মতিয়র রহমান মুন্না, কৃষি সম্প্রসার অফিসার, গোদাগাড়ী, রাজশাহী, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: কিছুদিন আগেই সুন্দর পৃথিবীর জন্য সমান তালে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিল বিশ্বের সমগ্র জাতি। পথিমধ্যে হঠাৎ করেই এ যেন থমকে যাওয়া। প্রতিবন্ধকতার নাম ফুসফুসের রোগ কোভিড-১৯। করোনাভাইরাস সৃষ্ট এ মহামারির কারণে বিশ্ব মুখোমুখি হয়েছে অভাবনীয় এক সংকটের। বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রাণঘাতী করোনার কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে নতুন করে বিশ্ববিপর্যয়ের আভাস মিলছে।

ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বজুড়ে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪০ থেকে ৬০ কোটি বাড়তে পারে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ১৬ কোটি ৫০ লাখ জনসংখ্যার ৩ কোটি ৩০ লাখ দরিদ্র এবং এর ভিতরে ১ কোটি ৭০ লাখ অতিদরিদ্র। জাতিসংঘ আশঙ্কা করছে, করোনার পরবর্তী দিনগুলোতে বিশ্বমন্দার ভয়াল থাবার পাশাপাশি হানা দিতে পারে দুর্ভিক্ষ। ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য দ‚র করার লক্ষ্যটি প‚রণ করতে বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। এই যখন সার্বিক প্রেক্ষাপট তখন কৃষি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশকে। এসডিজির ১৭টি অভিষ্ট্যের মধ্যে ১০টি অভিষ্ট্যই কোনো না কোনোভাবে কৃষির সাথে জড়িত।

দেশের উচ্চ পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী মহল তাই জোর দিয়েছেন কৃষির উপর। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সকলকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন দেশের কৃষি বিভাগকে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে হাতে নেওয়া হয়েছে একগুচ্ছ কর্মপরিকল্পনা। আর সে কর্মপরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে চারিদিকে থমথমে অবস্থার ভিতরেই দিন-রাত ছুটে চলেছেন কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের সকল স্তরের কর্মকর্তারা। ১৬ কোটি মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে ‘খাদ্য নিরাপত্তার সৈনিক’ হিসেবে দেশ বাঁচাতে লড়াই করছেন কৃষকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

‘কৃষিই সমৃদ্ধি’ স্লোগান নিয়ে বিগত দিনগুলিতেও তারা একইভাবে ছুটেছেন কৃষকের মাঠে। তবে এবারের ছুটে চলার মাঝে আবেগ আছে। আছে সাড়ে ১৬ কোটি বাঙালির অস্তিস্তের প্রশ্ন। আছে বীর বাঙালি জাতির মহানুভবতার প্রশ্ন। আসন্ন দুর্ভিক্ষকে বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী এখন থেকেই খাবার মজুদ করে রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন এবং আহŸান জানিয়েছেন যাতে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী না থাকে। প্রতিটি বাড়ির আনাচে কানাচে বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি দিয়ে ভরিয়ে ফেলার নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রাণীসম্পদ, মৎস্যসহ সামগ্রিক কৃষি খাত ঘিরে ঘোষণা করেছেন ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা। দুর্ভিক্ষকে প্রতিহত করতে যে কোনো উপায়ে হোক খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে। সময়ের সাথে পাল­া দিয়ে ব্যবস্থা নিতে পারলে দেশের প্রয়োজন মিটানোর পাশাপাশি অন্যদেরও সহযোগিতা করা সম্ভব হবে।

চলমান সংকটে তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বাগ্রে জোর দিয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপর। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সময়ে সময়ে জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে সাধারণ ছুটি ও যানবাহন নিয়ন্ত্রিত থাকলে জরুরি সেবা হিসেবে নিষেধাজ্ঞার আওতাবহির্ভ‚ত রাখা হয়েছে কৃষি সেক্টরের সকল কার্যক্রম ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিক ও পরিবহন ব্যবস্থাকে। স্বাভাবিক দিনগুলির চেয়ে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে জেলা-উপজেলা কৃষি অফিসের কার্যক্রমে। একদিকে মাঠ পর্যায়ের নিয়মিত কার্যক্রম, অন্য দিকে করোনা পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের কথা ভেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিশেষ কর্মতৎপরতা। মাঠ প্রশাসনের বৃহৎ অংশ হিসেবে সাথে রয়েছে জরুরি ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ, টিসিবি পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সামাজিক দ‚রত্ব বজায় রাখার বিষয়টি তাদরকি, নিরাপদ দ‚রত্ব বজায় রেখে হাট-বাজার ব্যবস্থাপনা, করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ, খাদ্য গুদাম থেকে চাল সংগ্রহ ও বিতরণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ট্যাগ অফিসারের দায়িত্বপালন। সাধারণ ছুটির সময়ে কর্তব্যের জায়গায় দম ফেলার ফুসরত মিলছে না তাদের।

