মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী: গত ভরা বোরো মৌসুমে বাজারে নতুন ধানের ছড়াছড়ি কিন্তু সেসময় দেখা মেলেনি নতুন চালের। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যন্ত সব দোকানেই বিক্রি হয়েছে পুরাতন চাল। তাহলে নতুন মৌসুমের নতুন চাল কোথায় গেলো? খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন-গুদাম ভর্তি হয়েছে এ বছরের সব ধান।

বর্তমানে চালের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে দাম বেড়েছে ৩-৭ টাকা। ফলে ৫০ কেজির বস্তায় বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম। একইসাথে গরীবের মোটা চালেও আগুন!

১২ আগস্ট রাজশাহীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারের প্রতিটি চালের দোকানে পুরাতন চাল। নতুন চালের দেখা নেই এখনো। পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে ধানের দাম বেড়েছে। তাই চালের দাম বাড়ছে।

অপরদিকে খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, সবকিছু হয় অদৃশ্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে। বড় বড় চালকলের মালিকরা লাখ লাখ মণ ধান চাল মজুদ করছে। সরকার সবকিছু মনিটরিং করছে ঠিকই কিন্তু কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। হাতের নাগালের বাইরে চালের সিন্ডিকেট। তাদের কারণেই চালের দাম বাড়ছে।

পড়তে পারেন: ৫০ বছরে চালের উৎপাদন বেড়েছে চার গুণ

রাজশাহীর সাহেববাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মো: বদিরুল আলম (সুজন) বলেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অতিরিক্ত দাম পাবার আশায় চাল মজুদ করে রাখছেন মিল মালিকরা। চালের দাম বাড়ানোর নেপথ্যে একটা অদৃশ্য সিন্ডিকেট কাজ করছে। জনগণকে জিম্মি করে এক শ্রেণীর অসাধু মিল মালিকরা মুনাফা করতে চায়। এখন চলতি ধানের মৌসুমে বাজারে নতুন চাল আসেনি। এরকারণ চালের দাম আরো বাড়বে। মজুদদারদের কয়ফিয়ত হিসেবে এখন জ¦ালানি তেলের দাম বৃদ্ধি যোগ হয়েছে। যখন জ¦ালানি তেলের দাম বাড়েনি তখন কি কারণে চালের দাম বেড়েছে? প্রশ্ন রাখেন এই বিক্রেতা।

অপরদিকে এমন অভিযোগ মানতে নারাজ মিল মালিকরা। তারা বলছেন, করোনায় অনেক মিল বন্ধ হয়ে গেছে। তারা আর উৎপাদনে ফিরতে পারেননি। তাছাড়া ধানের দাম অন্যান্য দু-পাঁচ বছরের চেয়ে বেশি। বেশি দামে ধান কেনার কারনে বেশি দামে চাল বিক্রি করতে হচ্ছে। তাছাড়া মিল মালিকদের অবৈধভাবে চাল গুদামজাত করার কোন সুযোগ নেই।

পড়তে পারেন: চালের দাম বাড়াচ্ছে সিন্ডিকেট

নওগাঁ জেলা চালকল সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চাকলাদার বলেন, আমাদের মিল মালিকদের কাছে যদি অতিরিক্ত কোন ধান কিংবা চাল পাওয়া যায় তাহলে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। মজুদ নীতিমালা অনুযায়ী সরকার অভিযান পরিচালনা করুক। আমাদের কাছে কোন অতিরিক্ত ধান-চাল মজুদ নেই। সব অভিযোগ ভিত্তিহীন।

এই নেতা চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বলেন, ধানের দাম বেড়েছে তাই চালের দাম বাড়ছে। ভবিষতে চালের দাম কি হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। গত বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন ব্যহত হওয়ার কারণে প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মিল মালিক বলেন, চালের দাম বেড়ে গেলে বিভিন্ন জায়গায় চালকল মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়। বিভিন্ন জায়গায় লাখ লাখ মণ চাল বের হয়। এখন তাহলে অভিযান করা হচ্ছে না? সরকার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের বাইরে কিছু করতে পারবে না। কোন তদারকি নেই, বাজার মনিটরিং নেই। যা করলে লোক দেখানো। নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুরের মিলগুলোতে হানা দিক দেখা যাতে দুইদিনে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে এসেছে। মিলাররা মজুদ করার কারণেই চালের দাম বাড়ছে।

পড়তে পারেন: ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণ করে কারা?

ধান-চাল মজুদের কথা স্বীকার করেছেন খোদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। বোরো ২০২২ মৌসুমে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও বাজার মনিটরিং সংক্রান্ত অনলাইন মতবিনিময় সভায় খাদ্যমন্ত্রী বলেন, অধিকাংশ মিল মালিক বাজার থেকে ধান কিনলেও তারা উৎপাদনে যাচ্ছেন না। বাজারে নতুন চাল এখনও আসছে না। এখন বাজারে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে তা গত বছরের পুরাতন চাল। তাহলে নতুন ধান যাচ্ছে কোথায়?

শুক্রবার (১২ আগষ্ট) সাহেববাজারের এক চালের আড়তের মালিক রুবেল হোসেন বলেন, তেলের দাম বাড়ার পর থেকেই চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। প্রতিদিন মিলগেটে চালের দাম বস্তাপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকা বাড়ছে। তিন-চারদিনের ব্যবধানে সেটা ৩০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

দেশের চালের মোকামে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা বাড়িয়েছেন মিলাররা। চলতি সপ্তাহে তেলের দাম বাড়াতে উৎপাদন খরচ বাড়াতে বাজারে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর এতেই বস্তায় ৩০০-৭০০ টাকা বেড়েছে।

রাজশাহী বাজারে চলতি সপ্তাহে ৫০ কেজি ওজনের স্বর্ণা-৫ চালের বস্তা গেল সপ্তাহে ২ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হলেও এ সপ্তাহে তা দাম বেড়ে ২ হাজার ৭০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। জিরাশাইলের দাম ৩ হাজার ৪০০ থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৬০০ টাকা, কাটারি স্টার ৩ হাজার ৪০০ থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৫৫০ টাকা। মিনিকেট ৫০ কেজির বস্তার দাম ৩ হাজার ২০০ টাকা থেকে বেড়ে ৩ হাজার ৩৫০ টাকায় উঠে গেছে। আঠাশ দাম ২ হাজার ৯০০ থেকে বেড়ে ৩ হাজার ১০০ টাকা। পোলার চাল হিসাবে খ্যাত চিনিগুড়া চাল ৫ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হলেও সপ্তাহে বেড়েছে ৭০০ টাকা, বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার টাকায়।

পড়তে পারেন: কারসাজি করে মিলাররা চালের দাম বাড়িয়েছে : কৃষিমন্ত্রী

হঠাৎ চালের দাম বাড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, অধিক মুনাফার সুযোগ নিচ্ছেন মিল মালিকরা। খুচরা বাজারে প্রতি কেজিতে ৬ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিয়ে চাল কিনতে গিয়ে আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ক্রেতারা। সংসার চালানো খুব কষ্টকর। এক কেজি চালে ৬ টাকা বেড়ে যাওয়া মানে মাসে ১০০০ টাকা বাড়তি গুনতে হচ্ছে।

মাস্টারপাড়া কাঁচাবাজারের চাল ব্যবসায়ী সুশীল কুমারের সাথে। তিনি বলেন,‘চালের দাম বাড়ছে। আমরা আড়তে গিয়ে চাল পাচ্ছি না। ধানের দাম বাড়ার কারনে চালের দাম বাড়তি। এক সপ্তাহ আগের চেয়ে বর্তমানে প্রতিকেজি চালে বেড়েছে ৮ থেকে ১০ টাকা।

মাস দুয়েক আগে মিনিকেট চাল ৬০ টাকা বিক্রি হলেও এখন ৬৮ থেকে ৭০ টাকা। আঠাস ৫০-৫২ টাকা থেকে বেড়ে ৫৬, ৫৮, ৬২ টাকা, জিরাশাইল ৪ টাকা বেড়ে ৬০ টাকা হয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য চালের কেজিতে বেড়েছে ১০-১২ টাকা। বাজারে বাসমতি ৮০ থেকে ৮৫ টাকা, নাজিরশাইল ৬০ টাকা থেকে ৭৫ টাকা, কাটারিভোগ সিদ্ধ ৭০ টাকা, স্বর্ণা ৪০-৪২ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ৪৮ টাকা, গুটিস্বর্ণা ৪৫, কালজিরা আতব ৯০ টাকা থেকে ১০ টাকা বেড়ে ১০০, চিনিগুঁড়া ১০০ টাকা থেকে ১১০, কাটারি আতপ ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

এপি চাউল ভান্ডারের মালিক ও চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বলেন, চালের মোকাম ও মিলগুলোতে কারসাজি করে চালের দাম নির্ধারণ করা হয়। খুচরা ব্যবসায়ীদের পকেটে লাভের টাকা আসে না। যা যায় সিন্ডিকেট আর পাইকারি ব্যবসায়ীদের পকেটে। আমরা যা চাল বিক্রি করছি সব পুরাতন চাল। সরকারের দায়িত্ব ভরা মৌসুমে গতবছরের পুরাতন চাল কেন তা বের করা। যদি ঠিকমতো মজুদদারদের বের করা সম্ভব হয় তাহলে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