নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: কোরবানির ঈদ কবে উদযাপিত হবে তা জানিয়েছে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি। জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গেছে বলে জানিয়েছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মু. আ. আউয়াল হাওলাদার।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বায়তুল মোকাররম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সভাকক্ষে জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়।

সভায় সভাপতিত্বে অতিরিক্ত সচিব মু. আ. আউয়াল হাওলাদার বলেন, “বাংলাদেশের আকাশে জিলহজ মাসের চাঁদ দেখা গিয়েছে। সেক্ষেত্রে ১০ জিলহজ বা ১০ জুলাই বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হবে।” ১০ জুলাই ঈদ হবে ধরে নিয়েই ৯ থেকে ১১ জুলাই কোরবানি ঈদের ছুটি নির্ধারণ করে রেখেছে সরকার।

তবে ১০ জুলাইয়ের আগের দুদিন শুক্র ও শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় কার্যত ৮ তারিখ থেকেই ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাবে।

কুরবানির বিধি- বিধান ও মুসলমানদের জন্য করণীয়

সামর্থ্যবান প্রত্যেক মুসলমানের উপরে পরিবারের পক্ষ থেকে কুরবানী করা ওয়াজিব। যদিও কুরবানী ওয়াজিব না সূন্নাহ এ ব্যাপারে ওলামাদের মধ্যে মতভেদ আছে। কুরবানির বিধি বিধান ও মুসলমানদের জন্য করণীয় বিষয় নিয়ে লিখেছেন ড. মাওলানা হাবিবুর রহমান।

রাসূল (সা.) এর হাদীস থেকে জানা যায় এটা ওয়াজিবের পর্যায়ভূক্ত। বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ قَالَ : مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ ، وَلَمْ يُضَحِّ ، فَلاَ يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنَا.

“হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যার কুরবানী করার সামর্থ থাকার পরও কুরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।” (সূনান ইবনে মাজা ও মুসনাদে আহমাদ)

কাজেই ঈদের দিন এবং পরবর্তী ২দিন কারো হাতে পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর পর নেসাব প্ররিমাণ সম্পদ থাকে তার উপরে পশু কুরবানী করা ওয়াজিব। আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা কুরবানীর ইতিহাস, বিধি-বিধান ও মুসলিম উম্মাহর করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

কুরবানীর ইতিহাস:

আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর যুগ থেকেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে। আদম (আ.) এর দুই পুত্র হাবীল ও কাবীলের কুরবানী করার ইতিহাস আমরা আল-কুরআন থেকে জানতে পারি। আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ قَالَ لَأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ

“আর তুমি তাদের নিকট আদমের দুই পুত্রের সংবাদ যথাযথভাবে বর্ণনা কর, যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করল। অতঃপর তাদের একজন থেকে গ্রহণ করা হল, আর অপরজন থেকে গ্রহণ করা হল না। সে বলল, ‘অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব’। অন্যজন বলল, ‘আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের থেকে গ্রহণ করেন’।” (সূরা আল-মায়েদা-২৭)

হযরত আদম (আ.) এর শরীয়াতে জমজ ভাইবোন বিবাহ করা হারাম ছিলো। কারণ মা হাওয়া (আ.) এর গর্ভে ২জন করে সন্তান জন্মগ্রহন করতো, একটা ছেলে একটা মেয়ে। তাই আদম (আ.) বড় ছেলে হাবিলের সাথে কাবিলের সাথে জন্ম নেওয়া আকলিমার সাথে এবং হাবিলের সাথে জন্ম নেওয়া কন্যা লিওযাকে কাবিলের সাথে বিবাহ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই দুই কন্যার মধ্যে আকলিমার চেহারা সুন্দর ছিলো তাই শয়তান কাবিলকে বললো, তোমার সহদরা বোনের চেহারা সুন্দর তুমি এর হকদার। কাবিল শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে বললো, আমার সাথে জন্ম নেওয়া বোন আকলিমাকে আমি বিবাহ করবো। সে নাছোড় বান্দাহ তখন হযরত আদম (আ.) তাদের বললেন, তোমরা দুজনেই কুরবানী করো যার কুরবানী কবুল হবে সেই আকলিমাকে বিবাহ করবে। তারা দুজনেই কুরবানী করলো, হাবিলের কুরবানী কবুল হলো; অর্থাৎ আকাশ থেকে আগুন এসে খেয়ে ফেললো এবং কাবিলের কুরবানী কবুল হলোনা; ময়দানে পড়ে থাকলো। এখান থেকেই কুরবানীর ইতিহাস শুরু হয়।

আদম (আ.) এর পুত্র কাবীল ও হাবীলের কুরবানীর পর থেকে ইবরাহীম (আ.) পর্যন্ত কুরবানী চলতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির ইতিহাস যেখান থেকে কুরবানীর ইতিহার সেখান থেকেই। মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে যত শরীয়াত নাযিল হয়েছে, প্রত্যেক শরীয়তের মধ্যে কুরবানী করার বিধান জারি ছিল। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের মধ্যে অপরিহার্য অংশ ছিলো কুরবানী।

প্রত্যেক নবী-রাসূল এর সময়ও কুরবানী করার বিধান ছিলো। আর এটার পরিপূর্ণতা পেয়েছে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.) এর সময় থেকে। হযরত ইবরাহীম (আ.) এর কাছে থেকে আল্লাহ তাআলা কয়েকটি বড় পরীক্ষা নিয়েছিলেন এর মধ্যে সবচেয় বড় পরীক্ষা ছিলো নিজের সন্তানকে কুরবানী করা। আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانْظُرْ مَاذَا تَرَى

“অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কী অভিমত।” (সূরা সাফফাত-১০২)

একথা শুনে হযরত ইসমাইল (আ.) জবাবে বললেন,

قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ

“সে বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন’।” (সূরা সাফফাত-১০২)

অতঃপর হযরত ইবরাহীম (আ.) সন্তানকে সাথে নিয়ে কুরবানী করার জন্য মক্কার অদুরে মিনার প্রান্তরে হাজির হলেন, পথিমধ্যে শয়তান ৩জায়গায় তাদেরকে প্ররোচনা দেয়, তারা দুজনেই শয়তানকে পাথর মেরে বিতাড়িত করেন। এই স্মৃতিকে মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে ধরে রাখার জন্য আল্লাহ তাআলা হজ্জের জন্য এই স্থানে অবস্থিত জামারায় পাথর মারা ওয়াজিব করে দিয়েছেন।

হযরত ইবরাহীম (আ.) এবার সন্তানকে যবেহ করবেন এবং ইসমাইল (আ.) নিজেও যবেহ হবেন, সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে গেছে। হযরত ইবরাহীম (আ.) যখন ছুরি চলাবেন তখন আল্লাহ তাকে ডাক দিলেন। আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে,

فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ (১০৩) وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ (১০৪) قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ

“অতঃপর তারা উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে কাত করে শুইয়ে দিল, তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, ‘হে ইবরাহীম, ‘তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। নিশ্চয় আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি’।” (সূরা সাফফাত-১০৩-১০৫)

এটা ছিলো আল্লাহর পক্ষ থেকে একটা পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় যখন হযরত ইবরাহীম (আ.) উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ তাআলা কুরবানী করার জন্য আসমান থেকে একটা পশু পাটিয়ে দিলেন। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ (১০৬) وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ

‘নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। আর আমি এক মহান যবেহের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করলাম।” (সূরা সাফফাত-১০৬-১০৭)

এর পর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপরে কুরবানীর এই বিধান জারি ছিল। আল্লাহ তাআলা এ সম্পর্কে বলেন,

وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ

“পরবর্তী কালের লোকদের জন্য এটাকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ স্থাপন করলাম।” (সুরা-সাফফাত- ১০৮)

হযরত ইবরাহীম (আ.) এর পর থেকে আজ অবধি মুসলিম উম্মাহর মাঝে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য আল্লাহর রাস্তায় প্রিয়বস্তু উৎসর্গ করার নমুনা হিসেবে পশু কুরবানী করার প্রচলন চলে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এটা চালু থাকবে। আল্লহ তা‘আলা বলেন,

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرِ الْمُخْبِتِينَ

প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানীর বিধান রেখেছিলাম, যাতে তারা উক্ত পশু যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম স্মরণ করে এ জন্য যে, তিনি চতুষ্পদ জন্তু থেকে তাদের জন্য রিযিক নির্ধারণ করেছেন।” (সূরা হাজ্জ-৩৪)

আমরা মুসলমানরা যে কুরবানী করি এটা হযরত ইবরাহীম (আ.) এর শিক্ষা বুকে ধারণ করেই করি। হযরত ইবরাহীম (আ.) এর কুরবানী করার দিন থেকে প্রতি বছর হজ্জের জন্য যারা মক্কায় আসেন তারা মিনার প্রান্তরে গিয়ে শয়তানকে পাথর মারার পরে কুরবানীর নজরানা পেশ করেন এবং যারা হজ্জ করতে আসেনা অথচ আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে তারাও আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার জন্য, আল্লাহকে খুশি করার জন্য তাদের নিজ এলাকায় কুরবানীর এই নজরানা পেশ করে। এটাই মুসলিম সমাজে কুরবানী বলে পরিচিত।

পশু কুরবানী একটি ইবাদত:

আল্লাহর রাস্তায় পশু কুরবানী করা ইসলামী শরিয়াতে একাট ইবাদত, যা কুরআন, হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এব্যাপারে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

“তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর।” (সূরা আল-কাউসার-২)

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ. لَاشَرِيكَ لَهُ وَبِذَلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ

‘বল, আমার সালাত, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে। তার কোন শরিক নাই এবং আমি এর জন্য আদিষ্ট হয়েছি এবং আমিই প্রথম মুসলিম।” (সূরা আনয়াম-১৬২-১৬৩)

পশু কুরবানী হযরত ইবরাহীম (আ.) এর সুন্নাত:

আমরা যে কুরবানী করি তা হযরত ইবরাহীম (আ.) থেকে প্রাপ্ত প্রিয় জিনিস আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করার নমূনা। এজন্য আল-হাদীসে কুরবানীকে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর সুন্নাত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্ণিত আছে,

عَنْ زَيْدِ بْنِ أَرْقَمَ ، قَالَ : قَالَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ : يَا رَسُولَ اللهِ ، مَا هَذِهِ الأَضَاحِيُّ ؟ قَالَ : سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ قَالُوا : فَمَا لَنَا فِيهَا يَا رَسُولَ اللهِ ؟ قَالَ : بِكُلِّ شَعَرَةٍ ، حَسَنَةٌ قَالُوا : فَالصُّوفُ ؟ يَا رَسُولَ اللهِ ، قَالَ : بِكُلِّ شَعَرَةٍ مِنَ الصُّوفِ ، حَسَنَةٌ.

“হযরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এর সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) কুরবানী কী? উত্তরে নবীজি ইরশাদ করলেন, কুরবানী তোমাদের পিতা ইবরাহীম (আ.) এর সুন্নাত, তারা বললেন এতে আমাদের কী ফজিলত? নবীজি বললেন প্রতিটি পশমের বিনিময়ে পাঁচটি করে সওয়াব। তারা বললেন, ছুফ এর জন্যও কি? নবীজি জবাব দিলেন, ছুফ (অধিক পশম বিশিষ্ট পশু) এর জন্য নেকী রয়েছে।” (সূনান ইবনে মাজাহ)

পশু কুরবানী করার বারাকা ও ফযীলত:

কুরবানীর মধ্যে আল্লাহ তাআলা অনেক বারাকা রেখে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কুরবানী করবে আল্লাহ তাাআলা তার এই কুরবানীর প্রতিদান দিবেন। আল্লাহ তাআলা কুরবানীর গোস্ত ও রক্ত কিছুই চাননা, বরং আল্লাহ মুমিনের অন্তরের তাকওয়া দেখতে চান। এ সম্পর্কে আল-কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,

لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللَّهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ

“আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তাদের গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া। এভাবে তিনি এগুলোকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এজন্য যে, তিনি তোমাদের পথ-প্রদর্শন করেছেন; সুতরাং আপনি সুসংবাদ দিন সৎকর্মপরায়ণদেরকে।” (সূরা আল-হাজ্জ- ৩৭)

কুরবানীর দিনে সবচেয়ে প্রিয় কাজ পশু কুরবানী করা। কুরবানীর পশুর রক্ত জমিনে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। এ সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ عَائِشَةَ ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ قَالَ : مَا عَمِلَ ابْنُ آدَمَ يَوْمَ النَّحْرِ عَمَلاً أَحَبَّ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ، مِنْ هِرَاقَةِ دَمٍ ، وَإِنَّهُ لَتَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ ، بِقُرُونِهَا ، وَأَظْلاَفِهَا ، وَأَشْعَارِهَا ، وَإِنَّ الدَّمَ ، لَيَقَعُ مِنَ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ، بِمَكَانٍ قَبْلَ أَنْ يَقَعَ عَلَى الأَرْضِ ، فَطِيبُوا بِهَا نَفْسًا.

“হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, কুরবানীর দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে প্রিয় কোন আমল আল্লাহর কাছে নেই। ঐ ব্যক্তি কিয়ামতের দিন জবেহকৃত পশুর লোম, শিং, ক্ষুর, পশমসমূহ নিয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। কুরবানীর রক্ত জমিনে পতিত হবার পূর্বেই তা আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব, তোমরা কুরবানির দ্বারা নিজেদের নফসকে পবিত্র কর।” (সূনান ইবনে মাজাহ(

আল-কুরআনের এ আয়াত ও হাদীসের মাধ্যমে জানা যায়, পশুর রক্ত প্রবাহিত করার মাধ্যমে কুরবানীদাতা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন করেন। এবং পশু কুরবানী করার বারাকা হিসেবে যে পশু যবেহ করা হয় তার গায়ের পশম সমপরিমান বা তার পাঁচগুন সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হয়। আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

فَمَا لَنَا فِيهَا يَا رَسُولَ اللهِ ؟ قَالَ : بِكُلِّ شَعَرَةٍ ، حَسَنَةٌ قَالُوا : فَالصُّوفُ ؟ يَا رَسُولَ اللهِ ، قَالَ : بِكُلِّ شَعَرَةٍ مِنَ الصُّوفِ ، حَسَنَةٌ.

“সাহাবীরা বললেন এতে আমাদের কী ফজিলত? নবীজি বললেন প্রতিটি পশমের বিনিময়ে পাঁচটি করে সওয়াব। তারা বললেন, ছুফ এর জন্যও কি? নবীজি জবাব দিলেন, ছুফ (অধিক পশম বিশিষ্ট পশু) এর জন্য নেকী রয়েছে।” (সূনান ইবনে মাজাহ)

পশু কুরবানী কখন করতে হবে:

কুরবানী করার সময় সম্পর্কে সকল ওলামায়ে কেরাম একমত যে, কুরবানী করতে হবে ঈদুল আযহার নামাজ আদায় করার পরে। এ সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنِ الْبَرَاءِ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم : مَنْ ذَبَحَ بَعْدَ الصَّلاَةِ تَمَّ نُسُكُهُ وَأَصَابَ سُنَّةَ الْمُسْلِمِينَ.

“হযরত বারা ইবনে আযিব (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, যে ঈদের সালাতের পর কুরবানীর পশু জবেহ করল তার কুরবানী পরিপূর্ণ হল ও সে মুসলিমদের আদর্শ সঠিকভাবে পালন করল।” (সহীহ আল-বুখারী)

যদি কেউ ঈদের নামাজের আগে যবেহ করে তাহলে তার কুরবানী আদায় হবে না, বরং ঈদের নামাজের পরে আর একটি কুরবানী করতে হবে। এ সম্পর্কে আল-হাদীসে বর্ণিত হয়েছে,

عَنْ جُنْدَبٍ قَالَ صَلَّى النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَوْمَ النَّحْرِ ثُمَّ خَطَبَ ثُمَّ ذَبَحَ فَقَالَ مَنْ ذَبَحَ قَبْلَ أَنْ يُصَلِّيَ فَلْيَذْبَحْ أُخْرَى مَكَانَهَا

“হযরত জুনদুব (রা.) বর্ণিত তিনি বলেন, কুরবানীর দিন রাসূল (সা.) নামাজ আদায় করলেন, তারপর খুতবা দিলেন, তারপর পশু যবেহ করলেন। অতঃপর তিনি বললেন, যে ব্যক্তি নামাজের আগে কুরবানী করবে, অবশ্যই তাকে এর স্থলে আর একটি পশু যবেহ করতে হবে।” (সহীহ আল-বুখারী)

ভাগে পশু কুরবানী করা যাবে কি না?

