ড. মোহাম্মদ এরশাদুল হক: বর্তমান করোনাভাইরাস জনিত আপৎকালীন কৃষি ক্ষেত্রে সরকারের সুচিন্তিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং তার সঠিক বাস্তবায়নের অনন্য উদাহরণ হচ্ছে, কম্বাইন হারভেস্টারে উন্নয়ন সহায়তা প্রদান। গত বছর বোরো সংগ্রহের সময়ে শ্রমিকের দুষ্প্রাপ্যতা ও শ্রমিক মূল্যের উর্ধ্বগতিতে কৃষক যখন দিশেহারা কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক তখনই কৃষিতে কম্বাইন হারভেস্টারের ব্যবহার ও এ সংক্রান্ত সরকারি উন্নয়ন সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ ঘোষণা বাস্তবায়নে সরকারের রাজস্ব বাজেট থেকে এ মৌসুমে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ সরকারের কৃষকবান্ধব নীতির প্রতিফলন।

২০০৩-০৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে কৃষিতে শ্রমিকের প্রাপ্যতা ছিল ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ  যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কমে ৪০ দশমিক ২ শতাংশে নেমেছে। সেজন্য কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার এখন সময়ের দাবি। যে দেশ যত উন্নত সে দেশের একক আয়তনের কৃষি জমিতে যান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার তত বেশি। তাই কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষি জমিতে যান্ত্রিক শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা দরকার। বাংলাদেশে চাষের কাজে প্রায় শতভাগ ও সেচের ক্ষেত্রে ৮৫ ভাগ যান্ত্রিকীকরণ অর্জিত হলেও বীজ বপন/চারা রোপণ ও ফসল সংগ্রহের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করা যায়নি। মাঠ পর্যায়ে যন্ত্র সরবরাহ, প্রদর্শন ও প্রয়োজনীয় উন্নয়ন সহায়তার কার্যকর ব্যবস্থা না থাকায় ২০১৫ সালে দেশে শস্য কাটার ক্ষেত্রে মাত্র ১ শতাংশ  যান্ত্রিকীকরণ লক্ষ্য করা গেছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী ২০২১ সাল নাগাদ দেশের ফসল কর্তনে যান্ত্রিকীকরণ ৩০ শতাংশ  এ উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর এ লক্ষ্যে সরকার নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

আমরা জানি, প্রচলিত পদ্ধতিতে হাতে কাটা-মাড়াই করতে এক একর জমির জন্য ১৮-২০ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। এছাড়া বোরো মৌসুমে ধান ছাড়াও অন্যান্য রবি ফসল যেমন গম, ভুট্টা, আলু, সবজি এবং ফলও সংগ্রহ করতে হয়। ফলে বোরো সংগ্রহের এ সময়টিতে বিশেষ করে ধান সংগ্রহে চোখে পড়ার মতো কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়। এ শ্রমিক সমস্যা সমাধানে কম্বাইন হারভেস্টার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদ থেকেই সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।

পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের ইতিহাস বলে, দৌড়ের আগে যেমন হাঁটতে হয় তেমনি কম্বাইনভিত্তিক বড় যন্ত্রে যাওয়ার পূর্বে রিপার ও মাড়াই যন্ত্র কেন্দ্রিক ছোট যন্ত্রগুলোর ব্যবহার দিয়েই শুরু করতে হয়। আমাদের দেশেও ধান মাড়াইয়ের ক্ষেত্রে শতকরা ৮০ ভাগ মাড়াই যন্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। ছোট ও কম দামি কম্বাইন নিয়ে এ দেশে কম্বাইনের মাঠ পর্যায়ে যাত্রা শুরু হয়। সে পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যান্ডের এক হাজারের ওপরে কম্বাইন মাঠে রয়েছে যার অনেকগুলো ভালো কাজ না করলেও ওই যন্ত্রগুলো দ্বারা চালক, মেকানিক, এন্টারপ্রেনিয়র ও নীতি নির্ধারকদের মানসিক ও কর্মকৌশল ভিত্তিক লার্নিং হয়েছে। শুরুটা ঠিক থাকলেও বড় কম্বাইনে যেতে আমাদের একটু বেশি সময় লেগেছে।

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, ৩৫ অশ্বশক্তির নিচের কোনো কম্বাইন কারিগরি ও অর্থনৈতিক দুই দিক দিয়ে লাভজনক হয়নি। তাই এ পর্যায়ে কম্বাইন হারভেস্টারের মডেল নির্বাচনে মাঝারি সাইজকে প্রাধান্য দেয়া যথার্থ হয়েছে। মাঠে প্রাপ্য মাঝারি মানের একটি কম্বাইন হারভেস্টার ঘণ্টায় ১ থেকে ১ দশমিক ৫ একর জমির ধান কেটে মাড়াই-ঝাড়াই করে বস্তা বন্দি করতে পারে। সে হিসাবে এক একটি যন্ত্র দিনে গড়ে ১০ একর জমির ধান কাটতে পারে। অর্থাৎ ১৮০-২০০ জন শ্রমিকের কাজ একটি যন্ত্র এক দিনেই করতে পারে। সময়মত ফসল সংগ্রহ করার ফলে সংগ্রহোত্তর ক্ষতি অনেক হ্রাস পায়, প্রতিকূল আবহাওয়ায় ফসল নষ্ট হয় না, মোটের ওপর উৎপাদন খরচ কমে।

এতোসব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও যেসব কারণে কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহারে কৃষক উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসেনি তার অন্যতম কারণ হলো প্রাথমিক বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি কিন্তু যন্ত্রের ব্যবহার করা যায় বছরে মাত্র ৬০-৯০ দিন। এ জন্যই দরকার সরকারের উন্নয়ন সহায়তা। কৃষকবান্ধব সরকার সহজেই বিষয়টি অনুধাবন করায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছে। তারপরেও কৃষকের নিয়মিত অভিযোগ যন্ত্রের মান নিয়ে। তবে বর্তমানে সরকারের উন্নয়ন সহায়তার অন্তর্ভুক্ত সবকটি যন্ত্রই কারিগরি দিক দিয়ে বিশ্বমানের। তাহলে কী কারণে কৃষকরা যন্ত্র নিয়েও ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে তা উল্লেখ করা জরুরি।

কম্বাইন হারভেস্টার একটি উচ্চ প্রযুক্তির নলেজ বেইজড মেশিন, যেখানে যন্ত্রের পাশাপাশি যন্ত্রচালককেও দক্ষ ও জ্ঞানসম্পন্ন হতে হয়। কারণ ধানের জাত, ঘনত্ব, ধান খাড়া কিংবা হেলানো এসব অবস্থায় যন্ত্রের বিভিন্ন অংশের সেটিংস পরিবর্তন করতে হয়। শুকনো ধান ক্ষেতে যে গতিতে যন্ত্র চালনা করা যায় বৃষ্টি পরবর্তী ভেজা ক্ষেতে যন্ত্র চালনার গতি কমাতে হয় ও বিশেষ খেয়াল রাখতে হয় যাতে থ্রেসিং চেম্বারে জ্যাম না লাগে। প্রত্যেকটা যন্ত্রেই এসব অপশন থাকলেও প্রত্যেক চালকই তার ব্যবহার করে সুফল নিতে পারছেন না। এ জন্য যন্ত্রচালককে ভালো কারিগরি জ্ঞান সমৃদ্ধ হতে হবে। ভালো যন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে প্রশিক্ষিত চালক তৈরি করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই মুহূর্তে রাতারাতি প্রশিক্ষিত চালক তৈরি সম্ভব না হলেও দীর্ঘমেয়াদে প্রশিক্ষিত চালক তৈরির কার্যকর ব্যবস্থা এখনই শুরু করতে হবে।

এই করোনাকালে সড়ক পরিবহন বন্ধ থাকায় অধিকাংশ কম্বাইন হারভেস্টার চালনার ক্ষেত্রে ট্রাক বা অটোমোবাইল চালকদের অংশগ্রহণ দেখা যাচ্ছে যা কৃষির এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সহায়ক হচ্ছে। আমাদের কৃষিমন্ত্রীর কথার যথার্থতা প্রমাণিত হচ্ছে যে, দ্রুততম সময়ে আমাদের কৃষকরাও চালনায় পারদর্শী হচ্ছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই আরো কিছু জরুরি বিষয়ে সচেতন হওয়া দরকার। এ বিষয়গুলো ফ্যাক্ট শিট আকারে বাংলায় সরবরাহ করলে চালকরা সহজে আয়ত্ত করতে পারবেন।

এখানে আরও কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা যৌক্তিক মনে করছি- প্রত্যেক চালক মাঠে নামার পূর্বে নিজের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করবে। এরপর নিশ্চিত করতে হবে যন্ত্রের লুব্রিকেন্টের পরিমাণ ও ইঞ্জিনে পানির পরিমান। ব্যাটারি চার্জসহ পুরো ইলেকট্রিক সিস্টেম, কনভেয়ার সিস্টেম, মাড়াই চেম্বার চেক করে নিতে হবে। আর চেক করতে হবে প্রত্যেকটা নাট-বোল্টের সঠিক টাইট, বেল্টের সঠিক টান ও সেন্সরের কার্যকারিতা। মাঠে নামার পূর্বে আরো চেক করে দেখে নিতে হবে যে, ধানের ক্ষেতে পার্চিংয়ের খুঁটি বা অন্য কোনো খুঁটি/ধাতব দণ্ড আছে কিনা। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়ে মাঠে নামতে হবে। কাজ শেষে আবারো যন্ত্রটি পরিষ্কার করে রাখতে হবে।

