নানা গুণে গুণান্বিত হয়েও

আবু খালিদ, সিনিয়র প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: মেধা আছে, কাজ করার ক্ষমতাও আছে। রয়েছে সৃষ্টিশীলতা ও অধিক পরিশ্রমের মানসিকতা। এতোসব গুণে গুণান্বিত হয়েও নির্দিষ্ট এক গণ্ডির মধ্যে ঘুরপাক খেতে হচ্ছে উদ্যোমী গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের।

সঠিক দিক-নির্দেশনা, তথ্য-উপাত্ত, অনুপ্রেরণা, পারিবারিক সমর্থন আর সামান্য আর্থিক সহযোগিতার অভাবে কোন কিছু শুরু করার পরেও থেমে যেতে হচ্ছে তাদের। অথচ এসব সহযোগিতা পেলে চিত্রটা অন্যরকম হতো।

সহযোগিতা পাওয়া ও না পাওয়া দেশের একাধিক গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তা, গবেষক, সংগঠনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে ওঠে এসেছে এমন তথ্য।

গবেষণার জরিপ পর্যালোচনা করলেও দেখা যায় নারী উদ্যোক্তারা সহযোগিতার অভাবে অনেক পিছিয়ে আছেন।

উইমেন এন্টারপ্রেনিয়ার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ওয়েব) সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশে প্রায় শতকরা ৩৭ ভাগ নারী সহযোগিতার অভাবে কাজ করতে পারছেন না। এসব নারীদের মাঝে সম্ভাবনা থাকলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় বন্দি হয়ে আছেন।

দীর্ঘদিন ধরে গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে ওয়েব সংগঠনের সভাপতি শাহারুক রাহমান এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের মেধা আছে, কাজ করার ক্ষমতা আছে। তাদের পাশে দাঁড়ালে তারা অন্যরকম শক্তি পান।

এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, গ্রামের নারী উদ্যোক্তাদের টাকা নিজেদের কাছে থাকে না, পরিবারের কর্তার পকেটে চলে যায়। তারা কোন সিদ্ধান্তও নিতে পারে না। এছাড়া নানান বিষয়ে তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়। এসবের একমাত্র সমাধান তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।

তিন’শত গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব রুরাল সোস্যালজি এর এসোসিয়েট প্রফেসর ড. লাভলু মজুমদার।

সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে এ গবেষক বলেন, গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের মাঝে অনেক ‍সৃষ্টিশীলতা থাকলেও সেগুলো বিকাশ খুব কম-ই হচ্ছে। তাদের সম্ভাবনাগুলো অনেকটা চাপা পরেই থাকছে। অথচ কাজ করতে তাদের কোন আপত্তি নেই।

গ্রামের নারীদের হাতের কাজ সব সময়ই প্রশংসার দাবিদার, এছাড়া তারা একটানা পরিশ্রম করতে পারেন, যোগ করেন তিনি।

পরামর্শ হিসেবে ড. লাভলু মজুমদার বলেন, সবমিলিয়ে যদি বলি তাহলে এক কথায় বলবো তাদের পৃষ্টপোষকতা দরকার। এরপর তথ্য ও দিকনির্দেশনাসহ আনুসঙ্গিক বিষয়গুলোর সাপোর্ট দিতে হবে। তাদের পণ্যগুলো বিক্রির একটা প্লাটফর্ম করে দেয়া জরুরি। ওরিয়েন্টশনের মাধ্যমে তাদের কাছে তথ্য তুলে ধরতে হবে।

সামান্য দিকনির্দেশনা আর সহযোগিতায় কীভাবে বদলে যায় গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের জীবনযাপন তার অন্যতম প্রমাণ মিলবে গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ এর রামজীবন ইউনিয়নের মোছা. মিতি বেগমের মুখ থেকে শুনলে।

মিতি বেগম জানান, প্রতিবেশিদের দেখে তিনি ৩০০ লেয়ার মুরগি নিয়ে ছোট একটা খামার দিয়েছিলেন। ছোট খামার হওয়ায় তেমন কোন আয়ের দেখা পাচ্ছিলেন না। অনেকটা হতাশায় প্রায় বন্ধই করে দিচ্ছিলেন তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্নের খামারটি।

হঠাৎ করে সহযোগিতা পেয়ে ঘুরে দাঁড়ান। অল্প সময়ের ব্যবধানে ৩০০ লেয়ার মুরগির খামার থেকে তার খামারে মুরগির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজারে। বর্তমানে মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয় করছেন তিনি।

মিতি বেগম এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, একশনএইড বাংলাদেশ এর ‘মেকিং মার্কেট ওয়ার্ক ফর উইমেন (এমএমডব্লিউডব্লিউ)’ প্রকল্প এর আওতায় এসকেএস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় আমার জীবনে এমন পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। উনাদের সহযোগিতা না পেলে হয়তো এতদিন ঘর আর থালাবাসন পরিস্কার করেই আবদ্ধ জীবন কাটাতে হতো।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, একশনএইড বাংলাদেশ এর এমএমডব্লিউডব্লিউ এর প্রকল্পের সহায়তায় মিতি বেগমের মতো অনেকেই জীবনে সফলতা পেয়েছেন। পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলেছেন। মেধাবী ও পরিশ্রমী গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা গড়ে তুলেছেন নিজেদের একটি করে প্রতিষ্ঠান। পরিবারে এনেছেন আর্থিক স্বচ্ছলতা।

কৃষি আবাদ করতে গিয়ে বারবার ক্ষতিতে পরেছেন রেহেনা বেগম। ফরিদপুরের এ নারী উদ্যোক্তা বলেন, ফসলের রোগবালাই হলে কীভাবে তা দ্রুত সমাধান করা যাবে সেই পদ্ধতিটা আগে জানতাম না। ফলে অনেক ক্ষতির শিকার হয়েছি। কিন্তু ওই প্রকল্পের সহায়তায় সবকিছুর জানার কৌশল শিখেছি। এখন প্রতিবছরই জমি থেকে ভালো আয় হয়। তবে বাজার ব্যবস্থাপনা আমাদের জন্যে সহায়ক হলে আরও ভালো হবে।

আলাপকালে গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা এ প্রতিবেদককে বলেন, তারা সব সময়ই প্রস্তুত রয়েছেন পরিশ্রম করতে। গরু পালন, মাছ চাষ, ফসল উৎপাদনসহ কৃষির সব কাজেই আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু পরিশ্রমের ফসল যখন বিক্রি করতে পারেন না, অথবা ক্ষতিতে পরতে হয় তখন হতাশায় সব কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তায় সরকারিভাবে যেসব পদেক্ষেপ নেয়া হয় সেগুলোর শতভাগ বাস্তবায়ন দরকার। সামাজিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সবার এগিয়ে আসতে হবে। সফল নারী উদ্যোক্তাদেরও এখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে।

তারা বলছেন, সবমিলিয়ে আমাদের সবার এগিয়ে আসতে হবে, তবেই গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা তাদের শতভাগ প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পাবেন। আলোকিত করতে পারবেন নিজেদের পরিবার তথা গ্রামীণ অর্থনীতিকে।

আরও পড়ুন: প্রতিবন্ধকতার বেড়াজালে বাজারে যেতে পারছেন না নারী উদ্যোক্তারা, বঞ্চিত ন্যায্য-দাম থেকে