জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে দেশে গত এক দশকে ২০১০-১১ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত অর্থবছরে দুধ, ডিম ও মাংসের উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। এ সময়ে ডিম উৎপাদন বেড়েছে ১১’শ ৩ কোটি। যা ২০১০-১১ অর্থবছরে মাত্র ছিল ৬০৮ কোটি পিচ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে অর্থ্যাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে ডিমের উৎপাদন বেড়েছে ৩২১ কোটি পিস। বর্তমানে দেশে একজন মানুষ বছরে ডিম খাচ্ছেন ১২১টি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল ৬০৮ কোটি পিচ। এরপর উৎপাদন বৃদ্ধি ১৮২ শতাংশে দাঁড়ায়। দশবছর পর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭১১ কোটিতে। এর এক বছরের মাথায় করোনাকালে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মাত্র ২৫ কোটি ডিম উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৩৬ কোটিতে। করোনা মহামারি কমতে শুরু করলে বিস্ফোরণ হয় প্রাণিসম্পদে; বাড়তে থাকে উৎপাদন। ২০২০-২১ অর্থবছরে ডিম উৎপাদন ৩২১ কোটি বেড়ে ২ হাজার ৫৭ কোটি ৬৪ লাখে পৌঁছায়।

পড়তে পারেন: ডিমের হালিতে ৫, ব্রয়লারের কেজিতে কমলো ১০ টাকা

দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে গত এক দশকে আমিষের উৎপাদন ২৫০ শতাংশ বেড়েছে। বিগত ৫ বছরের পরিসংখ্যান যাচাই করলে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ সালে বাংলাদেশের মানুষ বছরে ডিম খেয়েছেন প্রায় ৯৩টি। এরপর ২০১৭-১৮ সালে ৯৫টি, ২০১৮-১৯ সালে ১০৪টি, ২০১৯-২০ সালে ১০৪টি এবং সর্বশেষ ২০২০-২১ সালে মাথাপিছু ডিম গ্রহণের পরিমাণ ১২১টি যা হিসেব অনুযায়ী দেশের মানুষের ডিম খাওয়া বেড়েছে ১৭টি। প্রাণিসম্পদের দাবি, দেশে পর্যাপ্ত পরিমান ডিম, দুধ, মাংস উৎপাদন হচ্ছে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পোল্ট্রি উৎপাদন বিভাগের পরিচালক ডা. রেজাউল হক এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, দেশে আমরা ডিম-মাংস উৎপাদনে স্বয়ংসম্পন্ন। দেশের মানুষ এখন বছরে ১২১টি করে ডিম খেতে পাচ্ছেন। জাতিসংঘের মা ও শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী আরো বেশি খাওয়া প্রয়োজন। দেশের উৎপাদন ও প্রাপ্তির উপর খাওয়া বাড়ে এবং ভিন্ন ভিন্ন দেশে এই ডিম খাওয়ার পরিমান আলাদা-আলাদা। একজন মানুষ বছরে ২৫০ থেকে ৩০০টি পর্যন্ত ডিম খেতে পারবেন-এতে সমস্যা হবেনা।

পড়তে পারেন: ডিম মুরগির দাম বাড়ার আসল কারণ!

এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ৫৭৪.২৪ কোটি এবং ২০১৯-২০ সালে এ পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৩৬ কোটিতে। অর্থাৎ গত ১০ বছরে বাংলাদেশে ডিমের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে ডিমের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে, বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী ডিম আমদানির প্রয়োজন পড়বে না। আমাদের খামারিরা বেশ লোকসান দিয়েছেন করোনাকালে এবং খাদ্যসহ আনুষাঙ্গিক পণ্যের দাম বাড়ার কারণে ডিমের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। বর্তমানের ৬০ টাকা হালি ডিম থাকবেনা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের দৈনিক জনপ্রতি ভোগ যেখানে ৩৩ দশমিক ৭২ গ্রাম ছিল, সেখানে ২০১৬ সালে তা কমে ২৭ দশমিক ৩১ গ্রামে নেমে এসেছে। তবে গরুর মাংসের জনপ্রতি ভোগ না কমে কিছুটা বাড়লেও তার পরিমাণ খুবই সামান্য, মাত্র শূন্য দশমিক ৭ গ্রাম।