যন্ত্র সরবরাহের সময়ে সাধারণত বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান সব লুব্রিকেন্ট সরবরাহ করে থাকে। এ লুব্রিকেন্টগুলো প্রথম ৫০ ঘণ্টা চালনার পড়ে ফেলে দিতে হয়। এরপর নিয়মিত বিরতিতে কম্বাইন হারভেস্টারে লুব্রিকেন্ট চেক করা ও ঘাটতি পূরণ করা খুবই জরুরি, কেননা এটা যন্ত্রের রক্তের মতো কাজ করে। সাধারণত যন্ত্রের সঙ্গে সরবরাহকৃত ম্যানুয়ালে এসব লেখা থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকরা ইংরেজীতে তত পারদর্শী নয় বিধায় বাংলায় ব্যবহারবিধি বা ম্যানুয়াল সরবরাহের উদ্যোগ নিতে হবে।

আমাদের দেশে প্রধানত দুই ধরনের কম্বাইন হারভেস্টার রয়েছে:  ১) হোল ফিডটাইপ যেখানে খড়সহ আস্ত ধান গাছটিই যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে বিধায় খড় কেটে যায় ও ২) হেড ফিডটাইপ যেখানে শুধু ধানের শীষ যন্ত্রের মধ্যে প্রবেশ করে বিধায় খড় আস্ত থাকে। হোল ফিড সিস্টেম চালানো সহজ ও সমস্যাও কম হয় কিন্তু আমাদের দেশে ধানের খড়ের নানাবিধ ব্যবহার ও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে বিধায় হেড ফিড সিস্টেম বেশি জনপ্রিয়। সরকারের উন্নয়ন সহায়তায় বিশ্বমানের ইয়ানমার, কুবোতা, ডেডং, ওয়ার্ল্ড, লাকি স্টার, সাইফেং এর মত ব্র্যান্ডকে নির্বাচন করা হয়েছে। ফলে মাঠে চালনার সময় নষ্ট হওয়ার প্রবণতা কম দেখা গেলেও অদক্ষ চালক ও নানাবিধ কারণে সমস্যা আসা অস্বাভাবিক নয়। যদিও উন্নয়ন সহায়তার কম্বাইন হারভেস্টারগুলোতে এক বছরের ওয়ারেন্টি ও ২ বছরের সার্ভিস ওয়ারেন্টি দেয়ার কথা তবুও তার সঠিক প্রাপ্রতা নিশ্চিত করতে হবে।

এখন ধান সংগ্রহের পিক টাইম চলছে। এসময়ে যদি কোনো কম্বাইন হারভেস্টার নষ্ট হয় এবং তার একটি ক্ষুদ্র পার্টস সংগ্রহেও যদি ২-৫ দিন সময় অপেক্ষা করতে হয় তবে মালিকের মাথায় হাত। যন্ত্রগুলো নতুন হওয়ায় এখনও গ্রামে-গঞ্জে এর স্পেয়ার পার্টস পৌঁছায়নি। আবার এ যন্ত্রের অভিজ্ঞ মেকানিকও অপ্রতুল। তাই প্রত্যেকটা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানেরই স্পেয়ার পার্টস হ এখন অতি জরুরি মেকানিক সেবার একাধিক দল গঠন জরুরি, সার্ভিস ভ্যানসহ যাতে দ্রুততম সময়ে মাঠে পৌঁছাতে পারে। মেকানিক ও চালকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি তাই গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করতে হবে। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, প্রশিক্ষিত চালক একটি মাঝারি মানের যন্ত্র দিয়েও লাভজনক ব্যবসা পরিচালনা করতে পারে; আবার আনাড়ি চালকের কারণে অনেক ভালো মানের যন্ত্র কারিগরি ও ব্যবসায়িক উভয়দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

জ্ঞাননির্ভর যন্ত্রের জন্য এটাই একটা প্রিকন্ডিশন যে, চালককে প্রশিক্ষিত হতে হবে। আমরা যদি সাইকেল আর মটরসাইকেলের উদাহরণ দেখি তবে দেখব যে, মটরসাইকেল যেহেতু জ্ঞাননির্ভর যন্ত্র তাই এর জন্য চালকের প্রক্ষিণের সনদ (লাইসেন্স) চাওয়া হয়। কৃষি ক্ষেত্রে জ্ঞাননির্ভর যন্ত্র যেমন কম্বাইন হারভেস্টার, ট্রাক্টর ও রাইস ট্রান্সপ্লানটারের জন্য নিকট ভবিষ্যতে লাইসেন্সিং ব্যবস্থাও চালু করা যেতে পারে। ট্রাক্টরের ব্যাপারে তো এ বিষয়গুলো এখনই প্রায়শই আলোচনায় আসতে শোনা যায়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি প্রকৌশলী ও তাদের প্রশিক্ষণ সুবিধাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। সাম্প্রতিক গুরুত্ব বিবেচনায় গণমাধ্যম বিশেষ করে টিভি চ্যানেলগুলোতে এ যন্ত্র চালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও সম্ভাব্য সমস্যার তথ্যভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র এবং অভিজ্ঞ কৃষি প্রকৌশলীর মাধ্যমে অনলাইন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

