মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: করোনাকালীন সময় থেকে বিগত আড়াই বছর ধরে পোল্ট্রি খামারিরা তেমন লাভের মুখ দেখেননি। অনেকে ছেড়ে দিয়েছেন ব্যবসা, তালা ঝুলিয়েছেন খামারে। তবে, গত দু-সপ্তাহের ব্যবধানে ডিম-মুরগির দাম আশানুরুপ বেড়েছে। ফলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, হয়েছেন খুশি। পোল্ট্রি সংশ্লিষ্টরা বলছেন- পোল্ট্রি পণ্যের দাম আরও বাড়তে পারে।

কোরবানির ঈদের আগে মুরগির মাংসের দামে ব্যপক দরপতন হয়। ঈদ পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে দাম দাম। শুধু মুরগি নয়; ডিমের দামেও হাওয়া লাগে। তবে দাম বাড়ার সম্ভাবনায় মাংস উৎপাদনে ফিরেছেন অনেক খামারি। ভবিষ্যতের দাম বাড়ার আশায় খামারে বাচ্চা তুলতে শুরু করেন তারা।

বাজেট পরবর্তী সময়ে সরকারি সহযোগিতার দিকে বেশ আশাবাদী ছিলেন খাত সংশ্লিষ্ট সকলেই। খামারিরা চাতক পাখির মতো চেয়ে থেকেছেন- পোল্ট্রি ফিডের দাম হয়ত কমবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। উল্টো খাদ্যের দাম গত জুলাই মাসের ১২ তারিখে বাড়িয়ে দেওয়া হয়। ৫০ কেজির বস্তায় ১০০ টাকা। কিন্তু সে সময় কমে গেছে মুরগির দাম। সবমিলিয়ে এখন দাম বাড়ার কারণে আগের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে জানিয়েছেন খামারিরা।

পড়তে পারেন: ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণ করে কারা, কেন ধরা খায় খামারিরা?

বর্তমানে রাজশাহীর খামারগুলোতে ব্রয়লার মুরগি প্রতিকেজি মুরগির কেজিতে বেড়েছে গড়ে ১৫ টাকা। অপরদিকে ডিমের হালিতে বেড়েছে প্রায় ৬ টাকা।

রাজশাহীর পব্ াউপজেলার পারিলা এলাকার লেয়ার খামারি আব্দুল মজিদ এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, “গত দুই বছর ধরে পাঁচ-ছয় দফায় পোল্ট্রি ফিডের দাম বেড়েছে। আমরা লোকসানে লোকসানে শেষ হয়ে গেছি। গত মাসেও খাদ্যের দাম বেড়েছে। আগে ১৯’শ টাকায় যে খাদ্য কিনেছি সেই খাদ্য এখন ৩২’শ ৫০ টাকা বস্তা। তবে, ডিমের দাম বাড়ার কারণে লাভ হচ্ছে। মিথ্যে বলবনা- ১ হাজার ডিমে এখন দেড়-দু হাজার টাকা লাভ হচ্ছে।”

তিনি আরও বলেন, “ বর্তমানে খামারে লাল ডিমের পাইকারি রেট ১ হাজার ২০টাকা শ। সাদা ডিম সাড়ে ৯’শ টাকা একশ ডিমের দাম। বাজারে এরচেয়ে কিছু বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।”

পড়তে পারেন: ডিমের হালি ৪, ব্রয়লার মুরগির কেজিতে বাড়লো ২০ টাকা

রাজশাহীর সাহেববাজারের পাইকারি ডিম বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ভাই ভাই আড়ত এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন,“ ডিমের দাম বাড়তি। ৪৫ টাকা হালি লাল ডিম এবং সাদা ডিম ৪০ টাকা। হাঁসের ডিম ৪৮ টাকা। ডিমের দাম আরও বাড়বে। বাজারে ডিমের ঘাটতি বলাই চলে।”

আজ বৃহস্পতিবার (১১ আগস্ট ২০২২) রাজশাহীর সাহেব বাজার এলাকার খুচরা ও পাইকারী দোকান ঘুরে দেখা গেছে। ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতিকেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। খামারি পর্যায়ে ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা দাম হলেও তা খুচরা বাজারে এসে ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

রাজশাহীর হরিপুর এলাকার পোল্ট্রি খামারি রাকিব এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, মুরগির দাম বেড়েছে কিছুদিন হলো। ঈদের পর থেকে মুরগির দাম বাড়ছে। বাজারে যে দামে বিক্রি হয় খামারে তারচেয়ে ৭ থেকে ৮ টাকা কম দামে বিক্রি করতে হয়। এখন যে দাম আছে তাতে খামারিদের ভালোই লাভ হচ্ছে।