পড়তে পারেন: ডিমের দাম কমাতে আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে সারাবিশ্বে যেখানে ডিমের উৎপাদন ছিল ৬১.৭ মিলিয়ন টন সেখানে ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৭৬.৭ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে মাত্র এক দশকের ব্যবধানে বিশে^ ডিমের উৎপাদন প্রায় ২৪ শতাংশ বেড়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ডিম উৎপাদনের একটি প্রাক্কলন করেছে। সে হিসাব অনুযায়ী, ২০৩১ সাল নাগাদ বাংলাদেশে ডিমের বার্ষিক উৎপাদন হবে প্রায় ৩২৯৩.৪ কোটি এবং ২০৪১ সাল নাগাদ ৪৬৪৮.৮ কোটি। এখন ধারণা করা হচ্ছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। বর্তমানে ২ হাজার ৫৭ কোটি ডিম উৎপাদন হয়েছে। ফলে ৩ হাজার ২৯৩ কোটিতে পৌঁছাতে ১২’শ কোটি ডিম প্রয়োজন। গত এক বছরে যা উৎপাদন অর্থ্যাৎ ৩২১ কোটি হিসেব ধরলে ৪ বছরের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।

সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মধ্যে হাঁস-মুরগির উৎপাদন দ্বিগুণ করা এবং ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পর্দাপণের নিমিত্ত অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী (২০২০-২০২৪) পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। তাছাড়া টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট-২০৩০ বাস্তবায়নে জনপ্রতি দুধ, মাংস ও ডিম যথাক্রমে ২৭০ মি.লি, ১৫০ গ্রাম এবং ১৬৫টি বছরে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) বাস্তবায়নের মাধ্যমে রূপকল্প-২০৪১ ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদশে রূপান্তরের লক্ষ্যে জনপ্রতি দুধ, মাংস ও ডিম যথাক্রমে ৩০০ মি.লি, ১৬০ গ্রাম এবং ২০৮টি বছরে ধরা হয়েছে যা পূরণ করতে পারবে বলেই ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পড়তে পারেন: কমছে ডিম-মুরগিতে, হু-হু করে বাড়ছে বাচ্চার দাম

জাতিসংঘের মা ও শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন বলছে, পুষ্টিহীনতার কারণে বাংলাদেশে স্কুলগামী শিশুদের ১৮ শতাংশ রোগা-পাতলা এবং ৯ শতাংশ স্থূলকায়। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, স্কুলগামী রোগা-পাতলা শিশুর হারের দিক থেকে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। পাঁচ বছরের নিচে খর্বকায় শিশুর হার ছিল ২৭ শতাংশ। স্বল্প ওজনের শিশু ২৩ শতাংশ এবং ক্ষীণ স্বাস্থ্য প্রায় ১০ শতাংশের।

বর্তমানে দেশে হাস-মুরগির পরিমাণ বাড়ছে। ২০১৬-১৭ সালের দিকে দেশে মোট হাঁস-মুরগি ছিল ৩২৯ কোটি ২০ লাখ। ৫ বছর পর ২০২০-২১ সালে এসে দাঁড়ায় ৩৬৫ কোটি ৮৫ লাখ। যা থেকে বছরে ডিম উৎপাদন হচ্ছে ২ হাজার ৫৭ কোটি ৬৪ লাখ। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, আগামী এক দশকে যে কয়টি আমিষ বা প্রাণিজ পণ্যের জনপ্রতি প্রতিদিনের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাবে, তার মধ্যে এগিয়ে থাকবে ডিম, মাংস ও দুধ। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর।

পড়তে পারেন: ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণ করে কারা, কেন ধরা খায় খামারিরা?

বাংলাদেশ পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সভাপতি খন্দকার মহসিন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ডিম-মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছে। খামারিরা করোনার কারণে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছিলেন নানা কারণে। বর্তমানে খামার নতুনভাবে চালু করছেন-বাচ্চা তুলতে শুরু করেছেন। কয়েকদিনের হিসেব অনুযায়ী বিপুল পরিমাণ বাচ্চা বিক্রি হয়েছে। ডিম পাড়া (লেয়ার) মুরগি ১৪৫ দিন বয়স থেকে ২০ থেকে ২৪ মাস পর্যন্ত ডিম দিতে সক্ষম। বর্তমানে যারা বাচ্চা তুলেছেন এগুলো উৎপাদনে আসলে দেশে প্রচুর ডিমের উৎপাদন হবে।

ডিম আমদানির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, কোনভাবেই আমরা ডিম আমদানি করতে দিতে পারি না। ডিম আমদানি করতে দেওয়া যাবে না। আমাদের দেশে প্রচুর ডিম-মাংস রয়েছে। স্বল্প সময়ের জন্য দাম বেড়েছে; আবার কমে যাবে। ডিম আমদানির মতো এমন সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নিতে পারেন না। যদি এমন সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তাহলে খামারিদের জন্য খুব খারাপ হবে। আমরা বলতে পারি-ডিম আমদানি হবে না। আমরা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে বুঝিয়ে বলেছি। খামারিদের ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।

 

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