এখন অধিকাংশ যন্ত্র আমাদের হাওড় এলাকার বিস্তীর্ণ মাঠে কাজ করছে কিন্তু যখন এরা দেশের মধ্য, উত্তর কিংবা দক্ষিণ অঞ্চলে যাবে তখন এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে পরিবহনজনিত অবকাঠামোগত সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। এখন কৃষক তার উদ্ভাবনী চিন্তা দ্বারা সমস্যার উত্তরণ ঘটালেও দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের গ্রামীণ সড়ক ও অবকাঠামো উন্নয়নের কর্মসূচিও হাতে নিতে হবে। এ বোরো মৌসুমের ধান সংগ্রহের পরে কম্বাইন হারভেস্টারগুলোর যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। আগামী আমন মৌসুম আসার আগে সীমিত আউশে কিছু কম্বাইন হারভেস্টারের ব্যবহার ছাড়া প্রায় ৪-৫ মাস যন্ত্রগুলোর তেমন কোনো কাজ থাকবে না। কৃষককে চিন্তা করতে হবে যে, সরকার যে উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে তার দীর্ঘমেয়াদি সুফল পেতে আপনাকে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য প্রত্যেক যন্ত্রের জন্য স্বল্পখরচের হলেও সংরক্ষণাগার তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে। সংরক্ষণাগারে রাখার পূর্বে প্রত্যেকটি নাট-বোল্ট টাইট করে, বেল্ট লুজ করে, নড়নক্ষম সব যায়গায় উপযুক্ত লুব্রিকেন্ট নিশ্চিত করে, ভালভাবে ঢেকে রাখতে হবে। প্রত্যেকটি অটোমোবাইলের মতই এ কম্বাইন হারভেস্টারগুলোকে প্রতি ১৫ দিন অন্তর স্টার্ট দিতে হবে অন্যথায় ব্যাটারিসহ অন্যান্য অনেক অংশ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

বোরো মৌসুমে দেশের প্রায় ১ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার একর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। একটি কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে দিনে ৬-৮ একর জমির ধান কাটা গেলে ও একটি যন্ত্র টানা ২৫ দিন কাজ করলেও মোট আবাদকৃত বোরোর জমির ধান কাটতে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত পঁয়ষট্টি হাজার কম্বাইন প্রয়োজন। সরকার এবছরে মাত্র ১ হাজার ৩০০টি কম্বাইন হারভেস্টার উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে সরবরাহ করছে যা প্রয়োজনের তুলনায় শতকরা দুই ভাগেরও কম। কিন্তু সুখের কথা হলো এই অল্প সহায়তাতেই কম্বাইন হারভেস্টার বিক্রেতা, ক্রেতা ও ব্যবহারকারীদের মধ্যে একটি যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে ও কর্মচঞ্চলতা আসছে। এর ফলে নতুন নতুন কৃষকের মধ্যে কম্বাইন হারভেস্টার ক্রয়ের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্থানীয় পর্যায়ে যন্ত্র চালকের কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, যন্ত্র মেরামতের জন্য মেকানিক সেবার সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে যা নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে। স্পেয়ার বিক্রির জন্য বাজার তৈরি হচ্ছে যার ফলে নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এছাড়া লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে স্থানীয় পর্যায়ে স্পেয়ার পার্টস তৈরির উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

উন্নত দেশের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের অভিজ্ঞতাও এই বলে যে, কম্বাইন হারভেস্টারের মত যন্ত্র অভিযোজনের জন্য প্রথম দিকে সরকারি বিনিয়োগ প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের তুলনায় বেশি থাকবে এবং ক্রমান্বয়ে প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগ বাড়বে ও সরকারি বিনিয়োগ কমবে। আমাদের দেশে সরকারের এই উন্নয়ন সহায়তা ও তার ইতিবাচক প্রভাব কম্বাইন হারভেস্টারভিত্তিক যান্ত্রিকীকরণের পথে সঠিক অগ্রযাত্রার ইঙ্গিত বহন করছে। চালক, মালিক, মেকানিক ও সরবরাহকারীদের যথাযথ দায়িত্ব পালন ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতা দূর করা গেলে দীর্ঘমেয়াদে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুফল ঘরে তোলা যাবে। অন্যান্য সেক্টরের মতো কৃষি সেক্টরও উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাবে।

লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, এফএমপি ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর