এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। দেশটি ধীরে ধীরে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিনত হয়ে এখন উন্নত দেশ হবার আশা দেখা শুরু করেছে মাত্র। তবে এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা যতই উন্নত হোক না কেন, সেটা এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠিকে খাওয়াতে এখনো যথেষ্ট নয়। আর সেটা স্বীকার করতেই হবে। সেক্ষেত্রে এই করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আমাদের বিশ্বের অন্য যেকোন দেশের চেয়ে বেশি যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রয়োজন হবে। খবরা-খবরে যতই জানা যাক না কেন, বাংলাদেশে লকডাউন মানা হচ্ছে না, তারপরও কিছু সচেতন মানুষ কিন্তু ঠিকই মানছিলেন এই লকডাউন। কিন্তু চলতি সপ্তাহ থেকে লক্ষ করা যাচ্ছে সেই লকডাউন ধীরে ধীরে শিথিল করা হচ্ছে।

আমার বিবেচনায় এই সিদ্ধান্তটি আর একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে যাচ্ছে। আমি আমার অন্যে একটা লেখায় একটা সময় বলেছি, করোনার সাথে আমাদের খাদ্য সমস্যাকেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে একই সাথে। কিন্তু খাদ্য সমস্যা বলতে শুধু কৃষকের মাঠের ধান কেটে ঘরে তুলে দেয়া নয়। যারা ফুল চাষ করে সেই ফুল বিক্রি করতে না পেরে শত শত ফুল গরুকে খাওয়ালেন তাদের কি হবে! যারা টনকে টন সবজি বিক্রি করতে না পেরে ফেলে দিলেন তাদের কি হবে! কিংবা স্বল্প সময়ে লাভের আশায় যে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বায়োফ্লক্স করে মাছ চাষ করেছিলেন কিন্তু পরিবহণ ব্যবস্থা না থাকায় লস খেলেন তাদের!! সামনে আম ও লিচুর একটা বিরাট বাজার আসতে যাচ্ছে। কি হবে এই সমস্ত ফলের বাজারের! কথা নাই বার্তা নাই গার্মেন্টস খুলে দিলেন! এর কি মানে! করোনা পরিস্থিতি থেকে কি আমরা বেরিয়ে আসলাম!! রেস্টুরেন্ট, দোকান পাঠ খুলে দিলাম, অফিস আদালত খুলে দিলাম! সত্যিই কি সময় হয়েছে এগুলো চালু করার!!?

আরোও পড়ুন:কক্সবাজারের ‘পঙ্গপাল’ সদৃশ ফড়িং পঙ্গপাল নয়; কৃষি মন্ত্রণালয়

করোনা পরিস্থিতিটি বাংলাদেশের জন্য অন্য যেকোন দেশের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী একটি ঘটনা, সেটা আমি ১০০ ভাগ নিশ্চিত হয়েই বলছি। সুতরাং কষ্ট আরো করতে হবে! দূর্ভিক্ষ আসতেই পারে! সেটাকে সরকার ও জনগণ সকলকেই মেনে নিতে হবে এবং সেই পরিস্থিতি সরকার ও জনগনকে কাঁধে কাঁধ রেখেই মোকাবেলা করতে হবে। এই অদৃশ্য শত্রুর মোকাবেলা আমাদের করতেই হবে। এখন সাময়িক কষ্টের কথা ভেবে অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গিয়ে উল্টো পথে গাড়ী চলার উপক্রম হচ্ছে। প্রতিনিয়ত পুলিশ, ডাক্তার, স্বাস্থ্য কর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। এক এক করে সমস্ত সরকারি হাসপাতাল গুলো বন্ধ হবার উপক্রম। কোন বিবেচনায় আমাদের মনে হচ্ছে আমরা বিপদ থেকে মুক্ত? এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়নের কোন বিকল্প এই মুহূর্তে দেখছি না।

আমার এই কথাটা হয়তো অনেকের খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু এটাই সত্য, এমন একটা সময় আসতে পারে যখন আমাদের priority based চিকিৎসা, সেবা বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাগুলো দিতে হতে পারে জনগণকে। সবাইকে একই সেবার আওতায় আনা সম্ভব নাও হতে পারে, যদিও আমাদের চেষ্টার কোন ত্রুটি থাকবে না। সকলের জন্য সকল সুবিধা প্রদান করা বাংলাদেশের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। এটা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দিলেও সম্ভব হতো না। কিছু অবিবেচক লোককে কিভাবে বাঁচাবো সেই চিন্তা করে দেশের বিবেকবান ডাক্তার, পুলিশ, সরকারী কর্মকর্তা কিংবা আমাদের দক্ষ পোশাক শ্রমিকদের এমন বিপদে ফেলার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত না নেয়ার জন্য জনবান্ধব সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ থাকছে। এখনো লকডাউন উঠিয়ে দেবার মতো সময় আসেনি বলেই আমার মনে হয়। আমরা আর কিছুদিন লক ডাউনে থাকি, প্রয়োজনে পরিস্থিতি অনুকুলে আসলে আমরা আবার দিন রাত পরিশ্রম করে দেশকে গড়ে তুলবো। মনে রাখতে হবে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এক অন্তসার শূন্য বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে সময় নিয়েছিলেন মাত্র কয়েক মাস।