আমাদের দেশে ভাগে কুরবানী করা যাবে কি না এব্যাপারে মতভেদ আছে। বর্তমান সময়ে কেউ কেউ বলছেন, একজন একটা পশু কুরবানী করতে হবে ভাগে কুরবানী করা যাবে না। তবে সফরে ভাগে কুরবানী করা যাবে বলে তারা মতামত দেন। তারা দলীল হিসেবে নিম্নোক্ত হাদীস পেশ করেন।

عَنْ أَبِي سَرِيحَةَ ، قَالَ كَانَ أَهْلُ الْبَيْتِ يُضَحُّونَ بِالشَّاةِ وَالشَّاتَيْنِ

“হযরত আবি সারিহাতা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, (রাসূল সা. এর জামানায়) একটি পরিবাবেরর পক্ষ থেকে একটি অথবা দুইটি ভেড়া/বকরি কুরবানী করা হতো।” (সূনান ইবনে মাজা)

عَنْ مِخْنَفِ بْنِ سُلَيْمٍ ، قَالَ : كُنَّا وَقُوفًا عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ بِعَرَفَةَ فَقَالَ : يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ عَلَى كُلِّ أَهْلِ بَيْتٍ فِي كُلِّ عَامٍ أُضْحِيَّةً وَعَتِيرَةً.

“হযরত মিখনাফ ইবনে সুলাইম (রা.) বলেন, আমরা নবী (সা.) এর সাথে আরাফাতে অবস্থান করছিলাম, তখন তিনি বললেন, হে মানব সকল প্রত্যেক পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতি বছর একটি করে কুরবানী।” (সূনান আবু দাউদ)

ইমাম আবু হানিফা (রহ.)সহ প্রায় সকল উলামাগণ বলেছেন, একটা গরু সাত ভাগে এবং উট ১০ভাগে কুরবানী করা যাবে। দলীল হিসেবে তারা নিম্নোক্ত হাদীস পেশ করেন।

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ ، قَالَ : كُنَّا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ فِي سَفَرٍ ، فَحَضَرَ الأَضْحَى ، فَاشْتَرَكْنَا فِي الْجَزُورِ عَنْ عَشَرَةٍ ، وَالْبَقَرَةِ عَنْ سَبْعَةٍ.

“হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা রাসূল (সা.) এর সাথে সফরে ছিলাম, এমন সময় ঈদুল আযহা উপস্থিত হলো, আমরা ১০ভাগে উট কুরবানী করেছিলাম এবং সাতভাগে গরু কুরবানী করেছিলাম।” (সূনান ইবনে মাজা, মুসনাদে আহমদ)

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ نَحَرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- عَامَ الْحُدَيْبِيَةِ الْبَدَنَةَ عَنْ سَبْعَةٍ وَالْبَقَرَةَ عَنْ سَبْعَةٍ.

“হযরত যাবের ইবনে আবদুল্লাহ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (সা.) এর সাথে হুদায়বিয়ার বছর একটি উটে সাত ভাগ এবং একটি গরুতে সাত ভাগে কুরবানী করেছিলাম।” (সহীহ মুসলিম)

উক্ত হাদীসের মধ্যে সফরে ছাড়া ভাগে কুরবানী করা যাবে না এটা বলা হয়নি। বরং রাসূল (সা.) নিজে এই সফরে সাত ভাগে কুরবানী করেছিলেন। তাই আমাদের উচিৎ যদি কারো পক্ষে সম্ভব হয় নিজেই একটা পশু কুরবানী করবেন আর সম্ভব না হলে ভাগে হলেও পশু কুরবানী করতে হবে। ভাগে কুরবানী করার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই, কারণ রাসূল (সা.) নিজেই ভাগে কুরবানী করেছেন।

কুরবানীর গোশত বন্টনের বিধান:

কুরবানীর গোশত বন্টনের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা সরাসরি আল-কুরআনে বিধান বলে দিয়েছেন।

فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ

“অতঃপর তোমরা তা হতে আহার কর এবং দুঃস্থ, অভাব গ্রস্থকে আহার করাও।” (সূরা আল-হজ্জ- ২৮)

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, কুরবানীর গোশত নিজেরা খাও এবং অভাবী ও দুঃস্থদের আহার করাও। আল-হাদীসে এ প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে,

قَالَ : رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم كُلُوا , وَأَطْعِمُوا , وَادَّخِرُوا

“রাসূলুল্লাহ (সা.) কোরবানীর গোশত সম্পর্কে বলেছেন, তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর।” (সহীহ আল-বুখারী)

এখানে আহার করাও বাক্য দ্বারা অভাবগ্রস্থকে দান করা ও আত্মীয়-স্বজনকে উপহার হিসেবে দেয়াকে বুঝায়। তাই উলামায়ে কেরাম কুরবানির গোশত তিন ভাগ করে বন্টনের কথা বলেছেন।

