গো-খাদ্য সংকট হওয়ায় কচুরিপানার ওপরই একমাত্র ভরসা। ছবি: মেহেদী হাসান। এগ্রিকেয়ার২৪.কম

মেহেদী হাসান, নিজস্ব প্রতিবেদক, এগ্রিকেয়ার২৪.কম: বাংলাদেশের উত্তর- পশ্চিম কোনে ভারতের গা-ঘেঁষে এগারটি উপজেলা নিয়ে গঠিত নওগাঁ জেলা। জেলায় হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ নানা ধর্মাম্বলম্বীদের বাস। এক অংশের জীবন জীবিকা নির্বাহ হয় গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, শুকর পালনের মাধ্যমে। চলতি বছরের দফায় দফায় বন্যায় তলিয়ে গেছে জেলার বিস্তীর্ণ গো-চারণভূমি, গবাদিপশুর আবাসস্থল। ফলে খাদ্য সংকটে ও বন্যায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে কয়েকটি উপজেলার প্রায় ৭৬ হাজার ১৯৪ টি গবাদিপশু (গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, শুকর) এবং দুর্ভোগে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ।

জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, জেলায় সবচেয়ে বেশি পালন করা হয় গরু।এবছর ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৬১১ টি গরু, ১২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৭ টি ছাগল, প্রায় ৫ লাখ ১২ হাজার ভেড়া, ১৮ হাজার ৪২০ টি মহিষ এবং ১৫ হাজার ৩০০ টি শুকর পালন করা হয়েছে। সেইসাথে সাম্প্রতিক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩’শ ৮ মেট্রিক টন কাঁচা ঘাস , শুকনো খড় ৭৯০, দানা জাতীয় খাদ্য ১ হাজার ১ মেট্রিকটন।

এরমধ্যে মান্দা উপজেলায় ৪ লক্ষ ৬০ হাজার ২৩১ গরু, ২ লক্ষ ১০ হাজার ৩২০ ছাগল, ১ লক্ষ ৬৭ হাজার ২০০ ভেড়া লালন পালন করা হয়।এ উপজেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২৪ হাজার ৫২৭ টি গবাদিপশু। তবে, অসুখে মারা যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি বলে জানিয়েছেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।

গত কোরবানির ঈদে গরুর, ছাগল, মহিষ, ভেড়ার সংখ্যা কিছুটা কমলেও বন্যায় এ বিপুল সংখ্যক গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন জেলার বিভিন্ন অঞ্চলের চাষিরা।

জেলার মান্দা উপজেলার চকভোলাই গ্রামের বাসিন্দা মেহের আলী। নিজে লাঠিতে ভর করে চললেও ৬ মাইল দুরে কালীনগর বিলে এসেছেন কচুরিপানার সন্ধানে। কথা হয় এগ্রিকেয়ার২৪.কমের সাথে। তিনি জানান, ‘ বাড়িতে ৪ টি গরু আছে। বাড়ির বাইরে বের হলেই এক-বুক পানি। বিলের ঘাস তো ডুবে গেছে- গেছেই সাথে উঁচু যেসব জমি ছিল সেসবও পানির নিচে। নিজের খাবার না থাকলেও গরুর জন্য বাতরাজ (কচুরিপানা) কাটতে আসছি।’

শুধু মেহের আলী নয়, নওগাঁর লাখ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়ে গবাদিপশু নিয়ে বেহাল দশা। টানা প্রায় দুই মাসের বেশি সময় ধরে বন্যাকবলিত রয়েছে জেলার কয়েকটি উপজেলা।

বন্যাকবলিত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, গো-খাদ্য সংকটে অনেক খামারিরাই অল্প দামে গরু, ছাগল, ভেড়া বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু শুকর বিক্রির সংখ্যা একেবারেই কম। বিস্তীর্ণ মাঠে শুকরের পাল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন বছরের বিভিন্ন সময়ে। তারা বন্যার কারণে সিদ্ধ তরিতরকারি, মূল জাতীয় ফসল, কুমড়ো, কাঁচা শাকসবজি খাওয়াচ্ছেন বলে জানান মান্দা উপজেলার মহানগর এলাকার বাসিন্দা নগেন পাল।

জেলার মান্দা উপজেলার ভারশোঁ গ্রামের বাসিন্দা রশিদ এগ্রিকেয়ার২৪.কম কে বলেন, বন্যার আগে খড়ের দাম কম থাকলেও তা কয়েকমাসে কয়েকগুণ বেড়েছে। আশি আঁটি ( ১ পণ) ২০০ কিনতে পারলেও এখন সেই টাকায় মাত্র ৩০ আঁটি খড় কিনতে হচ্ছে। খল ও ভুষির দামও বস্তাপ্রতি তিন শ থেকে চার শ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এত দাম দিয়ে খাবার কিনে গরুকে খাওয়াতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

যে ক্ষুদের ৫০ কেজির (চালের ভাঙ্গা অংশ) বস্তা ৯০০ টাকায় পাওয়া যেত তা এখন ১২’শ টাকা। তারপরও বাজারে সংকট। এখন আর বাবুগিরি করে লাভ নাই। অভাবে অনেক সময় কচুরিপানা তুলে গরুকে খাওয়াতে হচ্ছে। বাড়ির কাছে নাই তাই গাড়ি নিয়ে এসেছি ১০ কিলোমিটার দূর থেকে। আপাতত কয়েকটা দিন এভাবেই চালাতে পারলে পানি নামলেই ঘাস পাওয়া যাবে বলে বলছিলেন উপজেলার ছোট চকচম্পক গ্রামের জয়েন আলী।

নওগাঁ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মহির উদ্দীন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, । জেলায় ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৬১১ টি গরু, ১২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৭ টি ছাগল, প্রায় ৫ লাখ ১২ হাজার ভেড়া, ১৮ হাজার ৪২০ টি মহিষ এবং ১৫ হাজার ৩০০ টি শুকর পালন করা হয়েছে। জেলার সব উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। মান্দা, আ্রত্রাই, নিয়ামতপুর উপজেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে সহযোগিতা ও ত্রাণ সামগ্রীও সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।

বন্যাকবলিত এলাকায় গো-খাদ্য সংকটের পাশাপাশি পানিবন্দি এলাকাগুলোতে গবাদিপশুর আবাসস্থলের সংকট প্রকট। পানিবন্দি এলাকাগুলোতে বাড়ির বাইরে গাদাগাদি করে গবাদিপশুগুলো রাখা হয়েছে। এতে নিরাপত্তা নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত।