করোনার অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত কৃষিবাজেট ২০২০-২১ লিখেছেন অমিত রঞ্জন দে: মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে জাতীয় সংসদে উত্থাপিত করা হবে জাতীয় বাজেট। যখন বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপ এবং ঘুর্ণিঝড় আম্ফানে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত। এই গভীর সংকটময় সময়ে ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজেট প্রণীত হতে যাচ্ছে। জাতীয় বাজেট যেমন একটি রাষ্ট্রের বাৎসরিক আয়-ব্যায়ের হিসাব, ঠিক তেমনিভাবে এর মধ্যদিয়ে তার উন্নয়ন নীতি-দর্শনের প্রায়োগিক প্রতিফলনও ঘটে থাকে।

এবারের বাজেট কোনোভাবেই বিগতদিনের ধরণ, প্যাটার্ণ বা নীতি-দর্শন ঠিক রেখে প্রণয়ন করলে হবে না। কারণ বৈশ্বিক মহামারি করোনা গোটা বিশ্বের জীবন ব্যবস্থা পাল্টে দিয়েছে, পাল্টে দিয়েছে জীবন বোধ, পাল্টে গেছে খাদ্য শৃঙ্খল।
সুতরাং তার সাথে সংগতি রেখেই নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই রপ্তানীমুখী চিন্তাকে পরিহার করে গ্রামীণ অর্থনীতি ও খাদ্য উৎপাদনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। মাথায় রাখতে হবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টিও।

প্রায় প্রতিবছরই কৃষক কি ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয় তা সাধারণত আমাদের জানা, কোথায় কি ধরনের বিনিয়োগ দরকার এবং কিভাবে তা কার্যকর করা যাবে সেটাও আমরা জানি। লকডাউনে বাধাগ্রস্ত হয়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়েছেন।

হাঁস-মুরগী ও ডিম উৎপাদকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দুধ উৎপাদনকারীদের অবস্থা আরো খারাপ। উৎপাদক, বিশেষকরে ফুল, টমেটো এবং তরমুজ জাতীয় পচনশীল পণ্য উৎপাদনকারী পরিবহণ সমস্যার কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। প্রায় প্রতিটা দুর্যোগের সময় কৃষক এরকম কম-বেশি দুর্ভোগের শিকার হয়ে থাকেন।

তাই কৃষিখাতের সামগ্রিক বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে এ ধরনের বা এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্যান্য বিষয়সমূহ মাথায় রেখে ভর্তুকী, ঋণ, কৃষি সম্প্রসারণ সেবা বা প্রশিক্ষণ খাতের বাজেট পরিকল্পনা করতে হবে। বাজেট বরাদ্দ করতে হবে কৃষক ও খামারীর উৎপাদিত পণ্য নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করতে কৃষিজাত ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের কথা মাথায় রেখে।

নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কৃষি অর্থনীতি বা গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত খাতসমূহকে অগ্রাধিকার দিয়েই চিন্তা করতে হবে। দেখতে হবে তা থেকে কৃষি এবং কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষক-ক্ষেতমজুরদের স্বার্থ সুরক্ষিত হচ্ছে কিনা।

করোনা ভাইরাসের কারণে উদ্বুধ পরিস্থিতিতে দেশের দরিদ্র মানুষের দারিদ্র্য আরো গভীর হয়েছে এবং নতুন করে আরো ব্যাপক সংখ্যক মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, করোনা ভাইরাসের প্রভাব আরো দুইবছর পর্যন্ত প্রলম্বিত হতে পারে। যার ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব দেখা দিতে পারে।

আসন্ন ভয়াবহ মন্দায় আমাদের রপ্তানী খাত ও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স খাতে ধ্বস নামবে, দেশের অর্থনীতিতে নেমে আসবে দীনতা। অর্থনীতির এই দীনতা থেকে উদ্ধার পেতে কৃষিখাতকে রক্ষা ও তার পূনরুজ্জীবনের বিকল্প নেই। যদি তাই হয় তাহলে কৃষির বৈচিত্র্য রক্ষা ও বাড়ানো এবং স্থানীয় বাজার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