১. এক ভাগ দুস্থ ও দরিদ্রদের দান করতে হবে,

২. এক ভাগ উপহার হিসেবে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের দান করতে হবে,

৩. একভাগ নিজেরা খেতে পারবে।

অভাবী ও আত্মীয়, প্রতিবেশীর হক দেওয়ার পরে বাকি গোশত কুরবানীদাতা জমিয়ে রেখে আহার করতে পারবে এব্যাপারে কোন বিধি-নিষেধ নেই। তবে মহামারী, দুর্যোগ অবস্থায় তিন দিনের বেশী জমিয়ে রাখা নিষেধ। আবার কেউ চাইলে সে তার কুরবানীর সম্পূর্ণ গোশতকে বিতরণ করে দিতে পারবে। আর তা করলে উপরোক্ত আয়াতের বিরোধিতা করা হবে না। কারণ ঐ আয়াতে খাওয়ার আদেশ হলো মুস্তাহাব বা সুন্নাত।

অমুসলিমকে কুরবানীর গোশত দেওয়া যাবে কিনা:

কোরবানির গোশত হতে অমুসলিমকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী করার জন্য দেওয়া বৈধ। আর তা ইসলামের এক মহানুভবতা। (ফাতহুল বারী)

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) তার ইহুদী প্রতিবেশীকে দিয়ে গোশত বণ্টন শুরু করেছিলেন। (সহীহ আল-বুখারী)

যারা কুরবানীর গোশত কোন কাফেরকে দেওয়া যাবেনা বলেন, তারা বায়হাকী বর্ণিত ‘তোমরা মুসলিমদের কোরবানি থেকে মুশরিকদের আহার করিও না মর্মে যে হাদীস দলীল হিসেবে পেশ করেন। অধিকাংশ মুহাদ্দিস এ হাদীসকে   যঈফ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

কুরবানীর পশুর কোন অংশ বিক্রি করা বা কসাইকে দেওয়ার বিধান:

কুরবানির পশুর গোশত, চামড়া, চর্বি বা অন্য কোন কিছু বিক্রি করে নিজে গ্রহন করা জায়েয নেই। তবে দান বা উপহার হিসেবে দরিদ্রকে কিছু দিলে তা নাজায়েয হবে না। তাই কুরবানীর চামড়া বিক্রি করা অর্থ এতিম, অসহায় ও দুস্থদের দান করে দিতে হবে।

কসাই বা অন্য কাউকে পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানীর গোশত দেয়া জায়েয নেই। এ সম্পর্কে হযরত আলী (রা.) বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

وَأَمَرَهُ أَنْ يَقْسِمَ بُدْنَهُ كُلَّهَا لُحُومَهَا وَجُلُودَهَا وَجِلاَلَهَا فِى الْمَسَاكِينِ وَلاَ يُعْطِىَ فِى جِزَارَتِهَا مِنْهَا شَيْئًا

“রাসূল (সা.) এর আদেশ হলো, পশুর গোটা শরীর, তার গোশত ও তার চামড়া মিসকিনদের মাঝে বন্টন করে দিতে হবে। এবং তার প্রস্তুত করণে (কসাইকে) তার থেকে কিছু দেয়া হবে না।” (সহীহ আল-বুখারী ও সহীহ মুসলিম)

পরিশেষে বলা যায়, আল্লাহ তাআলা আামাদের কাছ থেকে আমাদের জীবন ও সম্পদ ব্যয়ের ইচ্ছাশক্তি ক্রয় করে নিয়েছেন এবং এর বিনিময়ে আমাদেরকে জান্নাত দান করেছেন। আল্লাহ তাআালা বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ اشْتَرَىٰ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ

“আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল ক্রয় করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে।” (সূরা আত তাওবাহ-১১১) তাই আমাদের উচিত আল্লাহর দেওয়া অর্থের বিনিময়ে পশু ক্রয় করে কুরবানীর দিনগুলিতে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী করে সমাজের এতিম, অসহায়, দরীদ্র মানুষের বাসায় গোস্ত পৌঁছিয়ে দেওয়া। তবেই আল্লাহ আমাদের কুরবানী কবুল করবেন এবং এর উত্তম প্রতিদান দান করবেন। আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করুন। আমীন।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