মেহেদী হাসান: চলতি বছরের ১১ জুন বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের দ্বিতীয়বারের ঘোষিত বাজেটের আকার বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড়। অর্থাৎ ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট। করোনাভাইরাস মহামারিতে বাংলাদেশের অবস্থা চিঁড়েচ্যাপ্টা, যা দৃশ্যমান। এই কঠিন সময়ে কৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে সরকারি ব্যয়, যাতে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন সম্ভব হয়।

দেশে কোভিড-১৯ মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর বিভিন্ন খাত নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। কৃষি খাতের কি অবস্থা? মৎস্য চাষ, পশুপালন, হাঁস-মুরগির খামার করে দেশে উল্লেখযোগ্য বেকার সংখ্য কমেছে এটা বলা যায়। হাড়ভাঙ্গা খাটুনি এসব খাতে জড়িতদের।

মুরগির এক মেয়াদে এন্টিবায়োটিক খাওয়ানো কম পড়লে খামার উজাড় হয়। মাছকে খাবার কম দিলে বাড়ে না। জমিতে কীটনাশক; সার-পানি কম হলে ফলন কম হয়। সবকিছু ঠিকঠাক হলেও দাম পাবার নিশ্চয়তা থাকে না। আবার প্রণোদনার টাকাও তারা পান না। তাহলে তারা কোথায় যাবেন? চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকেন ব্যংক, বীমা কিংবা সুদের টাকার উপর। অথচ সরকার সরাসরি তাদের প্রণোদনার ব্যবস্থা করলে কিছুটা কাজে লাগাতে পারতেন!

২০২০-২১ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে প্রায় ২৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ১৬ হাজার ৭৩২ কোটি টাকা। আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরে এটি বাড়িয়ে ২১ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা করা হচ্ছে। সে হিসেবে চলতি অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ২ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা বা ২৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

অন্যদিকে কৃষি খাতে বাড়ছে ১ হাজার ৭৫৯ টাকা বা ২৬ দশমিক ৫৪ শতাংশ। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপিতে কৃষি খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৬ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। এ অর্থের মাধ্যমে প্রায় ১৮৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০২০-২১ বাজেটে এ খাতে এডিপি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। ফলে বরাদ্দ বাড়ছে ২৬ শতাংশ বা প্রায় ১ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। কৃষি খাতের এ বরাদ্দ চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় প্রায় ৭৬৬ কোটি টাকা বেশি। মূল এডিপিতে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা।

বাজেট নিয়ে প্রান্তিক কৃষকের মোটেও মাথাব্যথা দেখা যায় না। মাথা ব্যথা হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের। বাণিজ্যিক উদ্যেশ্যে যারা চাষাবাদ করছেন তাদের। কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের। রাজনৈতিক ব্যক্তিবিশেষ ছাড়াও খাত সংশ্লিষ্টদের। দেখা যায় উৎপাদিত পণ্যের লাভের বড় অংশই যায় মধ্যস্বত্বভোগী, আড়তদার, পাইকারদের পকেটে। ফসল ঘরে তোলার শঙ্কায় পড়েন প্রান্তিক কৃষকরা।

বর্তমানে কৃষি উপকরণ সহায়তাপ্রাপ্ত কার্ডধারী কৃষকের সংখ্যা ২ কোটি ৮ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৭ জন। এসব কৃষকের উপকরণ সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়াও কৃষি খামার যান্ত্রিকীকরণে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষি ভর্তুকি ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, কৃষি পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে ৫ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।

বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকেই কৃষিতে বিনিয়োগ করে আসছে। কিন্তু প্রতি বছরই এ বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে যা কৃষির উন্নয়ন এবং কৃষকের উৎপাদন সহায়তায় ঋনাত্বক ভূমিকা পালন করতে পারে। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত ৯৫০০ কোটি টাকার ভর্তুকি মোট বাজেটের মাত্র ১.৬৭ শতাংশ, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল মোট বাজেটের ৬.১৪ শতাংশ। আমরা যদি কৃষি খামার যান্ত্রিকীকরণ বাবদ বরাদ্দকৃত ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকাও ভর্তুকির হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করি তাহলেও এই ১২ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা মোট প্রস্তাবিত বাজেটের ২.২৪ শতাংশ। এই ভর্তুকির পরিমাণ যদি ৪ শতাংশে উন্নীত করা যায় তাহলে কৃষিখাতে প্রাপ্ত ভর্তুকির পরিমাণ হবে ২২ হাজার ৭২০ কোটি টাকা।

প্রণোদনা বন্টনে দুর্নীতি রুখতে কৃষকদের হাতে সরাসরি টাকা পৌঁছানো দরকার। কৃষিতে প্রণোদনা অনেক বেশি বাড়াতে হবে। কৃষি প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই কোন মাধ্যম রাখা যাবে না। ব্যাংক থেকে কৃষকদের মোবাইলে টাকা সরাসরি পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। কৃষকদের ফসল রোপণের সময়ে সরাসরি টাকা প্রদান করতে হবে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বেশিদিন রাখতে পারেন না। টাকার অভাবে, গুদামজাতকরণের অভাবে অল্পদামে বিক্রি করেন। গুদামজাতকরণ এবং ফসলের দাম সঠিকভাবে কৃষকের হাতে পোঁছানোর ব্যাপারে সরকারকে আরোও ভালো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

একেকটি উৎপাদন মৌসুমের শুরুর দিকে এবং শেষে সবচেয়ে বিপদে পড়ে কৃষকরা। তারা ফসল ফলান রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে। খাদ্য নিরাপত্তা, দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকায় বাবুগিরি করি আমরা। কিন্তু কতটা খেয়াল করি তাদের দিকে? তরুণরা কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। নতুন প্রজন্ম কৃষিকে গ্রহণ করছে না। উৎপাদিত ফসলের দাম না থাকায় প্রান্তিক কৃষক জমি বিক্রি করে চলে যাচ্ছে নগরে কায়িক শ্রম বিক্রির জন্য। অপরদিকে হাজার হাজার বিঘা জমি চলে যাচ্ছে বড় উদ্যোক্তাদের হাতে। কৃষির এই ধরনের প্রবণতা ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, নাকি কৃষি খাত উল্টোপথে হাঁটবে বড় সিন্ডিকেটের জিম্মায় পড়ে এ বিষয় অবশ্যই সরকারকেই দেখতে হবে।

এ খাতে বরাদ্দ কৃষি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জড়িত মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়গুলো জড়িত রয়েছে। খাদ্য গুদামজাতকরণ, সংগ্রহ, কৃষকদের প্রণোদনা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে অতিসত্তর। কৃষি খাতে দুর্নীতি শক্ত হাতে মোকাবেলা করে এর সঙ্গে যুক্তদের যতবেশি আগ্রহী করা যাবে এই বাজেট ততবেশি ফলপ্রসূ হবে।

কৃষকদের মোট আয়ের প্রায় ২৭ ভাগ মধ্যস্বত্বভোগীর পকেটে যায়। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে উভয়ের মধ্যে একটি সমতা আনতে পারলেই কেবল একটি সফল বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। শুধু মধ্যস্বত্বভোগী নয়, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সদয় দৃষ্টি ছাড়া এ বাজেট যে কৃষিবান্ধব বাজেট হতে পারে তা কৃষকদের বোঝানো বড় শক্ত।

গত আড়াই দশকে দেশে কৃষিক্ষেত্রে যান্ত্রিক শক্তির ব্যবহারও উল্লেখযোগ্য পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ৫৮ বছরে কৃষি ক্ষেত্রে শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৬০ সালে হেক্টর প্রতি ০.২৪ কিলোওয়াট হতে ২০১৮ সালে হেক্টর প্রতি ১.৮২ কিলোওয়াট হলেও জাপান, ইতালি, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যের মত বড় বড় শিল্পায়িত দেশগুলির তুলনায় এখনও অনেক কম।

কৃষি কাজের আধুনিকীকরণ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের উন্নয়নের উপর নির্ভর করে যা কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ চারা রোপণ, পরিচর্যা, ফসল সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং মূল্য-সংযোজনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে উপেক্ষিত হয়েছে। দেশের কৃষি খাতকে শেয়াল-শকুনদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারলে কেবল কৃষক সমাজ বাঁচবে।

কৃষি বাজেট ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য লেখাটির লেখক: সদস্য, রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি।এগ্রিকেয়ার২৪.কমের রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি ।