বাংলাদেশ ফিসারিজ কমিউনিটি : লকডাউনের মধ্যেও মানুষের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না ডলফিন। চট্টগ্রামের হালদা নদীতে ধরা পড়া একটি ডলফিনকে মেরে ফেলেছে জেলেরা। ৮ মে সকালে রাউজানের উরকিরচর ইউনিয়নে হালদা নদীতে মরা ডলফিনটি ভেসে আসে। এর আগেও একটি মৃত ডলফিন পাওয়া যায়। গত তিন বছরে (২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে) এই পর্যন্ত মোট ২৪টি মৃত ডলফিন দেখা গেছে। তবে এর অধিকাংশ কোনও না কোনোভাবে আঘাত পেয়ে মারা গেছে। পরে সেগুলো নদীতে ভেসে ওঠে। গবেষকদের মতে, যে গতিতে হালদায় ডলফিন মারা যাচ্ছে তাতে আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে হালদা ডলফিন শূন্য হয়ে যেতে পারে। তাই ডলফিন রক্ষায় হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাটহাজারীর জ্যেষ্ঠ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নাজমুল হুদা রনি বলেন, ‘শুক্রবার সকালে নদীর মদুনাঘাট সংলগ্ন অংশে ডলফিনটি ভাসতে দেখে স্থানীয়রা প্রশাসনকে অবহিত করে। পরে ডলফিনটি উদ্ধার করে মাটিতে পুতে ফেলা হয়। ডলফিনটির মুখে জালের অংশ বিশেষ লেগেছিল। এছাড়া মাথার নিচে এবং শরীরের মাঝ বরাবর দুই পাশ থেকে লম্বালম্বিভাবে কাটা ছিল। ধারণা করছি, জালে আটকা পড়ার পর এটিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে হত্যা করা হয়।’
গবেষকরা জানিয়েছেন, নদীতে ইঞ্জিন চালিত নৌযানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, রাসায়নিক দূষণ এবং অবাধে মাছ ধরার কারণে সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে ডলফিন। গাঙ্গেয় এসব ডলফিন রক্ষায় এখনই পদক্ষেপ না নিলে আগামী দুই তিন বছরের মধ্যে হালদায় আর ডলফিন থাকবে না।
কেন ডলফিনগুলো মারা পড়ছে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সরোয়ার মোর্শেদ বলেন, ‘মূলত দুটো কারণে ডলফিন মারা পড়ছে। তার মধ্যে একটি হলো ইঞ্জিনচালিত নৌকার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে আঘাত পেয়ে মৃত্যু। কারণ ডলফিন খুব স্পিডে চলাচল করে, দ্রুতগতিতে যাওয়ার সময় যখন নৌকার সঙ্গে ধাক্কা খায় তখন আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পরে মরে গিয়ে ভেসে ওঠে। আবার মাঝে মাঝে জেলেরাও ডলফিনগুলো মেরে ফেলে। জেলেরা যখন নদীতে জাল বসায়, তখন ডলফিনগুলো জালে আটকা পড়ে। আটকা পড়ার পর ডলফিনগুলো জালকে পেচিয়ে ফেলে, তখন জাল রক্ষা করতে গিয়ে জেলেরা ডলফিন মেরে ফেলে।’
একই কথা জানিয়েছেন দক্ষিণ মার্দাশা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান এম এ মজিদ। তিনি বলেন, ‘হালদা নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরা নিষেধ। এরপরও কিছু অসাধু জেলে চুরি করে নদীতে জাল ফেলে। তাদের হাতে মাঝে মধ্যে ডলফিন মারা পড়তে পারে। কারণ ডলফিনগুলো ছুটোছুটি করে চলে। চলতে গিয়ে ডলফিনগুলো জালে আটকা পড়লে তারা ডলফিন মেরে নদীতে ফেলে দেয়। যে কারণে নিশ্চিত করে বলা যায় না কে বা কারা, কী কারণে ডলফিনগুলো মেরে ফেলছে। শুধু মারা যাওয়ার পর যখন নদীতে ভেসে উঠে তখন আমরা জানতে পারি একটা ডলফিন মারা গেল। এর জন্য জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। নদীতে টহল বাড়াতে হবে।’
গড়দুয়ারা ইউনিয়নের নয়াহাট এলাকার ডিম সংগ্রহকারী জেলে আলী আকবর বলেন, ‘নদীতে এখন ইঞ্জিনচালিত নৌকা অনেক কমে গেছে। এখন বেশির ভাগ ডলফিন জালে আটকা পড়ে মারা যায়। আটকা পড়ার পর ছুটোছুটি করে বের হতে না পেরে ডলফিনগুলো অনেক ক্ষেত্রে নিজ থেকে মারা যায়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে জেলেরাও জাল থেকে খুলতে কষ্ট হবে তাই মেরে ফেলে। ইদানিং ডলফিন মেরে ফেলার পেছনে আরও একটি কারণ আছে। স্থানীয়দের মধ্যে কুসংস্কার আছে ডলফিনে তেল নারীদের উপকারে আসে। স্থানীয়দের কাছে এই তেলের চাহিদা আছে ৫০ গ্রামের এক বোতল তেল ১৫০ থেকে ২০০ টাকা বিক্রি হয়। তাই তেলের লোভ থেকেও ডলফিন মেরে ফেলছে জেলেরা। গত শুক্রবার যে ডলফিনটি পাওয়া গেছে, আমাদের ধারণা তেলের জন্যই এটিকে মেরে ফেলা হয়েছে। তবে তেলের জন্য খুব একটা মারা হয় না। তেল নিতে হলে কেটে নিতে হয়। তবে এখন পর্যন্ত যে কটি ডলফিন মারা গেছে এগুলোর মধ্যে শুক্রবারের এই ডলফিনটি ছাড়া অন্যগুলো কাটা পাওয়া যায়নি।’
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল জেটি নির্মাণে প্রকল্প এলাকায় জেনিটিক রিভার ডলফিন, পানিতে থাকা বিভিন্ন প্রাণী এবং মাছের কোনও ধরনের প্রভার পড়বে কিনা তা যাচাইয়ের জন্য একটি গবেষণা করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম, পরিবেশ ও বন বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল-আমিন এবং মেরিন সায়েন্স অ্যান্ড ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক আয়েশা আক্তার এ গবেষণাটি পরিচালনা করেন। এ গবেষণায় তারা নিশ্চিত হয়েছেন, কর্ণফুলী থেকে হালদাসহ আশপাশের মিঠা পানিতে আনুমানিক ১৫০টির মতো ডলফিন আছে। তবে এই সংখ্যাটি থেকে কম বেশিও হতে পারে বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল আমিন।
তিনি বলেন, ‘হালদা বা কর্ণফুলীতে যে ডলফিন দেখা যায় সেগুলো সাগরের ডলফিন নয়। এগুলো মিঠা পানির ডলফিন। কর্ণফুলীতে যখন লোনাপানি বেড়ে যায় তখন ডলফিনগুলো হালদায় চলে আসে। আবার যখন লোনা পানি নেমে যায় তখন তারা কর্ণফুলী চলে আসে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিপন্ন প্রজাতির এই ডলফিনগুলো আমাদের সংরক্ষণ করা উচিত। ডলফিনগুলো যাতে অবাধে বিচরণ করতে পারে সেজন্য আমরা আলাদা জোন করারও তাগিদ দিয়েছি। আলাদা জোন করে ওই অংশে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করতে হবে। ডলফিনগুলো বিচরণ করতে গিয়ে অনেক সময় জেলেদের জালে আটকা পড়ে। তখন জেলেরা জাল থেকে ছাড়ানোর জন্যই ডলফিন গুলো মেরে ফেলে।’
তবে অন্য একটি জরিপে হালদায় মাত্র ৪৫টি ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ইউএনডিপির সহযোগিতায় গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি ও বনবিভাগ ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ জরিপ চালায়। ওই জরিপে, হালদা নদীর মোহনা থেকে সাত্তার ঘাট পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকাকে ডলফিনের হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডলফিন রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদী জরুরি উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেয় তারা।
গবেষকরা জানান, হালদায় ডলফিন রক্ষায় তেমন কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি এখনও। উল্টো গত দেড় বছরে মারা গেছে প্রায় ২৪টি ডলফিন। যদিও মঙ্গলবার (১২ মে) হাইকোর্ট হালদা নদীতে ডলফিন রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। তবে হাইকোর্টের এই আদেশে সন্তুষ্ঠু নন গবেষকরা। তারা এই আদেশের মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করার দাবি জানিয়েছেন।
এ সর্ম্পকে হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মঞ্জুরুল কিবরীয়া বলেন, ‘হালদায় গত দুই থেকে আড়াই বছরে ২৪টি ডলফিন মারা গেছে। এই লকডাউনের মধ্যেই মারা গেছে দু’টি ডলফিন। এভাবে কয়েকদিন পর পর ডলফিন মারা পড়লে খুব অল্প সময়ের মধ্যে হালদা ডলফিন শূন্য হয়ে পড়বে। তাই এসব ডলফিনের প্রজাতি ধরে রাখার জন্য সরকারের এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘হাইকোর্ট ডলফিন রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। এটি নিশ্চয় একটি মহৎ উদ্যোগ। হাইকোর্টের এই আদেশ এখন মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। যেসব কারণে ডলফিন মারা যেতে পারে এসব বিষয় যেমন ইঞ্জিন চালিত নৌযান চলাচল সীমিত করতে হবে। ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি জেলেদের আরও সচেতন করতে হবে। যদি কোনও জেলের জালে আটকা পড়ে ডলফিন মারা যায় তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তবেই ডলফিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে অন্যথায় এভাবে মাঝে মাঝে মারা পড়বে। এক সময় হালদা ডলফিন শূন্য হয়ে যাবে।’