মূলত: ১৯৭১ এ দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সাল থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছিল অদম্য গতিতে, যার স্বাক্ষী ইতিহাস দেয়। দূর্ভাগ্য আমাদের আমরা ধরে রাখতে পারিনি আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুকে, আর ধরে রাখতে পারিনি দেশের উন্নয়নকে। দীর্ঘ লুটপাট ও স্বৈরশাসন এর পর আবার বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেত্রীত্বে যখন দেশ উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে তখন আবার সেই অদৃশ্য শত্রু করোনার বাধা। ইনশাআল্লাহ আমরা এবার সেটাকেও মোকাবেলা করতে পারবো। কিন্তু তার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন ঘরে থাকা প্রয়োজন।

আমাদের মাত্র নব্বই হাজারের মতো রেজিস্টার ডাক্তার রয়েছে। এভাবে একে একে আক্রান্ত হলে আমরা চিকিৎসা সেবা দিবো কিভাবে! পুলিশ সেনা সদস্য যদি একে একে আক্রান্ত হতে থাকেন তবে দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা হবে কিভাবে! অর্থনীতি যতই চাপে পড়বে, দেশে চুরি-ডাকাতসহ অন্যান্য অপকর্মও তত বাড়তে থাকবে। তখন এই সীমিত সংখ্যক বাহিনী দিয়ে কি পরিস্থিতি মোকাবেলা করা যাবে!!? কৃষকের শুধু একটি ফসল ধানের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করলেই হবে! ? সবজি চাষী, ফল-ফুল চাষী কিংবা মসলা চাষীদের পন্যের ন্যায্য মূল্য না দিতে পারলে কৃষি ব্যবস্থাপনাটি ধ্বংশ হয়ে পড়বেনা?? দেশের অন্তত ৬৪টি জেলায় একটি করে হলেও কৃষকের স্থায়ী বাজার প্রতিষ্ঠা করে সরকারী তদারকীতে নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করে তাদের পণ্যের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা কি জরুরী নয়!!

আরও পড়ুনঃ ধানের উৎপাদন খরচ কমাতে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী

এই সবই কি একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার আওতাভূক্ত নয়? তাহলে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় এতো তাড়াহুরো কেন?? এখনই অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে গিয়ে ঢাকা-নারায়নগঞ্জ-গাজীপুরের মতো মৃত্যুপুরীতে পোষাক শ্রমিকদের আনাটাকি ঠিক হচ্ছে!!? আমাদের গার্মেন্টস কিংবা পোষাক শিল্পের বাজারতো আমার বিবেচনায় সামনে এমনিতেই বৃদ্ধি পাবে। কারণ চীন হারাতে যাচ্ছে তার একটি বিরাট শিল্প পন্যের বাজার সেটা প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যায়। বাংলাদেশ যদি সেই বাজারের ১০ শতাংশও ধরতে পারে সেটা হবে বিশাল একটি ব্যবসায়ীক বাজার। তারপরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার একেবারে শুরুতেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি পোষাতে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার এক বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছেন ব্যবসায়ীদের জন্য। তারপরও তাদের কিসের এতো চিন্তা!! দু’টো তিনটে মাস এই পোষাক শ্রমিক যোদ্ধাদের বেতন-ভাতাদি যদি তারা পরিশোধ করতেন তাহলে তো এই শ্রমিকরাই করোনা পরবর্তি সময়ে আত্মতুষ্ট হয়ে দ্বিগুন তিনগুন উৎসাহে কাজ করে এই সময়ের ক্ষতিটি পুষিয়ে নিতে পারতেন।

করোনা মোকাবেলায় তাড়াহুড়ো না করে জাতীয় দূর্যোগ মোকাবেলা কমিটি তৈরি করে একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা তৈরি ও সেই অনুযায়ী আরো কিছুদিন লকডাউন থাকাটা আমার বিবেচনায় খুবই জরুরী। তা না হলে পরিস্থিতি আরো হাতের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশকে বাংলাদেশ হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে, ইউরোপ কিংবা আমেরিকা দিয়ে নয়।

লেখক: ড. শামীম আহমেদ
অতিরিক্ত উপপরিচালক
(কন্দাল, সবজি ও মসলা জাতীয় ফসল)
হর্টিকালচার উইং
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) খামারবাড়ী, ঢাকা।