতে রাখার আগে ৫ থেকে ৭ গ্রাম ক্যালসিয়াম কার্বাইড কাপড়ের পুঁটলিতে বেঁধে ঝুড়ির তলায় রেখে আম দিয়ে ঝুড়ি ভর্তি করে।

এতে ঝুড়ির ভেতর গ্যাস তৈরি হয়। ভেতর গরম হয় এবং আমের গায়ে ঘাম ঝরে। এ আমের ঝুড়ি নির্দিষ্ট বাজারে পৌঁছলে তা খুলে দিলে গ্যাস আকারে (কার্বন মনোঅক্সাইড) উড়ে যায়। মার্চ এপ্রিল মাসে দেশের আগাম জাতগুলো (গোপালভোগ, হিমসাগর, খুদিখিরসা, গোলাপ খাস) অপরিপক্ব থেকে যায়। তবে মে মাসের প্রথম ভাগে সাতক্ষীরা বেল্টের আম থেকে রাজশাহী অঞ্চলে আগাম জাতের আম পরিপক্ব হতে প্রায় ৩ সপ্তাহ বেশী সময় লাগে।

পড়তে পারেন: পটলের বীজ খাওয়ার ‍উপকারিতা জানলে অবাক হবেন

তাই আগাম জোনের (সাতক্ষীরা, যশোহর, কুষ্টিয়া) এ ধরনের আগাম জাতের আম মে মাস থেকে এবং রাজশাহী জোনের আম মে মাসের শেষ ভাগে কাঁচা আম পরিপক্ব হয়। মার্চ-এপ্রিল মাসে এসব আগাম জাতের স্থানীয় আম বাজারে পাওয়া গেলে ধরে নিতে হবে তা কার্বাইড দিয়ে পাকানো। কাজেই এ সময়ে বাজারে প্রাপ্ত আম খাওয়া কোনো মতেই ঠিক হবে না। ফল পাকাতে কোনোক্রমেই যেন ক্যালসিয়াম কার্বাইড বা কার্বাইড ব্যবহার না করে সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও জনসচেতনতা আনায়ন দরকার। কেননা ক্যালসিয়াম কার্বাইড মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক।

আম শোধনে রাসায়নিক ব্যবহার :

গাছ থেকে আম পাড়ার পর আমের কস বা দুধ বের হয়ে গেলে আম শোধন উপযোগী হবে। প্রতি লিটার পানিতে ০.৫৫ মি.লি. ‘প্লোক্লোরাজ’ নামক রাসায়নিক দ্রব্য মিশানো পানিতে আম ভালোভাবে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। এভাবে আম শোধনে আমের পচন রোধ হয় ও উজ্জ্বলতা বজায় থাকে।

অধিকন্তু, আম পাড়া থেকে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত আমের জীবনী (সেলফ লাইফ) ২-৩ সপ্তাহ বজায় থাকে। আম রপ্তানিকারক সব দেশেই এ পদ্ধতির ব্যবহার প্রচলন আছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে প্রতি লিটার পানিতে ০.৫-১.০০ গ্রাম ‘বেনোমিল’ নামক রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে তাতে একইভাবে আম শোধন করা যাবে। এ পদ্ধতিতে আম শোধন ব্যবস্থা ভারতে অতি জনপ্রিয়। অধুনা, কিছু সচেতন আমচাষি ভারত থেকে ‘বেনোমিল’ এনে আম শোধন করে সুফল পেয়ে আসছে।

গরম পানিতে আম শোধন :

গরম পানিতে পরিপক্ব কাঁচা আম শোধন করা হলে, আমের গায়ে লেগে থাকা রোগ জীবাণু ও পোকা মুক্ত হবে। গ্রাহকের কাছে অন্য আমের তুলনায় এ শোধিত আমের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে। মৌসুমে পরিপক্ব পুষ্ট কাঁচা আম গাছ থেকে সাবধানে পেড়ে তা আগে পরিষ্কার পানিতে ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

এরপর কোন পাত্রে ৫২০- ৫৫০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি (পানিতে হাত ডুবালে সহনীয়মাত্রায়) গরম হলে তাতে পরিষ্কার করা আমগুলো ঠিক ৫ মিনিট রেখে এক সাথে উঠিয়ে নিতে হবে। আমের গা থেকে পানি শুকিয়ে গেলে স্বাভাবিক নিয়মে আমগুলো প্যাকিং করে বাজারজাত করতে হবে। এ ব্যবস্থায় আমের জাতের প্রকারভেদে সাধারণ আমের (নন ট্রিটেট) চেয়ে গরম পানিতে শোধন করা আমের আয়ু (সেলফ লাইফ) ১০ থেকে ১৫ দিন বেড়ে যাবে। তবে এ পদ্ধতি প্রয়োগ সীমিত পরিমাণ আমের জন্য প্রযোজ্য।

আমে ব্যবহৃত সম্ভাব্য রাসায়নিক ও শোধনের ঘরোয়া উপায় লেখাটি লিখেছেন এম এনামুল হক ও সামিনা হক প্রাক্তন ডিজি, ডিএই সহকারী অধ্যাপক, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ধানমন্ডি, ঢাকা।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