মেহেদী হাসান, রাজশাহী, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: দেশে বিগত তিন দশকে রেশম উৎপাদন তলানিতে নেমেছে ।১৯৯০-২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত রেশম গুটি উৎপাদন, তুঁত চারা উৎপাদন ও রোপন, রোগমুক্ত ডিম উৎপাদন ও বিতরণ এবং রেশম সুতা উৎপাদন প্রায় ৫ গুণ কমেছে বলে জানা গেছে।

রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রমতে, ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে রেশম সুতা উৎপাদন করা হয় ৩৪ হাজার ৭০০ কেজি। এরপর ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ হাজার ৪৫০ কেজি। ওই উৎপাদনই ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার ৮৭০ কেজিতে নেমে আসে। এরপর ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ৫ গুণ কমে রেশম সুতা উৎপাদন হয় ১২ হাজার ২১১ কেজি। এ বছর সরকারি পর্যায়ে (পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়) রেশম সুতা উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৮০ কেজি। এ দেশজ উৎপাদনে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার মাত্র ৪ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে রেশম উন্নয়ন বোর্ড।

রেশম উৎপাদন তলানিতে নামার কারণ হিসেবে দীর্ঘ সময় রেশম কারখানা বন্ধ থাকা, নতুন রেশম আইন, বিধি ও সুস্পষ্ট নীতিমালার প্রয়োগ না হওয়াকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়াও বিনা শুল্কে চীন থেকে সুতা আমদানি, বর্তমানে রেশম কারখানা সচল রাখার প্রয়োজনীয় আর্থিক তহবিল এবং কৃষকদের কাছ থেকে গুটি কেনার জন্য সরকারি আর্থিক তহবিল ঘোষণা না হওয়া অন্যতম কারণ।

আরোও পড়ুন: পোরশায় রেশম চাষী সমাবেশ অনুষ্ঠিত

বস্ত্র, রেশম, তাঁত ও পাট শিল্পের হারানো ঐতিহ্য ফেরানোর আহ্বান

বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড/২০১৩ আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ রেশম বোর্ড, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট এবং সিল্ক ফাউন্ডেশেনকে একীভূত করে রেশম বোর্ড গঠন করা হয়। ফলে কর্মরত ৫৮১টি পদ বিলুপ্ত করা হয়ে যায়। ফলে একদিক থেকে ভেঙ্গে পড়ে রেশম উৎপাদন কার্যক্রম।

বর্তমানে অনুমোদিত মোট ৫৩১টি পদের মধ্যে ১৮৫টি পদে জনবল বিদ্যমান। কিন্তু ৩৪৬টি পদ শূন্য। প্রথম শ্রেণির ৪৮টি পদের মধ্যে ৩১টি শূন্য। দ্বিতীয় শ্রেণির ৫১টি পদের মধ্যে ২৯টি, তৃতীয় শ্রেণির ৩২৭টি পদের মধ্যে ২৩৩টি এবং চতুর্থ শ্রেণির ১০৫টির মধ্যে ৫৩টি পদ শূন্য।

১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে রেশম উন্নয়ন বোর্ড থেকে রেশম গুটি উৎপাদন করা হয়েছে ৫ লাখ ৬২ হাজার কেজি। সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হয়েছে ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে। ওই বছরে মোট উৎপাদন ছিল ৯ লাখ ৫৭ হাজার কেজি। সেই উৎপাদন কমে ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে এসে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার কেজি। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে গুটি উৎপাদন হয় ১ লাখ ৯২ হাজার কেজি।

১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে তুঁত চারা উৎপাদন ও রোপণ করা হয়েছে ১৭ লাখ। সব থেকে বেশি উৎপাদন ও বিতরণ করা হয়েছে হাজার ১৯৯০ থেকে ১৯৯১ অর্থবছরে। অর্থবছরের চারা উৎপাদন ও রোপণ করা হয়েছিল ২৬ লাখ। ২০১৪ -২০১৫ অর্থবছরে উৎপাদন ও রোপন দাঁড়ায় ধারায় ৩ লাখ ৯৫ হাজার চারা। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের সম্প্রসারণ এলাকায় ৫ লাখ ৮৫ হাজার চারা উৎপাদন, বিতরণ ও রোপন করা হয়েছে।

অপরদিকে ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে রোগমুক্ত রেশম ডিম উৎপাদন ও বিতরণ করা হয় ৩১ লাখ। সবচেয়ে বেশি উৎপাদন ও বিতরণ করা হয় ১৯৯৪-৯৫ অর্থবছরে। ওই সময়ে রোগমুক্ত রেশম ডিম উৎপাদন ও বিতরণ করা হয় ৫২ লাখ ৮৬ হাজার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে কমে দাঁড়ায় মাত্র তিন লাখ ৭৯ হাজারে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রোগমুক্ত রেশম ডিম উৎপাদন ও বিতরণ উৎপাদন হয় ৪ লাখ ৫১ হাজার।