বর্তমানে মাঠে চলমান রয়েছে বোরো ধান, গম, ভ‚ট্টা, পেঁয়াজ, রসুন, বিভিন্ন শাকসবজি ফসলের কাজ। পরিবর্তিত আবহাওয়ায় ধান ফসলের জন্য হুমকি হয়ে রয়েছে আকষ্মিক বন্যা, কালবৈশাখী ও বিভিন্ন রোগ-বালাই। ব্লাস্ট রোগের অনুক‚ল পরিবেশ বিরাজ করছে মর্মে কৃষি বিজ্ঞানীরা কিছুদিন প‚র্বে সতর্কতা জারি করেছেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কোনোভাবেই ব্যাহত হওয়া যাবেনা। তাই কৃষকদের মাঝে সচেতনতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে চলছে সরাসরি কৃষি পরামর্শ সেবা ও লিফলেট বিতরণ। সামাজিক দ‚রত্ব বজায় রাখতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হচ্ছে ফেসবুক, ইউটিউব, মোবাইল অ্যাপস প্রভৃতি ডিজিটাল কৃষি সেবার।

চলছে বিভিন্ন প্রকল্পের প্রদর্শনী বাস্তবায়ন, সার-বীজসহ কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন রাখা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত প্রতি ইঞ্চি জমির ব্যবহারে কাজ করা, শ্রমিক সংকট কাটাতে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ বাস্তবায়নের সকল কার্যক্রম সম্পাদন, ভর্ত‚কি ম‚ল্যে কৃষি যন্ত্র কেনার ব্যবস্থাকরণ, জেলা-উপজেলায় কৃষি শ্রমিকের তালিকা তৈরি করে অধিক ধান উৎপাদনশীল এলাকায় শ্রমিকদের গমণের ব্যবস্থাকরণ, সেচযন্ত্রসহ সকল কৃষিযন্ত্র, জ্বালানী এবং খুচরা যন্ত্রাংশ ক্রয়-বিক্রয় অব্যাহত রাখা, হাওর অঞ্চলে সম্ভাব্য দুর্যোগের পূর্বেই সমস্ত ধান কৃষকের ঘরে তোলার ব্যবস্থা, খাদ্য অধিদপ্তরের জন্য ধান ও গম ক্রয়ের তালিকা তৈরি, কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের বীজ সহজলভ্য করার জন্য বীজ উৎপাদন প্রদর্শনী নিয়মিত পরিদর্শন ও পরামর্শ প্রদান, ক্ষুদ্র কৃষক-কৃষি ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে ভ্রাম্যমাণ সবজি বাজার চালুকরণ প্রভৃতি। রয়েছে আগামী আউশ ধানের জন্য প্রণোদনা কার্যক্রমের বিনাম‚ল্যে বীজ ও সার কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার মহান দায়িত্ব। করোনা পরবর্তীকালীন খাদ্য সংকটের ঢালস্বরূপ নির্দিষ্ট সময়ে বীজতলা তৈরি করে সে ফসল ফলাতে হবে কৃষকের জমিতে। ক্ষুধামুক্ত বাংলার প্রত্যয়ে এ যেন খাদ্য নিরাপত্তা সৈনিকদের নিরন্তর ছুটে চলা। আর এ যাত্রাপথের অক্লান্ত পথিক কৃষি স¤প্রসারণ কর্মীরা।

অদৃশ্য একটি শত্রুর বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে সকলেই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কিন্তু কৃষি সেক্টর কাজ করছে পায়ের নিচের শক্ত মাটি হিসেবে। যে ভিত্তির উপর দেশ দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম কৃষি। কৃষি আমাদের মেরুদন্ড সোজা দাঁড়িয়ে রাখে বলেই আমরা মাথা উঁচু করে গর্ব করি। প্রতিনিয়ত কৃষির সবুজ জমিনের মাঝে অঙ্কিত হয় এদেশের ভবিষ্যত। প্রাকৃতিক দুর্যোগে, দুর্ভিক্ষে, সংকটে সরকার প্রধানের আস্থার জায়গা কৃষি। আমাদের মাটি আছে, আমাদের মানুষ আছে। আমরা ভয়কে জয় করার ক্ষমতা রাখি। আর এভাবেই লাল-সবুজ পতাকা সগৌরবের দাঁড়িয়ে থাকে কৃষি সেক্টরের হাতে। বিশ্বের বুকে যতবার বাংলাদেশ নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়েছে তার অধিকাংশই কৃষি বিভাগের সফলতার ফলাফল। ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবনে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম দেশ বাংলাদেশ। বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে পাট উদ্ভাবনে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, ধান উৎপাদনে চতুর্থ, আম উৎপাদনে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম-এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে কৃষি বিভাগের নিবেদিত সেবা আর আন্তরিকতার কারণে। সম্ভব হয়েছে সরকার প্রধানের দ‚রদর্শিতা এবং বিনিয়োগের কারণে।

সামনে দিনগুলিতেও যে কোনো সময় বরাবরের মতো দেশের নেতৃত্বে থাকবে কৃষি বিভাগ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন কৃষিকে ঘিরেই দেশের উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন, তেমনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণায় কৃষি সেক্টর দেশের ১৬ কোটি মানুষকে নিরাপদে রাখতে সচেষ্ট থাকবে ইনশাআল­াহ। সংকটে-দুর্ভিক্ষে লড়াই করবে দেশ বাঁচাতে। বিগত কয়েক বছর ধরে অনুক‚ল পরিবেশ বিরাজ করায় ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। দেশ এখন খাদ্য স্বয়ংসম্প‚র্ণ। চলতি বোরো মৌসুমেও বাম্পার ফলন হয়েছে। হাওরের আনন্দ সুর আর মাঠে সোনালী ধানের দোলানো শীষে বিস্তৃত হাসিতে সে কথার সত্যতা ফুটে ওঠে। আধুনিক কৃষি যন্ত্র আর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত শ্রমিকের কোলাহলে পুরোদমে চলছে হাওরের ধান কাটা। সোনালী ধান ঘরে উঠছে, খাদ্য নিয়ে নিশ্চিন্ত হচ্ছে রাষ্ট্র। ‘কৃষক-কৃষি গবেষক-কৃষি স¤প্রসারণ কর্মী’ এ সমাজ যতদিন আছে, জোর দিয়ে বলতে পারি এদেশে কেউ না খেয়ে মরবে না ।

একদিন হয়তো এই মহামারী বিদায় নিবে, বিদায় নিবে দুর্ভিক্ষ। নীরবে নিভৃতে দেশের অক্সিজেনের মতো কাজ করে যাবে দেশের কৃষি বিভাগ। ১৬ কোটি মানুষের মুখে আহার নিশ্চিত করে উন্নয়নের ইতিহাস রচনা করার জন্য দুরন্ত গতিতে ছুটে চলছে কৃষি। নিবেদিতপ্রাণ স¤প্রসারণ কর্মীরা রোদে পুড়ে ঘেমে, মাঠে কর্দমায় চালিয়ে যাচ্ছে তাদের কর্মকান্ড। দেশের কল্যাণে-কৃষকের কল্যাণে-কৃষির কল্যাণে তাঁরা নিরন্তর ছুটে চলেছেন শান্তির বার্তা নিয়ে। কৃষি বাঁচলে দেশ বাঁচবে, কৃষক বাঁচলে জনগণ বাঁচবে। যে কোনো সংকট মুহ‚র্তে কৃষি বিভাগ জনগণের পাশে ছিল-পাশে আছে, আগামীতেও পাশে থাকবে ক্ষুধামুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে।

লেখক: কৃষি সম্প্রসার অফিসার, গোদাগাড়ী, রাজশাহী। বিসিএস কৃষি (৩৬তম ব্যাচ)