লক্ষ্য রাখতে হবে খাদ্য নিরাপত্তায় যাদের সবচেয়ে বেশি অবদান সেই ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে কিনা।
কৃষক বারবার ক্ষতির শিকার হচ্ছে। যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে তার ফসল নষ্ট হচ্ছে, সংরক্ষণ করতে পারছে না, উৎপাদন খরচের চেয়ে কমদামে ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে। লোকসান, মহাজনের ঋণের খাতা ভারী আর অপমানের বোঝা মাথায় করে সক্ষম পুরুষ কৃষক মাঠে গিয়ে ফসল ফলানো পরিবর্তে শহরে গিয়ে রিক্সা চালায়, হকারি করে বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করে।

যুবকৃষক কৃষিকাজে নিরুৎসাহিত। কারণ কৃষিতে পয়সা নেই, সম্মান নেই, জমির মালিকানায় নিরাপত্তাহীনতা, দুর্বল গ্রামীণ অবকাঠামো, পারিবারিক কৃষির জন্য সহায়ক সরকারি নীতি ও কর্মসূচির অভাব, কৃষির জন্য উপযুক্ত পাঠ্যক্রমের অভাব এবং কৃষকদের জন্য শক্তিশালি কোনো সংগঠন নেই। বাজেট পরিকল্পনায় এ খাতসমূহের পুনরুদ্ধারে দিক নির্দেশনা থাকতে হবে।
সরকার প্রতি মৌসুমে কৃষকের দুর্ভোগ লাঘব করার জন্য উপযুক্ত মূল্যে ধান-চাল ক্রয় করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। এবারও বোরো মৌসুমের উৎপাদিত ধান থেকে ৮ মেট্রিক টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার এবং ১০ লাখ মেট্রিক টন সেদ্ধ চাল ও ১.৫ মেট্রিক টন আতপ চাল ক্রয় করবে (সূত্র- খাদ্য মন্ত্রণালয়)।

এটাই এ যাবৎ কালের সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা। এখন সরকার যে ধান-চাল ক্রয় করে তা থেকে বাজারে কি প্রভাব পড়ে এবং কৃষক কতটুকু উপকৃত হয়। সরকার যে পরিমান ধান ক্রয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা উৎপাদিত ধানের মাত্র ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ।
প্রশ্ন হলো, এই ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ধান ক্রয় করে বাজারে কি প্রভাব পড়বে এবং তা দিয়ে প্রকৃত কৃষক কতটুকু লাভবান হবে। যেখানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কিনবে উৎপাদিত ধানের ২২ শতাংশ। তারচেয়েও বড় প্রশ্ন সরকারি ক্রয় ব্যবস্থাপনা নিয়ে।

প্রশ্ন মূল্য নির্ধারণ, সংগ্রহের উৎস, সংগ্রহ কেন্দ্র, সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়ে। কারণ আমরা প্রতিবছর লক্ষ্য করে থাকি যে পদ্ধতিতে ধান-চাল সংগ্রহ করা হয় তাতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কর্মী, চালকল মালিকসহ ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়। প্রকৃত কৃষক তা থেকে খুবই সামান্যই লাভবান হচ্ছে। সুতরাং বাজেট বরাদ্দে সাথে সাথে একটি চৌকস ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ঠিক করতে না পারলে ভষ্মে ঘি ঢালা হবে।
একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে তাহলো, করোনা মহামারি এবং সেই সাথে ঘুর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো তাতে, করোনা পরবর্তী সময়ে দরিদ্র মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।

সেক্ষেত্রে ধান-চাল ক্রয়ে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করা, গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করতে কৃষকের হাতে সরাসরি নগদ অর্থে প্রণোদনা দেওয়া, বর্গাচাষিদের ঋণ সুবিধার আওতায় আনার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করা, কৃষিযন্ত্র উৎপাদনে দেশীয় উৎপাদকদের প্রণোদন দেওয়ার জন্য বরাদ্দ রাখা এবং পারিবারিক কৃষির প্রসারে বাজেট বরাদ্দ রাখা এখন সময়ে প্রয়োজন।
বিজ্ঞানিদের ধারণা বৈশ্বিক মহামারি সৃষ্টিকারি করোনা ভাইরাস ইতিপূর্বে কোনো না কোনো প্রাণীর দেহে বাস করতো।

কিন্তু প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে সেই সমস্ত প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ায় তা আজ মানুষের দেহে সংক্রামণ ঘটাচ্ছে। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের নামে জমিতে যথেচ্ছাভাবে সার-কীটনাশকের ব্যবহার করছি। যা মাটি থেকে উপকারী পোকাও ধ্বংস করে ফেলছে। সেই সাথে ধ্বংস হচ্ছে প্রাণবৈচিত্র্য। বিষয়টি ইতিমধ্যে নীতি নির্ধারকদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে জৈব কৃষিনীতি-২০১৭ প্রণীত হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন এবং মাটির ভগ্নদশা থেকে উত্তরণে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ ও কর্মসূচির ঘাটতি রয়েছে।

উদ্বুধ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই কৃষিবাজেট প্রণয়ন করতে হবে। এই বছর কেভিড-১৯ এর কারণে সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘিœত হওয়া এবং আর্থিক ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ায় কৃষককে অতিরিক্ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এই প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠার বিষয়টি মাথায় নিয়েই বাজেট পরিকল্পনা করতে হবে।

বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন ভালো এবং সে ধান নানা উপায়ে কৃষকের ঘরে উঠে গেছে। কৃষক এখন ঋণের টাকা পরিশোধ বা তার অন্য প্রয়োজন মেটাতে ধান বিক্রি করে দেবে। সরকারকে প্রথমেই এই ধান উপযুক্তমূল্যে ক্রয় বা কৃষকের ঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে সে আরো ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়।

করোনা মহামারীর প্রভাবে যে কঠিন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তাতে কৃষক শস্য উৎপাদন, প্রাণীসম্পদ, হাঁসমুরগী এবং মাছ উৎপাদনের জন্য যে ভর্তুকী, ঋণসহ উৎপাদনের উপকরণ এবং সেবাসমূহ পেয়ে থাকে তা অব্যাহত রাখলেই কেবল চলবে না। তা আরো বৃদ্ধি করা এবং ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে।

ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইতিমধ্যেই আমরা লক্ষ্য করেছি এই করোনাকালেও ত্রাণের মাল চুরি হচ্ছে, ধানকাটার যন্ত্র কেনার টাকা লোপাট হচ্ছে। এবিষয়ে আলাদা আলাদা শিরোনামে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।

এটি কঠোর হস্তে দমন করতে না পরলে বাজেটে যত টাকাই বরাদ্দ দেয়া হোক না কেন তা কোনোরূপ সুফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে না। সুতরাং বরাদ্দকৃত বাজেট অত্যন্ত স্বচ্ছতার সাথে দুর্নীতিশূণ্যভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। তারজন্য প্রকৃত কৃষক ও খামারীদের তালিকা হালনাগদ করা। সে অনুযায়ী প্রণোদনা, বিনাসুদে ও হয়রানী ব্যতিরেকে ঋণ এবং সরকারী সহায়তা প্রদানে ব্যবস্থাপনায় বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।

করোনা পরিস্থিতি আমাদের বাজারব্যবস্থা, কৃষক ও ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে এক নতুন দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে। আমরা এখান থেকে অনেক শিক্ষা নিতে পারি। করোনাকালীন সময়ে কৃষিপন্য বাজারজাতকরণে যে নতুন নতুন উদ্ভাবন সৃষ্টি হয়েছে সেগুলোকে সম্প্রসারণ করতে হবে।

যেমন উত্তরবঙ্গ থেকে পন্য পরিবহনে ট্রেনে মালবাহি বগি সংযোজন করা হয়েছে, বিআরটিসির গাড়িগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলোকে অব্যাহত রাখার পাশপাশি তা আরো সম্প্রসারণে উদ্যোগ নিতে হবে। সেইসাথে সরকারকে প্রণোদনা দিয়ে অনলাইন কৃষিবাজার সম্প্রসারণ করতে হবে।

আজ আমরা যখন বিপন্ন জীবনের সীমান্তে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্য-অর্থনীতি, পরিবেশ-প্রকৃতি ও প্রাণ-বৈচিত্র্যকে মাথায় রেখে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় কৃষিকে পূণর্গঠনের কথা ভাবছি তখন নিশ্চয় জৈব কৃষি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলায় সক্ষম কৃষি ব্যবস্থা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। ২০২০-২১ এর বাজেট পরিকল্পনায় তারই শুভউদ্বোধন ঘটুক, নীতিনির্ধারকরা সেখানে বিচক্ষণতার পরিচয় দিক সেটাই আজকের একান্ত চাওয়া।

করোনার অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত কৃষিবাজেট ২০২০-২১ শিরোনামের লেখক: অমিত রঞ্জন দে, ডেপুটি ম্যানেজার, এফআরএসএল, একশন এইড, বাংলাদেশ।