জানা গেছে, চলতি বছরে দেশের ৪১ টি জেলার ৯৯ টি উপজেলার ৪২০ বিঘা তুঁত জমি চাষাবাদ ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পে ৫২৮ টি সমিতির মাধ্যমে ২২ হাজার ৭৩৩ জন সদস্যের মধ্যে ৩৮০৩ জন চাষিকে বিনামূল্যে তুুঁত চাষের আওতায় আনা হয়। ৯৯৭ জন রেশম চাষি পলুপালনে সম্পৃক্ত হয়ে রেশম গুটি উৎপাদন করছে। বর্তমানে চাষিদের বিনামূল্যে রোগমুক্ত ডিম, রেশম ডালা, ঘরসহ আর্থিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, রেশম চাষের ভরা যৌবন ছিল নব্বইয়ের দশক। দীর্ঘদিন কারখানা বন্ধ থাকায় উৎপাদন কমে গেছে। কিন্তু বর্তমানে চাষিদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য রেশম বোর্ড উল্লেখযোগ্যভাবে কাজ করে যাচ্ছে। রাজশাহী রেশম কারখানায় চলতি অর্থবছরে ৪ হাজার ৭৭০ মিটার রেশম কাপড় উৎপাদন করা হয়েছে। ৮১০ জন রেশম চাষি ও বসনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়েছে। বর্তমানে রেশম ডিমের দাম চাষিদের দিতে হয় না, বোর্ড বহন করে। রেশম চাষে আগ্রহীদের সকল প্রকার সুযোগ- সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে। সবসময় মাঠ পর্যবেক্ষণ করা হয় এবং রেশম চাষিদের পরামর্শ প্রদান করা হয়। ফলে আবারো উৎপাদন বাড়ছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের মহাপরিচালক মুহাঃ আবদুল হাকিম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, নব্বইয়ের দশকে চীন থেকে বিনা ট্যাক্সে সুতা আমদানির কারনে দেশীয় রেশম সুতা মার খায়। পরে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাষিরাও রেশম চাষ ছেড়ে দেয়। বর্তমানে ধীরে ধীরে রেশম উৎপাদন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ১ কেজি রেশম গুটি যদি কেউ উৎপাদন করে সেই গুটিও আমরা কিনে নেব। রেশম চাষের জন্য চাষিদের সর্বোতভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করা হচ্ছে।

কারখানা চালু ও উৎপাদন করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাজশাহীর রেশম কারখানাটি পরীক্ষামূলক চালু করা হয়েছে। ৬ টা লুম বিভিন্ন পর্যায়ক্রমিকভাবে চালানো হচ্ছে। যেহেতু কারখানা চালানোর জন্য কোন তহবিল নেই সেহেতু ধীর গতিতে চলছে। এছাড়াও রেশম গুটি কেনার তহবিল নেই। ঠাকুরগাঁওয়ে বন্ধ কারখানাটি পুনরায় চালু হবে এমন প্রত্যাশা করছেন তিনি।

রাজশাহী বস্ত্র অধিদফতরের উপ-পরিচালক আসাদুজ্জামান এগ্রিকেয়ার২৪.কম, রেশম উৎপাদন কমে গেছে এটা নিয়ে উচ্চ পর্যায়ে মিটিং করে একটা সমাধান হবে আশা করছি। গত সপ্তাহে সচিব স্যার এসেছিলেন কারখানা পরিদর্শন করেছেন।’
সরকার পরিচালিত দেশের দুটি রেশম কারখানার একটি ঠাকুরগাঁওয়ে, অন্যটি রাজশাহীতে। উনিশ বছর ধরে বন্ধ ঠাকুরগাঁওয়ের রেশম কারখানা। যত্নের অভাবে প্রায় বিকল কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি। কারখানাটি চালু করতে একাধিকবার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সুস্পষ্ট নীতিমালার অভাবে তার সুরাহা হয়নি।

তিন দশকে রেশম উৎপাদন তলানিতে নামলেও বর্তমানে বাড়ছে উৎপাদন। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ ষোল বছর পর রাজশাহী রেশম কারখানা ২০১৮ সালে ১৬ জুলাই পুনরায় চালু করা হয়। এ কারখানায় ব্লক, তুলিয়ন, গরদ, বলাকা, মটকা ইত্যাদি থান কাপড় তৈরি ও বিক্রয় করা হয়।

এগ্রিকেয়ার/এমএইচ