পড়তে পারেন: মঙ্গলবারের (৯ আগষ্ট) পোল্ট্রির ডিম, মুরগি ও বাচ্চার পাইকারি দাম

রাজশাহী নগরীর সাহেব বাজারের পোল্ট্রি বিক্রেতা সাইফুল ইসলাম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ব্রয়লারের দাম রাতে বেড়েছে। বাজারে মুরগির চাহিদা আছে কিন্তু সরবরাহ কম তাই দাম বেড়েছে। ব্রয়লার ১৭০ টাকা, সোনালী ২৬০ টাকা, লেয়ার ২৩০ টাকা এবং প্যারিস মুরগি ২৬০ টাকা দরে বিক্রি করছি। মুরগির দাম আরো বাড়তে পারে।”

মুরগির দাম বাড়তি থাকায় মাংস উৎপাদনের ব্রয়লার, সোনালি, কক মুরগির বাচ্চা আবারো খামারে তুলতে শুরু করেছেন খামারিরা। এমনই জানিয়েছেন রাজশাহী পোল্ট্রি এসোসিয়েশন।

ডিম-মুরগির দাম বাড়ার বিষয়ে কথা হয় রাজশাহী পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হকের সাথে। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, চারিদিকে সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে ডিম-মুরগির দাম বাড়া অসম্ভব নয়। অবহেলিত এ খাতের মাথা চাড়া দেওয়ার সময় হয়ত চলে এসেছে। রাজশাহীতে করোনায় ৭০ ভাগ খামার বন্ধ। মাঝখানে উৎপাদন খরচ আরো বেড়ে গেলো, কারণ ভুট্টা, সয়াবিন মিল, প্রোটিনের দাম বেড়েছে। রেডি মুরগির দাম কমায় খামারিরা আরো বিপাকে পড়েছিল। কয়েকমাস আগে খামারিরা বাচ্চা তোলা বন্ধ করে দেয় ফলে দেখা যায় সেই সংকট এখন। ৫০ শতাংশ খামারে মুরগি নেই। এই কারনেই দাম বেড়েছে। এই দাম আর একটু বাড়ার পর কমতে থাকবে।

এই পোল্ট্রি সংগঠক বলেন, বর্তমানে লেয়ার মুরগির বাচ্চা খামারিরা তুলতে শুরু করেছেন। কারণ দীর্ঘমেয়াদী এই প্রজেক্ট। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তখন খামারিরা ভয় পেয়ে বাচ্চা তোলেননি। আগামীর ভবিষৎ চিন্তা করে খামারিরা আবার নামছেন মাঠে।

মুরগি দোকানদার মিঠু হোসেন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, পোল্ট্রি মুরগি ২০০ টাকা দরে বেঁচা হচ্ছে। ব্রয়লারের আমদানী আছে দামও আছে। সোনালি মুরগির দাম বাড়ছে কারণ বাজারে সোনালি মুরগি একটু কম। সোনালি ২৮০ টাকা, কক মুরগি ২৮০ টাকা, হাঁস ৪৫০ টাকা, রাজহাঁস ৪৫০ টাকা কেজি বিক্রি করছি। দাম আরো বাড়বে এটা নিশ্চিত।”

পড়তে পারেন: ব্রয়লার, সোনালী ও লেয়ার মুরগির ফিডের বর্তমান বাজারদর

একই বাজারের ফাহিম ডিম ভান্ডারের মালিক মাসুদরানা এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন,“ডিমের দামে খামারিরা কিছুটা লাভবান হচ্ছেন। খাবারের দাম বেশি থাকলে লাভ কিছুটা কম হয়। লাল ডিম পাইকারিতে হালি ৪৪ টাকা টাকা আর সাদা ডিম ৪০ টাকা দরে বিক্রি করছি।”

রাজশাহীর পবা উপজেলার পোল্ট্রি খামারি ও উদ্যোক্তা মুজিবুর রহমান এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, মূলত প্রান্তিক এক হাজার-দু-হাজার মুরগির খামারিরা ধ্বংশ হয়ে গেছে। বাণিজ্যিকভাবে যেসব মুরগি ও ডিমের উৎপাদন হচ্ছে তা বাজারে আসছে। বাজারে এখন যে দাম তাতে খামারির লাভ হবে ঠিক কিন্ত এই লাভের চেয়ে ১০ গুণ লোকসান দিয়েছেন তারা। এখন কিছুটা হয়ত পোষাবে।

খাদ্যের দামে উৎপাদিত মুরগির ডিমের দাম তুলনামূলক ঠিক আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা ডিম উৎপাদন করতে লাগে ৮ টাকা ৪০ পয়সা। আর বাজারে পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৯ টাকা। ৬০ পয়সা লাভ দিয়ে কোন কিছু করা সম্ভব কি? প্রশ্ন রাখেন তিনি। আমাদের দেশের সিন্ডিকেট সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ৪-৫ দফায় পোল্ট্রি খাদ্যের দাম বেড়ে এখন আকাশচুম্বী। ১৮’শ টাকার খাদ্যের বস্তা এখন ৩২’শ টাকা। যদি এই বাড়তি দাম থাকে তাহলে লাভ হবে। খামারিরা বাঁচতে পারবে।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